আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
(১৯)
সাবরিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বলা চলে পালিয়ে এসে পড়লাম আরেক বিপদে। রাজউকের কাগজপত্র ফেলে এসেছি তার টেবিলে। আসার সময় উঠতে গিয়ে টেবিলের সাথে হোচট খাওয়াতেই এই বিভ্রাট হয়েছে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর মামা ফোন করে জানালেন। বললেন নিয়ে যেতে। আমি মরে গেলেও যাবো না। সাবরিনার কাছে আজ আচ্ছামত নাকাল হয়েছি। প্রেস্টিজ পাংচার যা হওয়ার হয়েছে। এবার গেলে টায়ার টিউবও যাবে। মামাকে বললাম অনেক দূর চলে এসেছি। প্রচন্ড জ্যাম। তার কাছেই যেন রেখে দেয়।
এবার ঢাকায় এসে দারুণ অস্বস্তিতে কাটছে। বাসার পরিবেশ থমথমে। সবাই আমার সাথে ডিফেন্সিভ খেলছে। আগ বাড়িয়ে কেউ কিছু বলেনা। মনে হলো দুই শূন্য ভোটে আমার বিরুদ্ধে সাধারণ পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে। এখন স্বল্প পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। হয়ত নিকট ভবিষ্যতে আরো বড় আকারে নিষেধাজ্ঞা আসবে। আমার ভোটাধিকার নেই। সেলিম কৌশলগত কারণে ভোটদানে বিরত। তার সাথেই টুক টাক কথা হয়। তবে তারও গা ছাড়া গা ছাড়া ভাব দেখলাম। রাতে খাবার টেবিলে আম্মাকে পেলাম। কাছে গিয়ে বসলাম। আম্মা উঠে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, “টেবিলে সব দেওয়া আছে”। আমি পথ আগলে বললাম, “এরকম করছো কেন? কি হয়েছে খুলে বলো”। আম্মা চোখ বড় বড় করে তাকালো। বহুদিন এভাবে তাকায় নি। বুঝলাম তার মেজাজ সপ্তমে। বললাম, “তোমরা যা ভাবছো ব্যাপারটা আসলে ওরকম না”। “তাহলে কি রকম”? আম্মার পাল্টা প্রশ্ন। এ সময় সাঁড়াশি আক্রমণের অভিপ্রায়ে মলি রুম থেকে বের হয়ে এলো। সেও এই বিতর্কে যোগ দেবে আমি নিশ্চিত। বললাম, “কাল সকালে আলাপ করা যাবে”।
মাথার অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ডাক্তার দেখাতে ভয় হয়। রাজ্যের আজেবাজে চিন্তা আসে। ব্রেণ টিউমার হয়নি তো? নিজেই শিউরে উঠলাম। এত অস্থিরতা নিয়ে পৃথিবীতে আর কেউ আছে কিনা জানিনা। হেসে খেলে জীবনটা তো ভালোই কাটছিলো। আম্মার ঘ্যানরঘ্যানরের কারণে বাধ্য হয়ে টিউশনি নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম টিউশনি করবো আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ট্রাই করবো। সেই টিউশনি করতে গিয়েই পড়েছি বিপদে। ইলমাকে পড়াতে গিয়ে জেমিতে আটকে গেছি। ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি কোন বিবাহিতার সাথে এভাবে জড়িয়ে যাবো। শৈলীকে পড়াতে গিয়ে কক্ষণো তার উড়ুউড়ু মনের সাথে তাল মিলাইনি। এখন তার সরব, নিরব নড়াচড়া দোলা দিয়ে যায়। মাল্টিন্যাশনালে চাকরির ইচ্ছে থাকলেও হুট করেই ইন্টারন্যাশনালে হয়ে গেলো। মাঝখান দিয়ে সেলিমের সাপলুডু খেলায় সবাই উপুর্যুপরি পেরেশান আর নাস্তানাবুদ হয়েছি। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারিও হয়েছে। অন্যদিকে সুখের খবরও হয়েছে। মলি এখন সন্তান সম্ভবা।
