আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৪)

Photo of author

By Anwar Hakim

  • আজিমপুর টু উত্তরা
  • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
  • আনোয়ার হাকিম।

(৪)
টিউশনি শেষে বই খাতা গুছাতে গুছাতে ইলমা আচমকা আবদার করে বসে, “স্যার, আপনার সাথে কাল বিকেলে রিক্সা করে ঘুড়বো”। আমি থ। বুঝে উঠতে পারিনি। বললাম, “ না, না। তা কিভাবে সম্ভব”? ইলমা পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো, “ কেন, স্যার? ঘুরলে কি হয়”?
— অসুবিধে আছে। তাছাড়া তোমাদের বাসা থেকে এটা এলাউ করবেনা।
— বাসার কাউকে বলবো না তাহলে।
— সে কি করে হবে? আর এটা হয়না।
— কেন, আপু রাগ করবে?
— মানে?
— মানে, আপুকে ভয় পান? ইলমা হাসলো। সে হাসির রহস্যভেদ করা গেলনা। আমি প্রসঙ্গান্তর করার চেষ্টা করলাম। ইলমা মুখ কালো করে বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো। তবে কি ইলমা আমাদের সম্পর্কের কিছু আঁচ করতে পেরেছে? কিছুটা লজ্জায় আর ততোধিক অজানা আশংকায় নিরবে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

বাসায় পাত্রী দেখার ধুম পড়ে গেছে। শেষতক একজনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। বড় মামার এক জুনিয়র কলিগের একমাত্র সন্তান। বিদেশী ব্যাংকে চাকরি করে। ধানমন্ডি আর বনানীতে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং আর মার্কেট আছে। বড় মামার প্রেসক্রিপশন, আমার চিত্ত বৈকল্য হয়েছে। আমি ডিট্র্যাক্ট হয়ে গেছি। বিয়ে দিয়ে দিলেই প্রবলেম সলভ। সেই মেয়েই নাকে রশি বেঁধে ট্র্যাকে উঠিয়ে নেবে। ‘বিজনেস’ ভুত মাথা থেকে পালাবে। তাঁর এই প্রেসক্রিপশন আম্মার মনমত হয়েছে। তাই কয়েক দিন যাবত তাকে ফুরফুরে লাগছে।

বিসিএস না হোক ছেলের সুমতি হয়েছে। জীবিকার ভাল একটা রাস্তা তো হয়েছে। তাঁর কথা মত কাজ হয়েছে- সেই উত্তাপ নিয়ে বড় মামা আবার এলেন। কেন এলেন? সেলিব্রেট করতে? মোটেই না। আম্মা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে চাকরি তো হলো। এখন যদি সেই কিউটি সহ মহিলাকে বিয়ে করে বসি? মামা এসেই ওযু করে জোহরের নামায আদায় করলেন। লাঞ্চ করলেন একটু। বক বক করলেন অনেক। বললেন, “চাকরি হয়েছে ভাল। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন। সেলারি, ফ্যাসিলিটিজ, প্রসপেক্ট সবই ভাল। প্লেস অফ পোস্টিং ইজ ফার এওয়ে ফ্রম ঢাকা বাট নট দেট মাচ ব্যাড”। এই পর্যন্ত ভালই লাগছিলো। এরপর শুরু হলো, “ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন নাইনটি ওয়ান, হোয়েন আই ওয়াজ পোস্টেড ইন পানছড়ি –” । কান দিয়ে শুনছি আর বের করে দিচ্ছি। হঠাৎই এলো বিয়ে প্রসঙ্গ। পাত্রী ঠিক করা আছে। আগামী শীতে ডেট ফিক্স করে অনুষ্ঠান করা যাবে। এর আগে অন্য কোন চিন্তা মাথায় আনা যাবেনা। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। রক্ত বিদ্রোহ করতে চাচ্ছে। বুকের গভীরে হঠাৎ মোচড় মেরে উঠলো। মুহুর্তেই জেমির মুখটা ভেসে উঠলো । আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে রুমে গিয়ে লক করে দিলাম। বুকের ঠিক মাঝখানে বিষ বাষ্প জমাট বেধে আছে। নিঃশ্বাস ঠিক মত নিতেও পারছিনা। প্রশ্বাসেও স্বস্তি পাচ্ছিনা। ঘরে মন বসছেনা। মুহুর্তেই চেনা পৃথিবীটাকে খুব অচেনা আর খুব রুক্ষ বলে মনে হলো।
আমার ‘অস্বস্তি’ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অবশেষে জেমির সাথে কথা হয় ফোনে। বললো, কি যেন জরুরি কথা আছে। দেখা করে বলবে। স্থির হলো, কিউটিকে যেদিন ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে সে দিন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। তার মা সাথে যাবে তাই। ইলমা’র কথা জেমিকে জানালাম। সে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “ লিভ ইট। এই নিয়ে বাসায় অনেক অশান্তি চলছে। আমি আর নিতে পারছিনা”।

