আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৭)

Photo of author

By Anwar Hakim

আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।

(১৭)
জামান ভাইয়ের স্বপ্ন সাধ পূরণ হয়েছে। করোনার কারণে সীমিত পরিসরে ওয়েডিং রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে সেনাকুঞ্জে। ভাবীর বড় ভাই মেজর জেনারেল। বিত্ত বৈভবে তারা যে অতি উচ্চে তা আয়োজন দেখেই বুঝা গেলো। জামান ভাইয়ের তরফ থেকে ভালোবাসা একতরফা হলেও ভাবী নিমরাজি ছিলেন বরাবর। তার ভয় ছিলো ফ্যামিলি থেকে মেনে নেবে কিনা? যাহোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এই মেল বন্ধন সম্ভব হয়েছে।

হাজার পাঁচেক টাকা মূল্যমানের প্রাইজ বন্ড তোফা হিসেবে নিয়ে গিয়ে বেওকুফ বনে গেলাম। উপহার গ্রহণের কোন ব্যবস্থাই নেই। জামান ভাইকে বলে ধমক খেলাম। আমাদের জন্য রিজার্ভ টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি যাই না। যদিও যাই প্রথম ব্যাচেই বসে পড়ি। এতে সুবিধে অনেক। প্রথমতঃ বিয়ের অনুষ্ঠানে সময়মত কেউ গিয়ে পৌছায়না। ঢাকা শহরের যানজট আর মহিলাদের সাজুগুজু ইত্যাদির কারণে সম্ভবও হয়ে উঠেনা। তাই বিয়ে বাড়ীর আমেজ পুরোপুরি জমে উঠেনা। তখন পরিচিতদের সাথে নিরিবিলি পরিবেশে হাই-হ্যালো করা যায়। দ্বিতীয়তঃ প্রথম ব্যাচের খাবার টেবিলে যে পরিচ্ছন্নতা ও খাবারের স্মেল, ফ্রেশনেস আর পরিবেশনার দক্ষতা যেরুপ থাকে পরবর্তী ব্যাচে তা সে পরিমাণে পাওয়া যায় না। তৃতীয়তঃ খাওয়া শেষে পান বা কফি হাতে বাকী পরিচিত অভ্যাগতদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। চতুর্থতঃ ব্যাচেলরদের জন্য এই দীর্ঘ সময়টা খুব কাজে লাগে। পাত্রী তালাশে। এ যেন পাত্রীর হাট। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। তবে বিভ্রান্ত হতে হয় প্রায় এক রকম সাজ আর উচ্চমাত্রার প্লাস্টিক পেইন্ট এর কারুকাজ দেখে। এর মাঝেও রয়েছে হিন্দী সিরিয়ালের প্রভাব। জামান ভাই ঘুরে ঘুরে সব খোঁজ নিচ্ছেন। কানের কাছে এসে বললেন, “খেয়ে দেখা করো”। আমাদের খাবার শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারের পিছনে এসে প্রায় সবাই পরবর্তী রাউন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে গেছে। সাউন্ড সিস্টেমে হিন্দী আর বাংলা ব্যান্ডের গান উচ্চগ্রামে বাজছে। বুঝলাম জামান ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণ এখানে অনুপস্থিত। ভাবছি এখনো কি জামান ভাই রাতের খাবারের পর পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান জারি রাখতে পারবেন? পরক্ষণেই হাসি পেল। কি যা তা ভাবছি।

এবার বিদায়ের পালা। জামান ভাইয়ের সামনাসামনি হতেই কাঁধে হাত রেখে কোণায় নিয়ে গিয়ে একটি মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “ভালো করে দেখো। পছন্দ হলে আলাপ করা যাবে। বাবা এয়ার ফোর্সে উপরের লেভেলে আছে। একমাত্র মেয়ে। নর্থ সাউথে বিবিএ পড়ছে”। আমি দেখলাম। বিস্তারিত শুনে আর মেয়েটিকে দেখে আমার রীতিমত অস্বস্তি ও ভয় ধরে গেলো। অস্বস্তি এ কারণে যে আমার মাথায় এখন জেমি ভার্সেস শৈলীর আনফিনিসড ড্রামা চলছে। আর ভয় এ কারণে যে, অতি বিত্তবানদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি। তাদের কন্যাদেরকে তো অতি অবশ্যই। এদের চিন্তা-ভাবনা, আবদার-চাহিদা আর দৌড়াদৌড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারার মত ছেলে আমি না। জামান ভাই হেসে বললেন, “ঘাবড়াও মাত। মেয়ে মডেলিং করে। নাটকেও ঝোঁক আছে”। আমি ঘন ঘন ঢোক গিললাম। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসা মাত্রই আম্মার ফোন, “তাড়াতাড়ি আয়। আমরা মলিকে নিয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালে। মাথা ঘুড়ে পড়ে গেছিলো”। বুকে প্রচন্ড একটা শক্ খেলাম। সেলিম আবার কোনো অঘটন ঘটায়নি তো? আম্মা কিছু বললেন না। বললেন, “কিছু টেস্ট দিয়েছে। এখন সেটাই করাচ্ছি”। অজানা আশংকায় মনটা থেকে থেকে খামচাখামচি করছে।