জামান ভাই সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আর কোন কথা বলেন নি। মনে হয় তার চয়েস আছে বা অন্য কোন এক্সপেক্টেশন আছে। আমারও আর ঢাকায় বদলীর খবর হয়নি। জামান ভাই এখন বিদেশে। ইউ এন ডিপি ডেলিগেশনের সাথে। ছোট মামা প্রমোশন পেয়ে আগারগাঁও অফিসে বদলী হয়েছেন। সাবরিনার সাথে দেখা হওয়ার চ্যাপ্টার ক্লোজ। তবু মাঝে মাঝে তার উচ্ছ্বল স্মৃতিতে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। সবার চাপে আর নিজের শারিরীক অবস্থার কারণে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। হাজারো টেস্ট। এম আর আই পর্যন্ত করতে হয়েছে। একগাদা ওষুধ দিয়েছে। মুড়ির মত তা তিন বেলা ভাগ করে খাই। বেশির ভাগই যে নার্ভ রিলাক্সেসন সংক্রান্ত বুঝি। সারাক্ষণ তন্দ্রালু ভাব লেগেই আছে। প্রথমে মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছি। এক পর্যায়ে তিনি নিউরোকে রেফার করলেন। তার কথা বার্তা, হাব ভাব দেখে শুনে গা ছম্ ছম্ করে উঠে। যতটা না মুখে বলেন তার চেয়ে বেশি চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলেন। অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছি। বলা চলে নিতে বাধ্য হয়েছি। দিনে দিনে ওয়েট লস হচ্ছে। এম আর আই রিপোর্ট খারাপ না। তবে বাসার কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলেনা। মাঝে মধ্যে মুখ ঠেলে বমি আসে। মাথাটা সারাক্ষণ ঝিম্ ঝিম্ করতেই থাকে। কখনো কখনো চিন্ চিন্ করে। আর কানে অনবরত ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ লেগেই আছে।
আম্মার চোখ ভেজা থাকে। ছোট মামার সাথে পরামর্শ করেন। বড় মামা এসে দেখে যান। আর বলেন, “সুস্থ হলে বিয়ে করিয়ে দাও। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। স্থিরতা দরকার”। মামাদের তত্ত্বাবধানে মাল্টিন্যাশনালে সেলিমের একটা চাকরি হয়েছে। যদিও চাকরিতে তার আপত্তি। কিন্তু পিতৃত্বের জোয়াল কাঁধে চাপায় রাজী হয়েছে। মলি খুব খুশি। সাত মাস চলছে। নবাগতের আগমনে আম্মার মুখ জুড়ে সুখের হাসি লেগে আছে। এখন মলির সেবাতেও তাকে সময় দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমাকে নিয়েও সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকতে হচ্ছে। ওষুধে বেশ কাজ হয়েছে। আগের চেয়ে অনেকটাই স্বস্তি বোধ করছি। মাথার ঝিম্, ঝিম্, চিন্ চিন্ ভাবটা অনেকটাই লাঘব হয়ে এসেছে। কিন্তু কানের ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকটা রয়েই গেছে। চাকরি বাঁচাতে খাগড়াছড়ি যেতে হচ্ছে। সব শুনে জামান ভাই হায়ার লেভেলে আলাপ করে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আমার একা একা খাগড়াছড়ি যেতে ভয় করছে। সাথে যাওয়ার কেউ নেই। সেলিম যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু মলির কথা ভেবে আমিই না করেছি। শেষ পর্যন্ত সেলিমের গ্রামের দুঃসম্পর্কের এক কাজিনকে ম্যানেজ করা হলো। এও বা কম কি? ডাক্তারদের অভিমত আমার কাউন্সেলিং জরুরি। নার্ভের উপর বেশ চাপ পড়েছে। গল ব্লাডারের অবস্থাও ভাল না।