ইতোমধ্যে দু’টো টিউশনই আমি ছেড়ে দিয়েছি। আরো স্পষ্ট করে বললে ছাড়তে হয়েছে। কারণ দ্বিবিধ। এক, জেমিকে নিয়ে যে প্রায়ই রিক্সায় ঘোরাঘুরি করি ইলমা তা দেখেছে ও তার মা-কে জানিয়েও দিয়েছে । একদিন পড়া শেষে আচমকা বলেই ফেললো, “আপুকে নিয়ে তো ঠিকই রিক্সায় ঘুরেন। আপু কিন্তু ম্যারিড”। আমি হতবাক। জেমিও সেদিন আর দেখা দেয়নি। বাসায় না বাইরে বুঝতে পারিনি। আর দ্বিতীয় কারন হলো, বুয়েটের ব্যাকগ্রাউন্ড আর রেজাল্ট ভাল থাকায় এক বন্ধুর কল্যাণে ইউ এন ডি পি’র এক প্রজেক্টে ভাল একটা চাকরি পেয়ে গেছি। কর্মস্থল খাগড়াছড়ি।

প্রিয় রাজধানী ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে থাকতে হবে। যদিও পাহাড় আমার খুব প্রিয়। তবু মন সায় দিচ্ছেনা। কেন? প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে যেতে হবে, তাই? মুহুর্তেই জেমি’র মুখটা ভেসে উঠলো। মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। অনুকূল পরিবেশে পেখম মেলে। আর প্রতিকূল পরিবেশে শামুকের মত গুটিয়ে থাকে। সব কিছু ঠিক ঠাক। আগামী পরশু লাগেজ সমেত খাগড়াছড়ি যাবো। মনে হচ্ছে কারা যেন জোর করে আমাকে বোচকাসহ আর্মি লরীতে উঠিয়ে দিচ্ছে অজানা পথে। জেমির সাথে দেখা করতে মন চাইছে। কিন্তু এটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পরে যাবে কিনা ভাবছি। ছাত্রীর কুশলাদি জানার ছুতোয় যাওয়া যায়। তাতে রথ দেখা আর কলা বেচা দু’টোই হবে। পরক্ষণেই মুখোমুখি ধরা পড়ার লজ্জায় পেয়ে বসলো। লক্ষ্য করেছি আজ বেশ ক’দিন যাবত জেমির ফোন বন্ধ। ফেবু আইডি ডিএক্টিভ। ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রামে তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। কোন বিপদ হয়নি তো?

মানুষের মন বড় বেশি সেনসিটিভ। অযত্নে কুঁকড়ে যায়। অবহেলায় অভিমানী হয়। প্রত্যাখানে হয় বিধ্বংসী । আর আলাপনে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তা কেউ টেরই পায়না। এই দহন জ্বালা ক্রমান্বয়ে যেন বাড়ছেই। স্মৃতিরা বড় বেশি ক্ষুরধার। ঘাপটি মেরে থাকা সুখময় স্মৃতিরা অসময়ে পেখম মেলে ধরে। জেমিকে নিয়ে অমল ধবল সেই সব স্মৃতিকে চেপে রাখা যায়না।

এত কিছুর মাঝে একটা ভাল খবরও আছে। বড় মামার সিলেক্ট করা পাত্রী ভেটো দিয়ে বসেছে। তাঁর ও আম্মার সন্দেহ এটা আমার চাল । তাদের মুখ কালো। চোখে গভীর সন্দেহ। মাথায় যে গভীর শংকা সে আমি বুঝতে পারি। ক’দিন যাবত বাসার পরিবেশ বেশ শান্ত। কোথাও কোন চিল্লাচিল্লি নেই। বেলা বারোটা বাজলেও ঘুমের ব্যাঘাত আর ঘটেনা। সেই বকাবাদ্যও নেই। আম্মার জন্য মনটা সিক্ত হয়ে উঠলো। জানি জেমি প্রসঙ্গ মাথা থেকে নামিয়ে ফেললেই আবার সব কিছু আগের মত হৈ চৈ মুখর হয়ে উঠবে। নাস্তার টেবিলে আম্মা এসে বসলো। খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি কিছু বলতে চাচ্ছে। বললাম, “ কিছু বলবা”? দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, “বাবা, তোর বাবা নেই আজ কত বছর হলো। কোনদিন কোন কিছু নিয়ে এত টেনশন হয়নি। আজকাল হচ্ছে” ।
— হঠাৎ আজকাল আবার কি হলো? আমার প্রশ্ন।
— কি জানি বাবা? আজকাল সবসময় মনে কু ডাক শুনি। আর দুঃস্বপ্ন দেখি
— ওগুলো তোমার নিছক দুঃশ্চিন্তা। মাথায় নিও না। শুধু শুধু প্রেসার বাড়বে।
আম্মা কি যেন বুঝলো। হয়ত ভেবে নিয়েছে আমি ট্র্যাকে এসে গেছি। ঘন করে দুধ চা এনে দিলো। আমার খুব মায়া হলো।

চলবে…