ল্যাব এইডে আর যাওয়া লাগেনি। সোজা বাসায় গিয়ে শুনি মলি সন্তান সম্ভবা। আম্মা খুশি। সেলিম আরো। আমারও খুব আনন্দ হলো। আমি মামা হতে যাচ্ছি। হঠাৎই আব্বার কথা মনে পড়লো। আব্বা আজ বেঁচে থাকলে কি থেকে কি যে করতেন অনুমানও করা যায় না। ছোট মামা ফোনে খোঁজ নিলেন। শেষে বললেন, “সেলিমের এখন কিছু একটা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তুমি কাল হক্কানী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার অফিস হয়ে যেও”। ঠিকই তো। সেলিমের এখন কিছু একটা করা অতি অবশ্যই দরকার। মলির মেন্টাল সাপোর্টের জন্য এটা হবে অনেক উপকারী। সেলিমের জন্য মায়া হলো। হতভাগার এসবে খেয়াল নেই। মলির জন্য কেন জানি কান্নাই পাচ্ছে। বকাবাদ্য করি, রাগারাগি করি যা-ই করি ছোট বোন বলেই করি। ক্ষেপাবার জন্যও করি। হয়ত একটু বেশিই করে ফেলি।

হক্কানী সাহেবের অফিসে গিয়ে তাঁকে পাইনি। ব্যস্ত মানুষ। বললেন, মঙ্গলবার লাঞ্চের পর যেতে। তাঁর অধস্তন এক ভদ্রলোক সব কিছু বুঝালেন। কফি খাওয়ালেন। আর উপদেশ দিয়ে বললেন, “যিনি এটা করতে চাচ্ছেন বা করবেন তাকে অবশ্যই হার্ড ওয়ার্কিং হতে হবে আর লেগে থাকতে হবে। আর নিজের বিজনেস টেকনিক কাজে লাগাতে হবে”। তার কথা শুনছিলাম আর সেলিমের সাথে মিলিয়ে নিতে গিয়ে হতাশ হচ্ছিলাম। এর কোন গুণই ওর মধ্যে নেই। আছে উচ্চাভিলাস আর তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার উদগ্র বাসনা। টেকনিক বলে কিছু নেই, যা আছে তাও খাটায় না। আবার বেশি বুঝতে গিয়ে লেজে গোবরে করে বাসায় এসে মলির আঁচল ধরে শুয়ে থাকে। আশ্চর্য। পুরুষ মানুষ এমন হয় চিন্তা করতেও কষ্ট হয়।

হক্কানী সাহেবের অফিস থেকে বেরিয়ে মামার অফিসে গেলাম। মামা নেই। বসতে বলেছেন। পিওন বসিয়ে দিয়ে কফি দিয়ে গেল। খাওয়ার উদ্রেক হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি। বসে বসে উইন্ড স্ক্রীণ দিয়ে ঢাকা শহর দেখছি। গলি পথে একই রাস্তায় ঠেলা চলছে। রিক্সা, লেগুনা, মাইক্রো, পিক আপ, কভার্ড ভ্যান, কুরিয়ারের কার্গো, কার, জীপসহ রকমারি যানবাহন ছুটোছুটি করছে। এর ফাঁক গলে হাজার হাজার মানুষ কিলবিল করছে। ধুলো আর কালো ধোঁয়ায় মানুষগুলোর মুখাবয়বে আলাদা পলেস্তারা পড়েছে যেন। এর সাথে রয়েছে তীব্র হর্ন। ট্রাফিক আছে। তবে জায়গামত না। টংয়ে দাঁড়িয়ে পান-বিড়ি খাচ্ছে আর পাবলিকের সাথে কথা বলছে। ভাবটা এমন যে, অনিয়মই যেখানে স্বাভাবিক সেখানে নিয়মের শাসনে গতি বাধা গ্রস্থ করে কি হবে?

