আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৬)

Photo of author

By Anwar Hakim

  • আজিমপুর টু উত্তরা
  • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
  • আনোয়ার হাকিম।

(৬)
এর আগে খাগড়াছড়ি আসিনি। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যে লালিত, শোভিত এই উপত্যকা যেন বর্ণিল পশরা বিছিয়ে রেখেছে সর্বত্র। আমার থাকার জায়গা হয়েছে এক ফ্ল্যাট বাড়ীতে অপর তিন সহকর্মীর সাথে। সহকর্মীরা সবাই আমার সিনিয়র। সারাদিন প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুড়ে বেড়াই কাজে। সন্ধ্যায় সব পাখী ঘরে ফেরে। তাই বাধ্য হয়েই ঘরে ফিরি। ফেবুতে মজে থাকি। বন্ধুদের সাথে ফোন আর চ্যাটিং করে রাত কাবার করে দেই। জেমির কথা থেকে থেকে মনে পরে। দিনে কাজের মধ্যে যতটা হাল্কা থাকি রাতে ততটাই জেমি নির্ভরতা পেয়ে বসে। আমারই আবেগের বেয়ারা বেগ যে পরিস্থিতিকে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তা বুঝি।

আমাদের সিনিয়র সহকর্মী কাম হাউজ মেট রশিদ জামান ভাই বড় ভালো মানুষ। বয়স চুয়াল্লিশ-পয়তাল্লিশ হবে। বিয়েশাদি করেন নি। কাজ ছাড়া আর সব কিছুতেই তিনি বড় বেশি উদাসীন। তার কোন পিছু টান নেই। শিশুর মত সরল সহজ এই মানুষটি রাতে খাবার পর দরোজা এঁটে পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান করেন। তাও বিরহের। তার ঢেউ এসে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। তাঁকে ঘিড়ে আমার কৌতুহল বাড়তেই থাকে। তার গাওয়া গানগুলো সব বিরহের । এই গানগুলো আগে অনেকবার শুনেছি। কিন্তু হৃদয়ে এভাবে বিঁধে নি এর আগে কোনদিন। শুনতে শুনতে আমি আপ্লুত হয়ে যাই। আচমকা একদিন বললেন, “ছোট ভাই, হেভ ইউ গট এনি প্রবলেম ইন সাইড”? আমি থতমত খেয়ে গেলাম। তিনি তা বুঝতে পেরে বললেন, “আই কেন গ্যেস। লিভ ইট। ইউ নিড নট এক্সপোজ , ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডু”। আমি আরো কুঁকড়ে গেলাম। তাকে মনে হলো মাইন্ড রিডার। বললাম, “আপনিও কি কিছু বয়ে বেরাচ্ছেন”? তিনি আশ্চর্য হয়ে বিস্ফারিত চোখে বললেন, “কেন এমন মনে হলো”? আমি কাঁধ নেড়ে বললাম, “কেন জানি মনে হলো”। প্রসঙ্গ পাল্টাবার অছিলায় বললাম, “আপনার গলা কিন্তু ভারি সুন্দর। বিশেষত বিরহের গানগুলো সুপার্ব”। সেই মুহুর্ত থেকে আমাদের যৌথ অবসর কাটে নানা প্রসঙ্গে।

খাগড়াছড়িতে আমাদের বাসার লাগোয়া জামে মসজিদ। বেশ বড়। পাঁচ বেলা আযানের ধ্বনি কানে এসে নাড়া দিয়ে যায়। অস্বস্তি ফিল করি তখন যখন মুয়াজ্জিনের কন্ঠে শুনিঃ হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ। নামাযের জন্য আসো, কল্যাণের জন্য আসো। মনে পড়ে ছোটবেলায় বাসায় নামাযের কড়াকড়ি ছিল। বাবা আঙ্গুলে ধরে নিয়ে যেতেন মসজিদে। কাতারের এক প্রান্তে নিয়ে বসতেন। বলতেন তাঁকে অনুসরণ করার জন্য। আম্মা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বা অবসরে ছোট ছোট সুরা মুখস্ত করাতেন। কাল গড়িয়ে গেছে অনেক। বাবা হয়েছেন গত। কিশোর হয়েছে যুবক । সব কিছু শিথিল হতে হতে আজ যৌবনের সম্ভারে যুক্ত হয়েছে রকমারি বিষয়াদি।।

এখানে আসার পর ছুটির দিন গুলোতে আযানের সমর্থনে একটু একটু করে জামাতে গিয়ে দাঁড়াই। ইমাম সাহেবের কেরাত খুবই সুললিত। মনে গেঁথে যায়। সেই টানে ‘নিয়মিত’ হতে চেষ্টা করছি। বিশেষত ছুটির দিন গুলোতে। মনের ভেতর অস্বস্তি থাকলে মানুষ নিষ্কৃতির পথ খুঁজে। কেউ নেশায় সমাধান পথ বেছে নেয়। কেউ নিজেকে হনন করে, আর কেউ সন্ন্যাস পথে। এর কোন পথই আমাকে টানেনা।

