আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৫)

Photo of author

By Anwar Hakim

  • আজিমপুর টু উত্তরা
  • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
  • আনোয়ার হাকিম।

(৫)
রাজউক অফিসে এসেছি। এক আত্মীয়ের পূর্বাচল প্লটের রেজিস্ট্রেশন কাজে। অফিস আদালতের কাজে আমার বড়ই বিরক্তি। সরকারি অফিস হলে তো আরো। এখানে সব অদ্ভুতুড়ে কায়কারবার হয়। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। সেবা আছে, পাওয়া যায় না। আবার লাইন ঘাট, চেনা-জানা থাকলে মিলে যায় সহজে। এখানে কর্তাব্যক্তি থেকে নীচের পিওন পর্যন্ত সবাই যেন কেমন মন মরা, ম্যাড়মেড়ে। কথা বললে শুনে কি শুনে না, বুঝে কি বুঝে না জাতীয় ভাব নেয়। কোন পেপার বা ডকুমেন্ট দেখালে দেখতে পায় কিনা তাও বুঝিনা। অথচ শক্তিশালী কারো রেফারেন্স নিয়ে গেলে বা সিন্ডিকেটের হাত ধরে গেলে এসি রুমে অপত্যস্নেহে বসিয়ে পই পই করে সব কিছু বললে শুনে আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দেখালে গুরুত্ব দিয়ে দেখে। আর যদি কেবলাকান্ত’র মত একাকী যান তাহলে মধুমক্ষিকাদের কবলে পড়তে হবে। অনুযোগ করবেন? নথী গায়েব হয়ে যাবে। নয়ত রাজধানীর ক্যাবল জটের মত আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারবেন না। এমন প্যাচ কষবে যেন মনে হবে এর চেয়ে ছোটবেলার তৈলাক্ত বাঁশে বানরের আরোহন-অবরোহন অংকই অনেক সহজ ছিলো। তাই পারতপক্ষে সরকারি অফিসে যাইনা। যেতে চাইনা। তৌহিদ সেক্ষেত্রে হরফুন মাওলা, সকল কাজের কাজী। তাকে ফোন দিয়ে নিয়ে এসেছি উদ্ধার করার জন্য।

কাজ শেষে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। রাজউক ভবনের পাশের গলিতে নিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অল্প তেলে ভাজা গরম গরম পরোটা আর ডাবল ডিম মামলেট দিয়ে করা দেশজ রোল খেতে খেতে আলাপ জমে উঠলো। হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলো, “সেই মহিলাটা কে? কি করে? কদ্দিন চলছে”? মুখে দেওয়া খন্ডিত রোল গলায় আটকে গেল। গলা শুকিয়ে গেছে। রোল আর নামছেও না, বেরও হচ্ছেনা। পানি খেলাম। বললাম, “আরে না। ওরকম না। সে তো ম্যারিড। তার এক কিউটিও আছে”। “ডিভোর্সি”? তৌহিদের পাল্টা প্রশ্ন। আমার খাওয়ার ইচ্ছে শেষ। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। অসহায়ের মত সরল স্বীকারোক্তি দিলাম, “ না”। ততোধিক বিস্ময় নিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “তাহলে কেমনে কি? এর পরিণতি কি”? আমার অস্বস্তি লাগছে। বললাম, “জানিনা। লিভ ইট”। তৌহিদ স্বগতোক্তির মত অস্ফুটস্বরে বললো, “পরকীয়া”? শব্দটা কানে যতটা বাজলো তার চেয়ে গুনিতক হারে হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা মারলো। লজ্জায়, শংকায়, অপমানবোধে সব কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন লাগছে। তৌহিদকে বিদায় দিয়ে যতই এগোচ্ছি ততই একটা শব্দ ‘ইকো’ হতে থাকলো। তা হলো পরকীয়া।

