আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৩)

Photo of author

By Anwar Hakim

আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।

(১৩)
শৈলীরা এলো। রেস্ট হাউসে পৌছে ফোনও দিলো। আমিও গিয়ে দর্শন দিলাম। তার চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস আর চোরা দুষ্টুমি। শৈলীর বাবা অমায়িক মানুষ। ভদ্রলোককে এর আগে মাত্র একবার তাদের বাসায় দেখেছিলাম। কথা হয়নি। সে তুলনায় শৈলীর আম্মা এখনো ভাব-গম্ভীর। বিদেশ বিভুঁইয়ে পরিচিত কাউকে পেলে যেমন বোধ হয় এর চেয়ে তার অভিব্যাক্তিতে বিশেষ ব্যাতিক্রম কিছু অনুধাবন করতে পারলাম না । অবশ্য এটা সত্য যে, টিন এজ মেয়ে থাকলে কোন মা-ই কোন তরুণকে সহজ চোখে দেখতে পারেনা। আমার এসব গা সহা হয়ে গেছে। চা-নাস্তা সেরে তারা বেরিয়ে পড়বে। আমি অফিসের দোহাই পাড়লাম। শৈলীর মুখ কাল্সে হয়ে গেল। চোখ দিয়ে আগুন ঠিক্রে বেরোচ্ছে। কায়দা মত পেলে আমাকে ভস্মীভূত করে দেবে এমন ভাব। শৈলীর আব্বা কথা কম বলেন। শুধু বললেন, “অফিসের কাজ হ্যাম্পার করে আমি যেতে বলবো না। যদি যেতে পারো উই উইল বি রাদার হ্যাপী”। শৈলীর আম্মা কোন কথা বললেন না। শৈলী তাঁকে প্রেসারাইজ করছে, “আম্মু, তুমি বললেই স্যার যাবে। বলো না”। যাহোক, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি যাইনি। সিদ্ধান্ত হলো কাল সকালে সাজেক ভ্রমণে আমি তাদের সাথে যাবো। এই নিয়ে শৈলীর সে কি রাগ!

রাতে ওদের সাথে আবার দেখা। স্থানীয় রেস্তোরাঁয় শৈলীর ভালো রেজাল্টের জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুত ট্রিটের ব্যবস্থা করলাম। শৈলীর আব্বা খুব উঁচু মাপের মানুষ। পড়াশোনা অগাধ। আলাপ করলেই বুঝা যায়। আমাদের আলাপের মাঝে শৈলী যেন প্রাণের স্পন্দন। শৈলীর আম্মাও গাম্ভীর্যের খোলস আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছেন। বাসার খোঁজখবর নিলেন। ঢাকায় গেলে বাসায় যেতে বললেন। আরো বললেন, “শৈলীর খুব ইচ্ছে বুয়েটে পড়বে। আর্কিটেক্ট হবে। সারাদিন আঁকা জোকা করে। জানিনা কি হয় শেষমেশ”? সুযোগ পেয়ে আলাপ জমাতে বললাম, “আন্টি, চিন্তা করবেন না। শৈলী খুব ভাল স্টুডেন্ট। রেজাল্ট ভালো। ড্রয়িং আর ডিজাইন সেন্সও খুব ভালো। হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ”। শৈলী পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সব উপভোগ করছে।

আমাদের সাজেক যাত্রার শুরুতেই খানিকটা বিপর্যয় হলো। যে গাড়ী উন্নয়ন বোর্ড থেকে দেওয়া হয়েছে সেটাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। মবিল পড়ে যাচ্ছে। কোনক্রমেই বন্ধ করা যাচ্ছেনা। সেটা পাল্টে আরেকটা আসতে বিলম্ব হলো। প্রায় চার ঘন্টা লেগে গেলো সাজেক যেতে। পথে কয়েক জায়গায় নেমে ঘুরাঘুরি আর ফটো স্যুট। হেলিপ্যাডে পৌছামাত্র আচমকা কোথা থেকে এক রাশ ভারী মেঘ বৃষ্টি বয়ে নিয়ে এলো। তাতে আমাদের পরিধেয় কাপড় বেশ খানিকটা ভিজে গেলেও এই দুর্লভ প্রাপ্তিতে আমার আর শৈলীর খুব মজা হলো। শৈলীর আব্বা বললেন, “এই মেঘ, এই বারিষ আল্লাহর রহমত আমাদের জন্য। ঠান্ডা লেগে না গেলেই হয়”। তাঁর মুখে ‘বারিষ’ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর লাগলো। আন্টি ব্যাপারটাকে ট্যুরিস্ট ম্যুডেই নিলেন। সব মিলিয়ে খুব ভাল লাগলো। এর আগে জামান ভাই ও অন্য কলিগরা সহ এসেছিলাম। তখন মেঘ, বৃষ্টির এমন রোমান্স দেখিনি। শৈলীর স্ফুর্তি অপরিসীম। সে কি থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুপুরে সেনাবাহিনীর রেস্টহাউজ কাম রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ হলো। ফেরার আগে আবারো এদিক সেদিক ঘোরাফেরা। এবার আর আংকেল-আন্টি সাথে এলেন না। শৈলীকে এভাবে ছেড়ে দেবেন ভাবতেও পারিনি। আমি নির্লিপ্ত ভাব দেখালেও শৈলীর আনন্দ দেখে কে? হাঁটতে হাঁটতে বললো, “জায়গাটা এত্ত সুন্দর কল্পনাও করা যায় না”। আমি কথার পৃষ্ঠে কথা যোগ করলাম, “আজ তোমাদের লাকটাই ভালো”।
— যেমন? শৈলীর ঝটপট প্রশ্ন।
— এই আসা মাত্রই এক খন্ড মেঘ আর এক রাশ বৃষ্টির খেলা হয়ে গেলো
— হুম্ম। আপনার ভালো লাগেনি?
— হুম্ম। খুউব। এর আগে যেদিন এসেছিলাম সেদিন মেঘ থাকলেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি
— দেখলেন তো আমি এলাম আর মেঘ-বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিয়ে গেলাম
— তোমার আব্বা- আম্মাও বেশ এনজয় করেছেন। আন্টি তো আজ বেশ ইজি হয়ে গেছেন
— আরো হবে। জাস্ট কীপ ওয়াচিং।

