আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
(১৫)
মানুষের জীবনটা যেন কেমন? এত ব্যস্ততা, এত পেরেশানী, এত লাভ-লোকসানের ছলচাতুরী প্রাণীকুলের আর কারো মাঝে নেই। এত রোগ,এত শোক, এত মনোবৈকল্য, এত চিকিৎসা, এত এত রিহেবিলিটেশন সেন্টার প্রাণীদেরও জন্য যদি প্রয়োজন হত তা হলে সৃষ্টিজগত ভিন্নরুপে সাজত। আগে ফ্যামিলি ছিলো সব কিছুর রক্ষাকবচ। এর কিছু সেট রুলস ছিলো। প্লাস মাইনাস করে চলত সবাই। আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিত। একের প্রয়োজনে দশজন চকিতে দৌড়ে আসত, ঝাঁপিয়ে পড়ত অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে। আর আজকাল? সামান্য স্বার্থে অতি আপনজন সরে যায়, চোখ উল্টিয়ে জিঘাংসা পুষে রাখে অন্তরে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে বোঝা মনে করে। ভুলিয়ে ভালিয়ে ফেলে রেখে আসে ফুটপাতে অথবা ব্যাক পুশ করতে করতে বাধ্য করে বৃদ্ধ নিবাসের বাসিন্দা হতে। পরিবার ভেঙ্গে হয়েছে এক একটি ব-দ্বীপ। এতেই যেন তুষ্টি, এতেই যেন মুক্তি। সেই নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির বৃত্ত ভেঙ্গে সন্তানেরা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। সেখানেই তৃপ্তি সেখানেই স্থিতি। তাই মৃত্যুকালেও বাবা-মার মুখ দর্শন নেহায়েত মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট বলে মনে হয়। জনকের পচনপ্রায় লাশ পাশে সরিয়ে রেখে ভাগ-বাটোয়ারাতে মত্ত থাকে অপত্যস্নেহে লালিত তার উত্তরাধিকার। কার জন্য এই ত্যাগ? এই কি তার প্রতিদান? পত্রিকায় এরকম খবর চোখে পড়ে আর মনটা বিষিয়ে উঠে। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেরা জীব হিসেবে। তার এই নমুনা? পত্রিকায় খবর দেখলাম দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে। জায়গায় জায়গায় তাই এত এত রিহাবিলিটেশন সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল। সর্বত্র চাপ, পরিবারের, সমাজের, লেখাপড়ার , পেশাপ্রাপ্তির, পেশা টিকিয়ে রাখার। আরো রয়েছে উন্নতির চাপ। পশ্চাতে পড়ে যাবার চাপ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চাপ। প্রেম-ভালোবাসার চাপ আর সেটা টিকিয়ে রাখার চাপ। আরো আছে বিধ্বংসী ব্রেক আপের চাপ।
আমি নিজেই এই কয়দিন চাপের মধ্যে ছিলাম। ঢাকা থেকে হেড অফিসের লোকজন প্রকল্প ভিজিট করে গেছেন। সাথে সাইট সিয়িংও। কাজের অগ্রগতিতে তারা সন্তুষ্ট। আপ্যায়ন ও তদারকিতেও। এতে কার কি লাভ হয়েছে জানিনা। আমার পারফম্যান্সে সন্তুষ্ট ভিজিটিং টীমের রিকমেন্ডেশন আমাকে প্রকল্প মেয়াদ পূর্তি পর্যন্ত এখানেই যেন রেখে দেওয়া হয়।
জামান ভাই বললেন আর হাসলেন। বললাম, “ভাই হাসছেন? এ মুহুর্তে আমার ঢাকা যাওয়া কত জরুরি তা আর কেউ জানুক আর না জানুক আপনি তো জানেন”। জামান ভাই মজা নিলেন। বললেন, “টেক ইট এজ ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট। ডোন্ট বি সো ডিসহার্টেন্ড”। জামান ভাই ভরসা। তাই চুপ করে গেলাম। মানুষের মন বড় নাজুক। একটুকুতেই উৎফুল্ল হয়, আবার বিপরীতে বিষাদে মুষড়ে পড়ে। বিষন্নতা আমাকে পেয়ে বসেছে। বন্যেরা বনে সুন্দর, আমি ঢাকায়।