বাসায় ফিরে গুগলে সার্চ দিলাম। পরকীয়া মানে কি? তেমন কনভিন্সিং কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। যা পাওয়া গেল তাহলো, স্বামী বা স্ত্রী অন্য কারো সাথে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে দোষী সাব্যস্ত হবে। ব্যভিচারী বলে গণ্য হবে। আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম, আমাদের সম্পর্ক এই সংজ্ঞায় পড়ে না। কিন্তু মাথায় অনেক প্রশ্নের উদয় হলো। পরকীয়া তাহলে কি? কারা এর পর্যায়ভুক্ত? কেবলই বিবাহিত পুরুষ আর বিবাহিতা নারীরাই এর আওতাধীন? যদি তাই হয় তবে আমাদের সম্পর্ক সে পর্যায়েও পড়ে না। পরক্ষণেই জানার আগ্রহ আরো বাড়লো। একজন বিবাহিত আর অপরজন অবিবাহিত হলে কি তাদের সম্পর্ক ‘পরকীয়া’ বলে গণ্য হবে? এ বিষয়ে কোন সদুত্তর পাওয়া গেলনা। মন আরো জিজ্ঞাসু হয়ে উঠলো। তাহলে কি পরকীয়ার জন্য বিবাহিত হওয়া আর যৌন সম্পর্ক স্থাপন আবশ্যকীয় শর্ত? যদি তাই হয় তাহলে দু’জন বিবাহিতের বিবাহ বহির্ভূত অথচ যৌনতা মুক্ত সম্পর্ককে কি পরকীয়া বলা যাবে? আচ্ছা, এর কারণইবা কি? এর কারণ শুধুই কি মনস্তাত্ত্বিক নাকি দৈহিকও? নাকি উভয়ই? এর উপকারিতাই বা কি? এর উপকারিতা ততক্ষনই বেশুমার আনন্দময় থাকে যতক্ষণ তা অনুকূল আবহাওয়ায় থাকে। তাহলে এর অপকারিতা কি? এর অপকারিতা অপরিসীম। কপাল মন্দ হলে প্রতিকূলতায় এর পরিণতি মৃত্যু অবধি সম্প্রসারিত। নিদেন পক্ষে লাঞ্চনা-গঞ্জনা, জেল আর ডিভোর্স অতি স্বাভাবিক। অনেকটা দু’কুল হারাবার মত। নীতির মানে তা অনৈতিক। সামাজিক মানদন্ডে গর্হিত। ধর্মীয় ফয়সালায় ইহকাল চৌচির আর পরকালের ডেস্টিনেশন হাবিয়াময়। মাথা আউলিয়ে গেলো। তাহলে মোটের উপর দাঁড়ালো কি? যাই দাঁড়াক আমি এর মধ্যে পড়িনা। তৌহিদকে ফোন দিতে গিয়েও দিলাম না। একটা জায়গায় গিয়ে আটকে গেলাম। জেমি বিবাহিতা। পরক্ষণেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই ভেবে যে এত অংক কষে আর যা হোক প্রেম-ভালোবাসা হয় না।

দুপুর থেকেই মনটা বিষন্ন। শুয়ে শুয়ে ভাবছি অনেক কিছু। পুরনো দিনের। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই বছর। ভালবেসে যাকে বিয়ে করেছে সে একটা জিনিস বটে। যত সব উদ্ভট আর মেগা মেগা চিন্তা তার। কাজের বেলায় বিরাট অশ্ব ডিম্ব। এই ধরনের ছেলেদের আমি ছাত্রাবস্থা থেকেই অপছন্দ করতাম। পকেটে নাই দুই টাকা অথচ গপ সপ লক্ষ টাকার। মানুষও এদের কথায় বিমোহিত হয়। নিজে যেমন অলীক স্বপ্ন দেখে তেমনি তার চারপাশ ঘিড়ে থাকা লোকজনকেও দেখিয়ে ছাড়ে। বলা নেই কওয়া নেই, বাসার চাল চুলোর খবর নেই হঠাৎ করেই একদিন পুরোনো এক কার নিয়ে হাজির। তার শ্বাশুড়িকে দেখাতে। আমাকে বলেনি। জানে, এগুলো আমার মোটেই পছন্দ না। শ্বাশুড়িকে সারপ্রাইজ দিয়ে জামাই হিসেবে তার উপযুক্ততা প্রমানের এই প্রয়াস হাস্যকর সন্দেহ নাই। কিন্তু জীবন যাপন প্রণালীর ভবিষ্যত হিসেবে আশংকার বটে। সেই কার নিয়ে সে বোনকে সাথে করে ঘুড়বে আর বন্ধুদের সাথে ফুটানী করে বেড়াবে এটাই তার মিশন, ভিশন। অদ্ভুত। গাড়ীর জ্বালানী কোত্থেকে আসবে? এর উত্তর নাই। যোগানের ব্যবস্থাও নেই। তার উপর আরেকজনের গছিয়ে দেওয়া সেই পুরোনো গাড়ী এক কিলো যেতে তিন বার বন্ধ হয়ে যায়। আজ তার টায়ার পাংচার তো কাল লাইট জ্বলেনা। পরশু হর্নে সমস্যা। তরশু ব্রেক সু প্রবলেম। বোন দুয়েকবার তার সাথে গাড়ী চড়ে ঘুড়তে গিয়ে এই বিড়ম্বনায় পড়ে আর উঠেনা। বাসায় এই নিয়ে থমথমে পরিবেশ। আম্মা পড়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে জামাই বলে কথা। হোক তা ‘না পছন্দ’। অন্যদিকে নিজের মেয়ে ও তার সংসার।