আম্মার জন্য মন পোড়ে। জন্মেছি ঢাকায়। সে অবধি আম্মার সাথেই থেকেছি বরাবর। এক নাগাড়ে এত দিনের জন্য ঢাকা ছাড়িনি এর আগে কোনদিন। ছোট বোনটা বাসায়। আছে খালাও। বোনের হাসবেন্ড সেলিমের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে বাসায় অশান্তি। আমি দুশ্চিন্তায়। সেই দুশ্চিন্তা চরমে গিয়ে পৌছলো সেদিন, যেদিন বাসায় দুই পাওনাদার এসে হাজির। আম্মার প্রেসার চরমে। বোন বিলাপে। নীচে পাওনাদারদের উচ্চস্বরে হৈ চৈ, হুংকার। তারা থানায় মামলা করার হুমকি দিয়ে গেছে। খালা ঘন ঘন ফোন দিয়ে ঢাকা যেতে বলছে। বড় মামা থানা-পুলিশের বিষয়টা দেখছেন। এ সময়ে আম্মার কাছে আমার থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ছুটি চাই কি করে? মাথায় এলো জামান ভাইকে বলে দেখা যেতে পারে। কাজও হলো। বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মস্থল ত্যাগের অনুমতি মিলেছে।

নাইট কোচে রওনা দিয়ে যখন বাসায় গিয়ে পৌছলাম তখন খুব ভোর। আম্মাকে পেলাম কোরআন তেলওয়াতরত। খালা রান্নাঘরে। বোনের রুম লকড। তবে বাসায় নতুন অতিথির আগমন হয়েছে। আম্মা ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললো,“সরাফত এসেছে। অতএব সাবধান”। সরাফত আব্বার দূরসম্পর্কের চাচাত ভাই। অতিশয় বৈষয়িক ও কথাকে ইচ্ছেমত মাল্টি চ্যানেলে সম্প্রচারে চ্যাম্পিয়ন। তাকে দেখলেই আমার কেন জানি বিটিভি নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রয়াত ফখরুল হাসান বৈরাগীর কথা মনে হয়। দেখতে অবিকল তারই মত। আচার-আচরণ ও কথাবার্তাতেও। আমি নিজের মনকে শাসন করলাম এই বলে যে, এমন ভাব করতে হবে যেন কোথাও কিচ্ছু হয়নি। সব কিছুই আগের মত চলছে। ওয়াশরুমে যাওয়ার মুখে তার সাথে দেখা। দেখা না, বলা ভাল তিনি দেখা দিলেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন,“ভাতিজা, তুমি নাকি অনেক টাকার চাকরি পাইছো”? আমি প্রমাদ গুনলাম। এর উত্তরে কি বলি আর উনি কি থেকে কি তর্জমা করেন কে জানে? বললাম,“চাচা, সারা রাত জার্নি করে এই এলাম। আপনি নাস্তা-টাস্তা করেন। পরে কথা হবে”। ভেবেছিলাম এতে সাময়িক মুক্তি পাবো। কিন্তু মাথা নেড়ে বললেন,“তা ঠিক। তবে আমারও তাড়া আছে। হাই কোর্টে যাইতে হবো। বরং দুইজনেই নাস্তা করি আর জরুরি কিছু কথা আছে, সেগুলি সারি। এই সাংসারিক আরকি”। আমার প্ল্যান ভস্মীভূত হয়ে গেলো। বললাম, “আইচ্ছা”।
ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আম্মার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,“উনি কেন এসেছেন”? আম্মার উত্তর, “কেন আবার? টাকা চাইতে। ক্ষেত কিনবে”।
–টাকা কি গাছের গোটা? চাইলেই হলো? আমার উত্তর।
— সেটা তো আর সে বুঝবে না।
— ব্যস। এই টাকা চাইতেই এসেছেন?
— আরো একটা উছিলা আছে
— কি?
— তোর বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে। গ্রামের মেম্বরের একমাত্র মেয়ে। জমিজমা প্রচুর। ইন্টার পড়ছে।
আমার মাথায় রক্তের স্ফুটনাঙ্ক উচ্চ স্কেলে গিয়ে অনবরত বাড়ি মারছে। গত রাত্রে এসেছেন। টাকা পেলেই চলে যাবেন। বাসার সাম্প্রতিক খবরাখবর এখনো জানতে পারেন নি। তবে ছুটাবুয়া এলেই জেনে যাবেন নিশ্চিত । তবে ভাগ্য ভাল যে, আম্মা তাকে আজকে আসতে বারণ করেছে।
সেই সরাফত চাচার সাথে খাবার টেবিলে আলাপ। আমার উদ্দেশ্য নাস্তা করিয়ে বিদায় করা। বললাম, “আজই চলে যাবেন”?
— মনে হয় সেটা হবে না। তবে তাড়াতাড়ি যাওয়াই দরকার। বাড়ীতে আমার অনেক কাজ।
— ঢাকায় কি কাজে এসেছেন?
— আমাদের গ্রামের কাসেম মাস্টারের পোলার হাইকোর্টের মামলার খোঁজ নিতে
— আপনি কেন? তারা খোঁজ নিতে পারেনা? শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট দেয়।
— আরে ওরা কি লাইন ঘাট এত বুঝে?
— আপনি বুঝেন?
— আল্লাহর রহমতে গাও গেরামে এই বিষয়ে আমার নাম আছে।
— আর কোন কাজ?
— আছে। সেটা ভাবীরে কইছি। তুমি চাকরি পাইছো শুনলাম। বিদেশি অফিস। মনে হয় ট্যাকা পয়সা ভালই পাও।

আমি গরম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেললাম। বিরক্তি চেপে বললাম, “চাচা, আমি টায়ার্ড। এখন ঘুমাবো”। এতে তিনি যেন বিস্মিত হলেন। চা খেয়ে কেউ ঘুমায় নাকি? তাই তো। আমি তাড়াতাড়ি আমার রুমে গিয়ে দরোজা লক করে দিলাম। এ যেন ফাঁসির আসামীর মত কনডেম সেলে নিজেকে বন্দী করে রাখা।

চলবে…