আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৪)

Photo of author

By Anwar Hakim

আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।

(১৪)
বাসার অবস্থা অপরিবর্তিত। শান্ত। মলির কোন উদ্বেগ নেই। আম্মাও স্বস্তিতে আছে। তবে এর ভবিষ্যৎ কি কেউ জানেনা। যাকে নিয়ে এই উদ্বিগ্নতা আর পেরেশানি সেই সেলিম নির্বিকার। দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুরছে-ফিরছে। তার তরফ থেকে নতুন কোন প্রপোজাল নেই। মলিও কিছু বলেনা। পাছে সেলিম বাগড়া দিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বড় মামাকে সেলিমের বিষয়ে কিছু বলা যায় না। প্রসঙ্গ তুল্লেই বলেন, “ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। মুদির দোকানও চালাতে পারবে না”। সমস্যা হলো সেলিম নিজেই। তার মিশন, ভিশন অনেক উঁচু। প্রচুর টাকা থাকবে, গাড়ী-বাড়ী থাকবে। সফিসটিকেড বিজনেস থাকবে। সব কিছু টিপটপ হবে। অফিস হবে ওয়েল ডেকোরেটেড। থাকবে মৌ মৌ ফ্রেগরেন্স। কর্মচারীর সংখ্যা যতজনই হোক তারা হবে স্যুটেড-বুটেড। আরো কত কি! স্বপ্ন দেখতে সবারই ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই পার্থক্যটুকুই বুঝতে পারছে না সে। মন্দের ভালো হিসেবে সবাই তার এই স্থিতাবস্থা মেনে নিয়েছে। আর কিছু না হোক নতুন করে তো আর কোন ঝামেলার সৃষ্টি হচ্ছে না। ছোট মামার সাথে সব শেয়ার করা যায়। তিনিও চিন্তিত। এখনই একটা কিছু করা জরুরি তিনিও বুঝেন। বললাম, “মামা, ভালো কোন কিছুর ফ্রেঞ্চাইজ খুলে দিলে হয়না”? মামা সায় দিলেন। কিন্তু সেটা কি? এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। মলিকে বললাম। বললো, “আপাতত এভাবেই থাক। আগে মাথা থেকে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার পোকা বেরোক। তারপর একটা কিছু করা যাবে”। কথাটা নেহায়েত মন্দ বলেনি। উদ্ধারকৃত টাকাগুলো মলির একাউন্টে জমা আছে। অতএব টেনশন কম।

আমরা মেয়েদেরকে যতই কমজোরি মনে করি তারা ততোটা না। বিশেষত সাংসারিক বুদ্ধিতে তাদের সুক্ষ্মদর্শী বিচার বিশ্লেষণ যাদবের পাটিগণিতের চেয়েও সমৃদ্ধ। আম্মা হাসে। বলে, দু’জনে বসে বসে লুডু খেলে। বুয়া দেখে আর হাসে। আর আম্মার কাছে এসে ধারা বর্ণনা দেয়। কিছুই করার নেই।

শৈলী রোজ রাতে ফোন দেয়। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। নাছোড়বান্দা। আমি তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার জন্য বলি, “তোমার বয়স কত”?
— কেন?
— এই বয়সটা খুব ইম্পোর্টেন্ট। লাইফের টার্নিং পয়েন্ট
— জ্ঞান দিচ্ছেন?
— ধরো তাই
— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। জ্ঞানে আমি এত বেশি জ্ঞানিত হয়ে গেছি যে ভার রাখতে পারছিনা
— বুয়েটে ভর্তির জন্য কিন্তু পড়াশোনা করতে হয় প্রচুর
— মনে হয়না
— কেন?
— আপনাকে দেখে তাই মনে হলো
— আমার জ্ঞান নেই?
— ওটুকু ছাড়া আর কিছু নেই
— আগে ওটুকুই অর্জন করো। চেহারা ছবি ভাল আছে। খুব সহজেই পার হয়ে যাবে
— আপনার হিংসে হচ্ছে?
— বারে। হিংসে হবে কেন? তুমি তো আমার অনেক জুনিয়র
— এতদিন বসে বসে হায়ার ম্যাথ ঘেটে এই সমাধান বের করেছেন?
— ইনফেচুয়েশন কি জিনিস বুঝো?
— আপনি কি আমাকে সে পর্যায়ে জ্ঞান করেন?
— বুয়েটে ভর্তি হও। প্রচুর ছেলে বন্ধু ঘুরঘুর করবে। যোগ্য সাথী পেয়ে যাবে। তখন এসব ইনফেচুয়েশন নিয়ে মনে মনে হাসবা
— ভালই তো হবে। আপনি তখন জ্বলতে থাকবেন। আপনাকে পিক শেয়ার করবো।