হঠাৎ একদিন শুনি সেই গাড়ী অর্ধেক দামে বিক্রী করে দিয়েছে। ভাবলাম সুমতি হয়েছে। অন্তত দুঃশ্চিন্তা থেকে তো বাঁচা গেলো। কিছুদিন যেতেই দেখি বাসায় চিল্লাচিল্লি। বোনের। আম্মা থেকে থেকে চোখ মুছছে আর বোনকে বলছে, “আমার হয়েছে জ্বালা। হুট করে বিয়ে করে বসলি এই ছেলেকে। কতবার বললাম এর চাল চুলো ঠিক নেই। এখন বুঝ”। আমার ঘুমে যথেষ্ট ব্যাঘাত হচ্ছিলো। ভাবলাম নিত্যকার টপিক একটু পরেই থেমে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই কান গরম হয়ে গেলো, “আর একটা পোলা খালি ঘুমায়। চাকরি বাকরির খবর নাই। ইচ্ছাও নাই। খায় দায় আর বাবুগিরি করে বেড়ায়’। এ পর্যন্ত তবু মেনে নেওয়া যায়। ঠিকই তো বলেছে। কিন্তু পরের কথাটা ধক করে বুকে সুই ফোঁটালো, “ আমারে বিধবা করে তুমি কই রেখে গেলা”? আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। রুম থেকে বের হয়ে এলাম। আম্মাকে বললাম, “কি হয়েছে আম্মা? এ আর অমন নতুন কি? সেলিম তো এরকমই। তোমার মেয়েই তো গোঁ ধরে এই বিয়ে করেছে। আমি তো তখনই বলেছিলাম এই বিয়েতে আমার মত নেই। এখন পস্তাচ্ছো কেন”? এই কথা বলা শেষ আর পাশের রুম থেকে বোনের বিলাপ শুরু, “বাবা তুমি আমারে কই রেখে গেলা? আমার তো কেউ নাই”। বোনের এই বিলাপে মেজাজ শূন্য ডিগ্রীতে নামিয়ে আনলাম। বোনের কান্না সহ্য হয়না। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে চাইনি। আম্মার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কি হয়েছে বলো তো”। আম্মার কথা শুনে চক্ষু চড়কগাছ। বোনের হাসবেন্ড মানে সেলিম লাখ পাঁচেক টাকা তার এক বন্ধুকে দিয়েছিল যৌথ ভাবে গার্মেন্টসের স্টক লটের ব্যবসা করবে বলে। এর মধ্যে আম্মার দুই আর বোনের দুই। বাকী টাকা সেলিমের গাড়ী বিক্রির। সেই বন্ধু স্টক লট ব্যবসা শুরু করার আগেই স্টপ করে সোজা মালয়েশিয়ায় চলে গেছে কাউকে না জানিয়ে। এর আগেও আম্মার কাছ থেকে নিয়েছে তিন লাখ আর বোনের বিয়ের গয়না বিক্রি করে নিয়েছে তিন লাখ। আমি জানিনা। এই টাকা ই-ভ্যালিতে খাটিয়েছে। সেটাও খোয়া গেছে।

