- আজিমপুর টু উত্তরা
- ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
- আনোয়ার হাকিম।
(৩)
অনেক ঘোরাঘুরির পর জেমিদের কাজটা অবশেষে হয়ে গেছে। এই অছিলায় জেমির সাথে ঘোরাঘুরিও হয়েছে বেশ। সিটি কর্পোরেশনের পেপারস গুলো প্রকিওর করে জেমির হাতে দিতেই উষ্ণ অভিবাদন পেলাম,“ থ্যাংকস। এই তো দায়িত্ববান হতে শিখছো”। এর দ্বারা জেমি কি বুঝাতে চাইলো বুজে উঠতে পারলাম না। বললাম, “ কেন?”
— বাহ। যেচে দায়িত্ব নিলে। মানে দায়িত্ব নেওয়ার ছুতো করে মোবাইল নম্বর নিলে।
— হুম্ম
— হুম্ম কি?
— কিচ্ছু না
— আজকাল দেখা না করেই ছাত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছো যে
— ভাবছি কাল থেকে আর সেটাও করবো না
— মানে কি?
— টিউশনি ফিউশনি ভাল লাগছেনা
— কি ভাল লাগে?
— কিচ্ছু না
— মেয়েদের মোবাইল নম্বর নিতে ভাল লাগে?
— সেটা ছিল মারাত্মক ভুল
— ভুল কেন? কাজের জন্যই তো নিয়েছিলে। অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল নাকি?
— বললাম তো ভুল হয়ে গেছে
— মোটেই না
— কেন?
— একদিন না একদিন আমিও তোমার নম্বরটা নিতাম
— কেন?
— তোমার মত ভুল করে। কাজের বাহানায়
— লাভ কি?
— ক্ষতিই বা কি?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। সব প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়াও যায়না। লাভ ক্ষতির হিসেব চুলোয় যাক। এর পর থেকে জেমির সাথে ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছে। সিটি কর্পোরেশনের কাজের উসিলায় ছুতোনাতা করে বাসা থেকে বেরিয়ে পরাই এখন জেমির রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাহন হিসেবে রিক্সাতেই আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে ফিক্স হতে প্রথমে জড়তা থাকলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দিনে দিনে জেমি আরো জেম হয়ে উঠছে। চেহারায় রোশনাই বেড়েছে। এমনিতেই সে বেশ সুন্দর। প্রেমেতে জড়ালে মেয়েরা নাকি উর্বশী, অপ্সরা, মেনকা হয়ে উঠে। তার সান্নিধ্য এক সময় অধরা মনে হলেও এখন তা অতি বাস্তব। আমাদের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকলেও অজানা কোথায় যে ভেসে যাচ্ছি এক সাথে সেটা বুঝতে পারছি ঠিকই। সম্পর্ক গাঢ় হলে কোত্থেকে যেন ‘কুচ পরোয়া নেহি’ জাতীয় সাহসও ভর করে।
একদিন দুপুরে ফোন এলো। জেমির। পাঁচটায় আলিয়ঁস ফ্রসেজ এর সামনে থাকতে হবে। ফ্রেঞ্চ ফেস্টিভেল চলছে সেখানে। আজ দু’টো ফ্রেঞ্চ শর্ট ফিল্ম দেখাবে। জেমি সেখানকার মেম্বার। বেশ খানিকটা আগেই সেখানে গিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। চারিদিক আলোকিত করে, বাতাসে সুগন্ধি ছড়িয়ে দীপিকা পাডুকোন এসে হাজির হলেন। আজ তার পড়নে নীল সাদা কম্বিনেশন কামিজ। একই রংয়ের মাস্ক। সাথে ম্যাচিং ওড়না। গলায় পেচানো। মেয়েদের এই বিষয়টা দেখার মত। কি বিবাহিত, কি অবিবাহিত সবারই এক স্টাইল। ম্যাচিং। বেছে বেছে ঠিকই যোগাড় করে নেয় সব। নীচ তলার ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। কফির অর্ডার হলো। সাথে স্যান্ডউইচ। বুঝলাম জেমি সেখানে পরিচিত। খানিকক্ষণ হাই হ্যালো করলো অনেকের সাথে। আমি এর আগে এখানে আসিনি। তাই জড়তা বোধ হচ্ছে। “আন ইজি লাগছে”? জেমির কথায় সোজা হয়ে বসলাম। “ভীতুর ডিম” বলে স্যান্ডউইচের দিকে ইশারা করে বললো, “এই সাহস নিয়ে প্রেম করবা কেমনে”? জেমি চোখ টিপে হাসলো। হয়ত মজাই পেল। আমি আরো কূঁকড়ে গেলাম। ছ’টায় শুরু হলো সেই কাংখিত শর্ট ফিল্ম। একেকটি চল্লিশ মিনিট করে। মাঝে দশ মিনিটের শর্ট ব্রেক। দু’টো ফিল্মই লাভ স্টোরি বেইজড। সাব টাইটেল ইংরেজীতে। আমি আবার সাব টাইটেল ফলো করতে পারিনা। ফলো করতে গেলে অনেক সীন মিস হয়ে যায়। বেশ কিছু একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত আছে তাতে। হল রুম অন্ধকার। অন্য যুগলরা কি করছে জানিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শো শেষে জেমির দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। বের হয়ে ধানমন্ডি লেকের দিকে যাচ্ছি। জেমিই নিরবতা ভাঙ্গলো, “ভালো লাগেনি”?