শৈলীর একটা জিনিস তারিফ না করে উপায় নেই। তার মেধা শক্তি প্রখর। সেন্স অফ আর্টিকুলেশন হাই। এর সাথে লাবণ্যতা আর মাধুর্যতা অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে। তার আরেকটি গুণ হলো সম্মোহন শক্তি। আমি ক্রমশঃ পর্যুদস্ত হয়ে যাচ্ছি তার কাছে। আর তখনই জেমির উপর সাংঘাতিক রাগ হয়। অভিমান হয়। জেমি কি তা বুঝে? মাঝে মাঝে মনে হয় আমার এ অতি আবেগ এক পাক্ষিক। এটা যেন আলো অভিমুখী পতঙ্গের এক ধরণের ‘আত্মহনন পথযাত্রা’।

খাগড়াছড়ি আর ভাল লাগছে না। দেখতে দেখতে ছয় মাস হয়ে গেলো। বিষন্নতা আর নিঃসঙ্গতা পাহাড়ের নিসর্গকে ছাপিয়ে দম বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। চাকরির এই জীবন আমার লক্ষ্যের মধ্যে ছিলো না। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ঘরের ছেলেদের জীবনের ক্যালকুলেশনের ভেতর থাকে অনেক অনেক ডিপেন্ডেবল ভেরিয়েবল্স। এর মধ্যে অন্যতম হলো পরিবারের সেট রুলস। সেলিমের মনের অভিলাষে উচ্চাকাংখা থাকতে পারে, সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে ফারাক থাকতে পারে কিন্তু এটাও তো ঠিক সবাই এক পথে হাঁটে না। এক বেগে চলে না। এক বৃত্তে ঘুরেনা। কেউ কেউ বৃত্তের বাইরে গিয়ে স্বপ্নের সম্মিলন ঘটাতে চায়। কেউ কেউ জীবনটাকে গতানুগতিকের বাইরে আলাদা ফ্লেভারে উপভোগ করতে চায়। সংসার সাফল্যের মাপকাঠিতে সব কিছু মাপে। যার পায়ের তলার মাটি যত মজবুত, যার দৌড়ের পরিধি যত ব্যাপক, যার বিত্ত-বৈভবের ব্যালান্স যত বেশি অনুকূল সংসারে সে তত সফল।
মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছে। এখানে বেশিদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবো নির্ঘাত। এখানে যারা সহকর্মী তাদের জীবনের লক্ষ্যই হলো চাকরি, প্রচুর ক্যাশ আর সুন্দরী বৌ। এই নিয়েই তাদের স্বপ্নের দৌড়। তাই তাদের কোন খেদ নেই। কোন টানাপোড়েন নেই। মাথায় কোন পোকা নেই। সংসারে এরাই গুড বয়।

পাহাড়ে যারা চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে বসবাস করে তাদের স্বজন ও সুজন ভাগ্য খুব ভালো। সবাই এই সম্পর্ক ধরে পাহাড়ে ফ্যামিলি ট্যুর দিয়ে যায়। ভালোই লাগে। ঢাকায় থেকেও যাদের সাথে বছরে দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাদের সাথেও এখানে আনন্দে কেটে যায় কয়েকদিন। আমি সরকারি চাকুরে না। তাই প্রটোকলের পেরেশানি নেই।। বরং পরিচিত, আপনজন কেউ না এলে পানসে লাগে। ভাবছি আম্মাকে আর মলিকে আসতে বলবো।
একঘেয়েমি আর নিঃসঙ্গতার মাঝে একমাত্র বৈচিত্র্য হলো শৈলীর ফোন। খেয়ালী মন। যখন তখন ফোন দিয়ে বসে। হয়ত আমাকে রাগাবার জন্যই। নিষেধ করলেও কে শোনে কার কথা? এই একটু আগেই ফোন করে বললো, “আপনি তো আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেন নি এখনো। অন্য মেয়ে হলে তো ঠিকই সময় নিতেন না”। ভুলেই গিয়েছিলাম। মাত্রই মনে পড়লো। বললাম, “বাজে কথা। আমার লিস্টে বালিকা কম”।
— কম মানে? যা আছে তা স্পেশাল?
— আরে না। কথা খালি টেনে অন্যদিকে নিয়ে যাও
— ক্ষতি কি? পুরুষ মানুষের চরিত্র জানা আছে
— কি রকম? একাধিক অপশন রাখে
— আমার সেরকম কেউ নেই
— গুড। ঢাকায় আসবেন কবে?
— জানিনা। কেন?
— সামনে পরীক্ষা। কিছু হেল্প হত।