সাবরিনা মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে এলো। বললো, “স্যরি, স্যার বলে গিয়েছিলেন আপনি আসবেন। পিওনকে বলেও রেখেছি আপনি আসলে যেন খবর দেয়। ভুলে গেছে। স্যরি”। সাবরিনার মুখে ‘স্যরি’ শুনতে অদ্ভুত ভাল লাগলো। হঠাৎই মনে প্রশ্নের উদয় হলো, সাবরিনারা কেন চাকরি করে? এরকম মাথা খারাপ করা সুন্দরীদের কারো অধীনে দেখলে খারাপ লাগে। বস্তুত এরা স্বামীর অধীনেও থাকার মত না। স্বামীরাই চন্দ্রমুখ দর্শনে মোহাবিষ্ট থেকে এদের অনুশাসনে তুষ্ট থাকে। এরা আসলেই নায়িকা হওয়ার মত। সারাক্ষণ মেনকা হয়ে থাকবে। ফ্যান ফলোয়াররা ঘুরঘুর করবে। মিডিয়া এদের নিয়ে সত্য-মিথ্যার মিশাল দিয়ে চটকদার গসিপ বানাবে। পাবলিক সেগুলো গাঁটের পয়সা খরচ করে এমবি কিনে পড়বে, দেখবে। প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে দ্রষ্টব্য স্থানে তাদের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড দ্যুতি ছড়াবে। “কফি খাচ্ছেন না যে” সাবরিনার কথায় ভাবালুতা কাটলো। নড়েচড়ে বসলাম। বললাম, “খেতে ইচ্ছে করছে না”।
— সেদিন না বললেন খাগড়াছড়ি গিয়ে কফি খোর হয়েছেন? সাবরিনার গুগলি।
— একটু আগেই খেয়েছি। আমার ততোধিক তরল উত্তর।
— ঢাকায় পোস্টিং হবে না
— কেন?
— না, এমনি। সবাই তো ঢাকাতেই থাকতে চায়
— ইচ্ছে তো হয়। সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়?
— আর কি ইচ্ছে হয়?
— আছে অনেক কিছুই। কোনটা বলবো? তার চেয়ে আপনার সম্মন্ধে কিছু শুনি। আপনি বলুন।
— আমার সম্মন্ধে? আমি সেলিব্রেটি নাকি?
— মোর দেন দ্যাট
— তাই নাকি? বুয়েটিয়ানরা দেখছি ইট পাথরের বাইরেও দৃষ্টি দেয়। সাবরিনা মুচকি হাসলো। সে হাসিতে দুষ্টুমির চিহ্ন সুস্পষ্ট। বললাম, “থাকেন কোথায়”?
— কাছেই। সেগুন বাগিচায়।
— বাসায় আর কে কে আছেন?
— ফ্যামিলি আছে
— ফ্যামিলিতে কে কে আছেন?
— কি মনে হয়?
— কিছুই মনে হয়না
— তাহলে জানতে চাচ্ছেন যে?

এমন সময় মামা এলেন। সাবরিনা সৌজন্যতা শেষে বিদায় হলো। হক্কানী সাহেবের প্রপোজাল নিয়ে আলাপ হলো। বললাম সেলিমের জন্য এটা মোটেই উপযোগী না। মামাও মাথা নাড়লেন। লাঞ্চ করালেন। এরি মধ্যে শৈলীর ফোন। ঘন ঘন বেজে চলেছে। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছি। শুধু শুধু জটিলতা বাড়াতে চাচ্ছিনা। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’? সাবরিনা কাজের জন্য আবার এলো। মৃদু হাসি বিনিময় হলো। আমার কাজ শেষ। তবু উঠতে ইচ্ছে করছেনা। এই বয়সেই কি গতি জড়তায় পেয়ে বসলো নাকি অন্যকিছু? অফিস থেকে বেরোবার পথে করিডোরে ব্যস্তসমস্ত সাবরিনার সাথে দেখা। হাসি বিনিময়ে বললো, “আবার আসবেন। আপনি খুব ইন্টারেস্টিং”। আমার লিফট এসে গেছে। অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ভিন্ন আর কোন পথ খোলা নাই।

চলবে…