বাসার সব কিছু ‘টু বি কনটিনিয়ুড’ স্টাইলে চলছে। সেলিম এখন মলিকে নিয়ে হাওয়া খেতে বাইরে যায়। কফি শপে বসে। মার্কেটে টুকটাক কেনাকাটা করে। টাকার যোগানদার ওয়ান এন্ড অনলি মলি। আম্মা মন্দের ভালো হিসেবে শান্তিতে আছে। কিন্তু অজানা আতংকে আতংকিতও থাকে। আত্মীয়স্বজন বাড়ী বয়ে এসে তথ্য নিয়ে যায় সেলিম কিছু করে কিনা? তাদের মূল উদ্দেশ্য তথ্য কনফার্ম করা আর মনে মনে লাইভ সার্কাস দেখার মজা নেওয়া। শরাফত চাচা আবার এসে হাজির। এসেই ঘোষণা দিয়েছেন বেশিদিন থাকবেন না। বিশেষ কাজে এসেছেন। কাজ শেষেই চলে যাবেন। আসার সময় ক্ষেতের কিছু সব্জী আর ফল-মূল নিয়ে এসেছেন। তার এবারের মিশন হলো আবহাওয়া দপ্তরে চাকরির তদবির। ছোট মামা সরকারি চাকরি করেন। তাঁকে দিয়ে তদবির করাবেন। খবর পেয়েছেন পিওন পদে নিয়োগে পাঁচ-ছয় লাখ লাগে। তাই এসেছেন। টাকা কোন সমস্যা না। খালি নিশ্চয়তা দরকার। আম্মা বিরক্ত। ছোট মামা নিরিবিলি টাইপের মানুষ। তিনি এই ধরণের তদবির করবেন না। শরাফত চাচা উপায়ন্তর না দেখে আমাকে ফোন দিলেন।
আমি বললাম, “চাচা, আপনি এই বয়সে এগুলো নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেন কেন”?
— বাবাজী, গ্রামে থাকলে একে অপরের সুখ-দুঃখ দেখন লাগে।
— যার তদবিরে এসেছেন সে কি আপনার আত্মীয়?
— না, না। গ্রাম সম্পর্কে ভাই। তার ছেলের।
— আজকাল চাকরি কত কঠিন, জানেন?
— কঠিন আবার সহজও
— কেমনে?
— এই ধরো টাকা হলেই সব সহজ
— টাকা কে নেয়?
— কে নেয়না বাবাজী? টপ টু বটম
— এখন কি করবেন? ছোট মামা এগুলোতে ইনভলভ হবে না। তাছাড়া আপনার ইন্টারেস্ট কি?
— জসীম মিয়ার পোলার চাকরি হইলে হের ক্ষেতটা আমার কাছে বেচবো”।
তাঁকে নরম গরম বুঝিয়ে বাড়ী চলে যেতে বললাম। তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। ভাবটা এমন যে সহজ কাজটা করে দিলাম না। সেলিমকে বাসায় দেখে তার হাজারো প্রশ্ন। তার প্রথম কৌতুহল, সে কি করে? চাকরি না ব্যবসা। সেলিমও কম না। বলেছে আউটসোর্সিং। শরাফত চাচা তা শুনে অবাক। সেলিম প্রথমে হোমিওপ্যাথিক ডোজ দিয়ে এর ব্যাখ্যা শুরু করলো। শরাফত চাচার কানের পাশ দিয়ে তা চলে গেলো। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। হা করে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর তাকে দেওয়া হলো আয়ুর্বেদি ডোজ। এবারও কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে বিষয়টা যে নতুন এটুকু বুঝতে পেরেছেন। এরপর দেওয়া হলো এলোপ্যাথি ডোজ। এবার তার কাছে বিষয়টা আগের চেয়ে ক্লিয়ার। তিনি এতটুকু বুঝতে পেরেছেন যে, এটা নতুন ধরণের ব্যবসা। মেলা টাকার ব্যাপার। তার লোভাতুর চোখ জিজ্ঞাসু হয়ে উঠে। কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে বললেন, “বাবাজী, কিরকম টাকা লাগে এতে”? সেলিম আরো আকর্ষণীয় করে উত্তর দিলো, “টাকা তেমন লাগে না বললেই চলে। টাকাই বরং হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। শুধু কায়দা মত ধরতে জানলেই হয়”। শরাফত চাচা এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। অযথা সময় ক্ষেপন করার মানুষ তিনি না।। তিনি বিদায় হলেন। কিন্তু বলে গেলেন, বিষয়টা তার মনে ধরেছে। তার এক ভাতিজা কম্পিউটার ভালো জানে। তাকে নিয়ে আবার আসবেন। সেলিম এগুলো বলে আর হাসে। আপদ তাড়াতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা আর কি।