কথা কিন্তু এখানেই শেষ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার ফোন, “ভালো কথা। এবার দেখলাম আপনি নামাযী হয়েছেন। ছ্যাকা খেয়েছেন নাকি”? বললাম, “কিসের সাথে কিসের তুলনা দিলা”? কথা না বাড়িয়ে রেখে দিলো। বিচলিত হলেও ওর ফোন ভাল লাগে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করে হয়েছে আরেক বিপদ। প্রোফাইল চষে বের করেছে দু’টি নাম। ফারিয়া আর মুমু। এই নিয়ে হাজারো জেরা। জেরা মানে আমার মাথা নষ্ট করা। ফারিয়া আমার কাজিন। যেইনা বলেছি অমনি হাজারো সম্পূরক প্রশ্নের মুখে পড়লাম। আর মুমু আমার ক্লাসমেট। থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। পি এইচ ডি করছে। আর ফিরবে না। জেরার মুখে যেই বলেছি এখনো আনম্যারিড অমনি ধরেই নিয়েছে আমি আসলে বিদেশ পাড়ি দেবো। কোভিডের কারণে সময়ক্ষেপণ করছি আরকি। বুঝতে পারছি বালিকাদের সব কিছু সহজ ভাবে নিতে নেই। এর সুদুরপ্রসারি সাইড ইফেক্ট কি কি হতে পারে তাও ভেবে দেখা জরুরি। আমিও উল্টো প্যাচ দিয়ে বললাম, “এই যে তুমি খামোখা আজেবাজে চিন্তা করছো, এখন তোমাকে আমার লিস্টে দেখে যদি ওরা এরকম জেরা করে”? প্রশ্ন করে বোকা হয়ে গেলাম। ভাবতেও পারিনি এটা এভাবে ব্যাক ফায়ার করবে। শৈলী ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, “এই তো থলের বিড়াল বেড়িয়ে এলো। আমার নাম দেখে ওদের জ্বলবে কেন? তার মানে কুচ কুচ হোতা হ্যায়”।
— দূর। মহা বিপদে পড়লাম তো
— বিপদে আপনি পড়বেন কেন? পড়েছি তো আমি
— কেমনে?
— “জানিনা” বলে লাইন কেটে দিলো।

এ যাত্রা বাঁচা গেলো মনে করে হাফ ছাড়ার আগেই আবার ফোন, “ভালো কথা, আপনি কিন্তু আমার সেই প্রশ্নের কোন উত্তর দেন নি”।
— কোন প্রশ্ন?
— আপনাকে কি এড্রেস করবো?
— বলেছি তো। আমি জানিনা
— তাহলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করি?
— করো। চুল ছিড়ে দেবে
— জ্বী না। আম্মু এখন আমার ভক্ত।
— এত ডেভেলপমেন্ট?
— হুম্ম। আগে বুয়েটে ভর্তি হয়ে নেই। দেখবেন মজা।
— কিরকম?
— লেট টাইম কাম। বা’বাই।

হেড অফিস থেকে লোকজন আসবে প্রকল্প পরিদর্শনে। জামান ভাই জানালেন, এর উপর নির্ভর করছে নিকট ভবিষ্যতে আমার ঢাকায় ট্রান্সফার। বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় সহকর্মীদের নিয়ে লেগে গেলাম কাজে। প্রকল্পের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন বাড়িয়ে দিলাম। আর আপডেটেশন ও ডকুমেন্টেশনের কাজে লেগে গেলাম। সময় খুব কম। অনেক রাত অবধি কাজ করতে হয়। সাথে যোগ হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাইট ভিজিট। জামান ভাই আমাকে এর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এটা তারও ইজ্জত কা সাওয়াল। আমারও। শৈলীর ফোন আর সেভাবে রিসিভ করা হয়না। ঘটনা বলে যখন তখন ফোন দিতে নিষেধও করেছি। পারতপক্ষে এই তিন চারদিন যেন ফোন না দেয়। কিন্তু কে শুনে কার কথা? বাধ্য হয়ে কেটে দিতে হচ্ছে। জানি এর সুদূরপ্রসারী ভোগান্তি পোহাতে হবে।

চলবে…