খাগড়াছড়িতে গিয়ে পৌছলাম প্রায় সন্ধ্যায়। মাগরিবের নামাযটা পড়ে চা নাস্তা খাচ্ছি এমন সময় ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো। খুলে দেখি শৈলীর নক। অনেক দিন পর। এক ছেলের সাথে হাস্যোজ্জ্বল কিছু ছবি। কোন ক্যাপশন নেই। বুঝতে কষ্ট হলোনা যে বুয়েটে সে খুব ভালো আছে। উইশ করতে গিয়ে দেখলাম আমি ব্লকড। ভালোই হয়েছে। একে একে নিভিছে দেউটি। চা খেতে গিয়ে আমার প্রেসার হঠাৎ বেড়ে গেলো। সহকর্মীরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। টেস্ট রিপোর্ট আর মেডিকেশন দেখে বললেন, “নার্ভাসনেস থেকে এমন হয়েছে। টেনশন থেকে গ্যাস শ্যুট করেছে। ভেতরে অস্থিরতা আছে। স্টেবল হতে সময় নেবে। কোন চাপ নেওয়া যাবে না”।
এখন আর ফিল্ড ভিজিটে যাই না। অফিসে বসেই রিপোর্ট রিটার্নের কাজ করি। রাত্রি ভীতি পেয়ে বসেছে। সেলিমের কাজিনকে সাথে নিয়ে ঘুমাই। বড় ভালো ছেলে। ইন্টার পর্যন্ত পড়ে আর এগোতে পারেনি। আর্থিক স্বচ্ছলতা ভালো না। ক্ষেত খলা করে খায়। তার নাম হালিম। তার আন্তরিকতার ফিরতি দেওয়া সম্ভব না। জানিনা আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন কিনা? তিনি যেন হালিমের জন্য হালাল রুজির ব্যবস্থা করে দেন। রুজিতে বরকত দান করেন। হালিম এখন আমার জীবন চলার পথে অন্যতম বন্ধুস্থানীয় হয়ে গেছে। জানিনা আমার এই রাত্রি ভীতি, মনের স্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? আর হালিমই বা ক্ষেত খলা ছেড়ে কতদিন আমার সাথে থাকবে?
হালিমকে নিয়েই মাগরিব আর এশার নামায মসজিদে গিয়ে পড়ি। হালিম পাক্কা নামাযী। ফজরও মিস নেই। আমি পারিনা। আফসোস হয়। সময় গড়িয়ে যায় আমার বদলীর আদেশ আর হয়না। হেড অফিসের সুপিরিয়র পজিশনে রদবদল হওয়ায় সব ক্ষেত্রে এখন স্থিতাবস্থা নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। জামান ভাই লেগে আছেন। কিছুতেই ব্যাটে বলে হচ্ছেনা। ইমাম সাহেব আমাকে দেখে খুব পেরেশানীতে পড়ে গেলেন। সুরা পড়ে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, “বাবাজী, সারাক্ষণ তাওবা-এস্তেগফার পড়বেন। আল্লাহর কাছে খালেস নিয়তে মাফ চাইবেন। ইন শা আল্লাহ ভালো হয়ে যাবেন”। তাঁর এই কথাতে মনের জোর বেড়ে গেলো অনেক। কানে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ অনেকটাই কমে গেছে। মাথাটাও আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে। নিয়ম করে নামায শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসি। নানা কথা শুনি। তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন বলে মনে হয়। হালিমকে ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ী থেকে তার ডাক এসেছে। এখন নিজের উপর কিছুটা আস্থা পাচ্ছি। তাকে বিদায় দিয়ে দরোজা খোলা রেখে বাবুর্চিকে বললাম ডাইনিংয়ে এসে শু’তে।
এখন আর কারো কথা মনে করতে চাই না। শৈলী তার আপন ভুবন বেছে নিয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সময় ও স্রোত মানুষের মত ভুল করেনা। জেমির কথা চিন্তাতেও আনতে চাইনা। তার প্রতি মায়ার চেয়ে ঘৃণাই বেশি। সাবরিনার কথা মনে হয় মাঝে মাঝে। বিশেষত তার উচ্ছ্বলতা আর সহাস্য বদন ঈর্ষনীয়। আমার মনে হয় স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না। নিজের উপর আস্থা কমে গেছে। পৃথিবীটাকে বিবর্ণ মনে হয়। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, শীতলতা নেই। সর্বত্র ধুসর-উসর মরুময়তা। কোথাও সতেজ বৃক্ষ নেই, আছে মরু ক্যাকটাস। অবিকল সাবরিনার অফিস চেম্বারে রাখা বনসাই ক্যাকটাসের মত।
চলবে…