— হুম্ম। মাথা নাড়লাম।
— তাতো বুঝতেই পারছি। গুডি বয় ।
এর দ্বারা সে কি মিন করলো বুঝতে পারিনি। হঠাৎই ডান হাতটা চেপে ধরে বললো, “দেখি পালস কত”? আমি বাধা দিলেও কাজ হয়নি। বললো, “সেকি! হার্ট এটাক হবে তো মনে হচ্ছে”। পরক্ষণেই বললো,”নো প্রবলেম। এভরি থিং উইল বি ওকে ইন ডিউ কোর্স অফ টাইম”। আমি নির্বাক।
আরেকদিনের কথা মনে পড়ছে। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে গেলাম দু’জনে। লোক শিল্পের মেলা হচ্ছে। সেটা একটা উছিলা মাত্র। ঘুরে ঘুরে দেখছি আর কথা বলছি। এমন সময় হঠাৎই তৌহিদের আবির্ভাব। আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও এতটাই সামনাসামনি যে পার পাওয়া গেল না। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, “আমার ফ্রেন্ড। প্রাইভেট ফার্মে আছে”। এরপরেই আটকে গেলাম। হুট করেই জেমি বলে বসলো, “আর আমার পরিচয় ”? বিব্রত করার জন্য এই এক মিশাইলই যথেষ্ট। বললাম, “ ও হ্যা, তাইতো। ইনি আমার ছাত্রীর বড় বোন। আমাদের নেইবার”। কথাগুলো বলে নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। সব জায়গায় সব সময় সত্য কথন ঠিক না। তা অজস্র সম্পূরক প্রশ্নের জন্ম দেয়। মনে মনে উপলব্ধি করলাম আজ কপালে খারাপী আছে। তৌহিদ ছেড়ে দেবেনা। একান্তে দেখা হলে এর নাড়ি নক্ষত্র বের করে ছাড়বে। আর জেমির ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র তো তাক করা আছেই। যাহোক, জাদুঘর প্রাঙ্গণে গরম গরম ভাপা পিঠা তৈরি হচ্ছে। সবাই খাচ্ছে। আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম। তৌহিদ সমাদারে ওস্তাদ। জেমির সাথে খুব সহজেই ভাব জমিয়ে নিলো। সেখানেই দেখা হলো আরেক বন্ধু লালনের সাথে। সেও এসেছে তার জিএফ কে নিয়ে। তাদের সম্পর্ক বহুদিনের। বন্ধু মহলে এই নিয়ে অনেক কথা আছে। পরিবেশ জমজমাট আর আনন্দঘন হলেও আমি প্রমাদ গুনছি আবোল তাবোল অনেক কিছু কল্পনা করে। এক সময় বিদায়ের পালা এলো। আমি তৌহিদের সাথে থেকে যাবো। জেমিকে বলতেই চোখে চোখে এমন ভাবে তাকালো যে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু শুনলাম, “ভিতুর ডিম। লজ্জা লাগছে? ভয় পাচ্ছো”? যাহোক, তৌহিদ বিদায় নিয়ে চলে গেল। লালন তার জি এফ কে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি জেমিকে অনুসরণ করতে থাকলাম। সেদিনের পর থেকে দু’দিন জেমি কোন যোগাযোগ করেনি। ফোন করেও পাওয়া যায় নি। একদিন আচম্বিত ফোন করলো। বললাম, “ফোন ধরো না কেন? কোন প্রবলেম”?
— প্রবলেমই তো
— কি রকম?
— ভেবে দেখলাম, যে ছেলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় তার সাথে এই ‘সম্পর্কে’র নাম কি?
— মানে?
— মানে মানে করবা না। আমি কি বলতে চেয়েছি তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো
— উহু। তুমি বলো।
— আচ্ছা রাখছি। লেবেন চুস খাও গিয়ে।
আমার হাসি পেলো। বুঝলাম। জেমি তার সম্পর্কের একটা আইডেনটিটি চাচ্ছে। হাওয়া যখন অনুকূলে বয় তখন সারাকাল বসন্তকাল বলে মনে হয়। আমারও হয়েছে তাই। কাউকে কি সিম্পটন ধরে ধরে বোঝাতে হবে এখন বসন্তকাল চলছে?
চলবে…