এই কয়দিনে শৈলী অসংখ্যবার ফোন করেছে। বেশিরভাগই ধরিনি। কিছু কেটে দিয়েছি। ব্যস্ত বলে কিছু সংক্ষিপ্ত উত্তরে সেরেছি। আর বাকী গুলো নেটওয়ার্ক পুওরের কারণে সম্ভব হয়নি। খাগড়াছড়িতে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুবই পুওর। একটু ভেতরে গেলে পাওয়াই যায় না। ডাটাও খুব স্লো চলে। এত কিছুর মধ্যেও ইন্টেরেস্টিং হলো শৈলীর ম্যাসেজ, “আম্মু বলেছে আপনাকে আংকেল বলে ডাকতে”। এটা যে আমাকে ক্ষেপানোর জন্য তা বুঝতে পারি। আমিও পাল্টা বার্তা দিলাম, “তাহলে এখন থেকে তোমার আব্বা-আম্মাকে ভাই-ভাবী বলে ডাকবো”। এরপর আর ম্যাসেজ আসেনি। এখন হয়েছে অন্য বিপদ। ঢাকা টিম ফিরে যাওয়ার পর যতই ফোন দেই শৈলী আর রিসিভ করেনা। বেশি করলে মোবাইল অফ করে রাখে। টেক্সট দিলে রিপ্লাই আসেনা। বালিকা মনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা ভালোই লাগে।
বেশ চেষ্টা করে অবশেষে শৈলীকে ফোনে পাওয়া গেল। কেন এত চেষ্টা করলাম আমি নিজেও জানিনা। এটা কি নিছক ছাত্র-টিউটর এর দায়? নাকি অন্য কিছু। ফোন ধরেই বললো, “ হঠাৎ”?
— স্যরি, ব্যস্ত ছিলাম।
— আমিও।
— মানে?
— ড্রিম কামস ট্রু
— মানে?
— বুয়েটে হয়ে গেছে।
— কনগ্রেচুলেশন্স
— লাগবেনা। বলেই ফোন রেখে দিলো। আমি হতকচিত ও লজ্জিত। এই কয়দিন দুনিয়াদারির কোন খবরই আমি রাখিনি। বুঝলাম বালিকার দিলে চোট লেগেছে প্রচন্ড। কতক্ষণ পরে আবার ফোন দিলো, “আপনার কাজিন ফারিয়া আর ক্লাস মেট মুমুর খবর ভালো”? আমি বিস্মিত। বললাম, “তাদের প্রসঙ্গ এলো কেন”?
— তাদের খবর তো ঠিকই রাখেন
— মোটেই না। তাছাড়া ওরা আমার সমবয়ষ্ক। তোমার অনেক সিনিয়র। আমি ক্ষেপানোর জন্য মোক্ষম অস্ত্র ছুঁড়ে দিলাম।
— তাদের নিয়েই থাকেন। আমি তো জুনিয়র
— জুনিয়রই তো। বলামাত্রই ফোন কেটে দিলো।
এই সময় জেমির সরব উপস্থিতির খুব প্রয়োজন। মানুষের মন শূন্যতায় ভেসে বেড়ায়। দমকা হাওয়ায় এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে চলে যায়। কখন কোথায় গিয়ে থিতু হয় তা সে নিজেই বুঝেনা। শুক্রবার বা’দ এশার বয়ানে হুজুরের কথাগুলো খুব কানে বাজছে। সমাজে অস্থিরতার সাথে সাথে ব্যাভিচার বাড়ছে। ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশা, বেপর্দা চলাফেরা, পরকীয়া আর জেনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ছে অবিশ্বাস। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে বাড়ছে ডিভোর্স। যে কাজ শরিয়াহ অনুমোদিত নয় সে কাজের প্রচার, প্রসার, পৃষ্ঠপোষকতা, উৎসাহ আর সায় দেওয়াও গুনাহের। তালাক শরিয়াহ সম্মত একটি বিধান। কিন্তু আল্লাহতায়ালার কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয়। তালাকে ইন্ধন দান সমপর্যায়ের অপরাধ, নাপছন্দ কাজ। কথাগুলো বুকে ধাক্কা মারলো। মননে মগজে অনুরণন তুলতে থাকলো। জেমি বিবাহিতা জেনেও তার সাথে সম্পর্কে জড়ানো কি সমপর্যায়ের অপরাধ? এর দ্বারা কি জেমিকে প্ররোচিত করা হচ্ছে? জেমির এই স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা কি সংশয়ের নাকি মুক্তির প্রচেষ্টা? এসব প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক , হাজারো যুক্তি মনকে জেমিতেই মোহাবিষ্ট করে রাখে।
চলবে…