পরিস্থিতি ভয়াবহ। সান্ধ্য আইন জারী করেও লাভ নেই। প্রলাপ-বিলাপের এই হৃদয় বিদারক পরিবেশ কবে কোথায় গিয়ে শেষ হয় কে জানে? আম্মাকে বললাম, “এতগুলা টাকা ওরে দিলা আমারে একবারও বললা না”? আম্মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “বললে কি তুই দিতে দিতি? তাছাড়া জামাই আর মেয়ে দু’জনেই বারণ করেছিলো”। “অবশ্যই না করতাম” মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। আম্মাও বললো, “নিজের একটা মেয়ে হলে তখন বুঝবি”। আমি থ মেরে গেলাম।

প্রতিটি ফ্যামিলিতে এরকম একটা না একটা ‘ইন্দ্রনাথ’ টাইপের অবিমৃষ্যকারী থাকে। পুরো পরিবার এই হিডেন ডিনেমাইট নিয়েই প্রতিটি দিন গোজরান করে, কখন সেটা ফেটে সব কিছু চৌচির করে দেবে এই আতংকে। এই প্রথম মনে হলো, ফ্যামিলির জন্য কিছু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর ফলশ্রুতিতেই এই দুই টিউশনি।

সেলিমের মত এই ধরণের উচ্ছন্ন প্রকৃতির ছেলেদের সাংঘাতিক রকমের কারিশমা দেখে আশ্চর্য্য না হয়ে পারিনা। ওয়ান টুয়ের মধ্যে যে কাউকে যাদুবশ করে ফেলতে পারে। যাদের কাছে সে ধরা খায় তারা কাছের লোক। আবার যাদেরকে সে ধরা খাইয়ে দেয় তারাও তার কাছের লোক। ঘটনাগুলো পুনঃ পুনঃ ঘটে কিন্তু বিস্ফোরণ হয়না। আজ তার প্রতি বড় রাগ হচ্ছে। “সে কোথায়” বোনকে জিজ্ঞেস করলাম। জানা গেলো, সে লাপাত্তা। কোত্থেকে যেন ফোন করে জানিয়েছে তাকে খুঁজে লাভ নেই। সামর্থবান না হওয়া পর্যন্ত সে আর তার সামনে আসবেনা।

মানুষ বেশি বিপদে পড়লে বলে ত্রিশংকু অবস্থায় পড়েছে। আমার হয়েছে সেই দশা। আম্মার ঘরে যাই। আম্মা শুয়ে আছে। শান্তণা দেই। যদিও জানি ছেলে ভোলানোর মত শোনাচ্ছে। এর ইমিডিয়েট কোন দাওয়াই নেই। বোনের কাছে যাই। আজকাল অল্পতেই মানুষজন সুইসাইড করে বসে। আত্মা ধক করে উঠলো। আল্লাহ না করুন এমন কিছু করে বসে। তার অবস্থা ভয়াবহ। কথা বলেনা। বলে, “ওরে আমার কাছে ধরে আনো”। আমিও কৌশূলী না হয়ে বলে ফেললাম, “এনে দিলে কি করবি? তুই-ই তো সবাইকে অশান্ত করে জোর করে এই বিয়ে করেছিস। এখন বুঝ”। কথা মাটিতেও পড়তে পারেনি। তার উচ্চ বিলাপে বাসা মুখর। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন হয়ত লজ্জায় এখনো দরোজায় টোকা দিচ্ছেনা। আমি সরে পড়লাম। আম্মা উঠে এসে আমাকে মৃদু বকা দিলো। বললো, “পারলে খোঁজ নিয়ে দেখ হতচ্ছাড়াটা কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে”। সেদিনের পর থেকে সেলিমকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ।

এদিকে জেমিকে নিয়ে আমিও প্যারার মধ্যে আছি। আম্মাকেও রেখেছি। বাতের ব্যাথাটা খুব ভোগাচ্ছে তাকে। সারাদিন গরম পানির ছ্যাঁক দেয় আর তেল জাতীয় কি যেন মালিশ করে। এ অবস্থায় খাগড়াছড়ি যেতে মন চাচ্ছেনা।

চলবে…