এর দ্বারা কি বুঝালো বুঝিনি। ব্যাখ্যা দাবী করে সামনাসামনি লজ্জা পাওয়ার মত বোকামীর কোন অর্থ হয়না। বললাম, “এখন যেতে হবে”। “দূর ছাই, কেন যে সময় এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়”? আমি বললাম,“নেক্সট টাইম এলে এখানে এক রাত থেকো। সান রাইজ আর সান সেট নাকি অপূর্ব দেখায়”। “আপনি থাকলে আবার আসবো” শৈলীর উত্তর। এবারের দেখায় শৈলীকে প্যারাগন বিউটি বলে মনে হলো। এমনিতেই সে চোখে পড়ার মত সুন্দরী। বললাম, “আন্টি তোমাকে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকেন”।
— কেন? শৈলীর কৌতুহল।
— তুমি খুব সুন্দর, তাই
— সত্যি বলছেন?
— আমার বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখানকার সব ছেলেই তোমাকে হা করে দেখছে
— আপনিও দেখেন?
— কি বলছো? তোমার সাথে কি আমার সে সম্পর্ক?
— তাহলে কি সম্পর্ক?
— জানিনা।
— এই তো ভাববাচ্যে চলে গেলেন। আমি কিন্তু আপনাকে আর স্যার টার বলতে পারবো না।
— কে বলেছে বলতে?
— তাহলে কি বলবো?
— আমি কি জানি?
— তাহলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করবো কি বলবো? আর বলবো আপনি স্যার বলতে মানা করেছেন। এই বলে সে চক্ষু কুঞ্চিত করে দুষ্টু হাসিতে আরো অপূর্বা হয়ে উঠলো। লজ্জায় আমি লা জবাব। টিন এজ বালিকাদের একটু গুরুত্ব দিলেই হয়েছে। কি থেকে কি করবে, কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কেউ জানেনা।

শৈলীকে পেয়ে জেমিকে ভুলে যাই নি। তবে প্রচন্ড জেদ জমে আছে জেমির উপর। এটা কোনক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না যে প্রযুক্তির এ যুগে একটিবারের জন্যও যোগাযোগ করা যায়না। ভাবনাতে ছেদ ঘটিয়ে শৈলী আচমকা প্রশ্ন করে, “একটা প্রশ্ন করবো? একান্ত ব্যাক্তিগত”।
— করো
— ডু ইউ হেভ এনি ফেসিনেশন টু এনি ওয়ান?
— মানে?
— মানে মানে করবেন না। আপনি ঠিকই বুঝেছেন হোয়াট আই ওয়ানা নো
— ডু ইউ হেভ এনি? আমার পাল্টা প্রশ্ন।
— ইয়েস আই ডু। বাট হু কেয়ারস?
— লিভ ইট
দেখলাম শৈলীর মুখাবয়ব জুড়ে হতাশার কালো মেঘ নেমে এলো। ম্যুড অফ হয়ে গেলো। আমরা খাগড়াছড়ির পথে অগ্রসর হলাম।

রাতের ডিনার রেস্ট হাউসেই হলো। খাওয়ার পর শৈলী হাঁটবে। আংকেল-আন্টি খানিকটা সঙ্গ দিলেন। শৈলী ‘ওয়াকিং ফর ডায়েটিং’ এর মত দ্রুত লয়ে হাঁটছে। সাথে আমি। নীচে কালচে পাহাড়ের খাদ। সাথে এক দঙ্গল গাছপালা। দূরে খাগড়াছড়ি শহর। লাল-নীল বাতির ঝিলিক। রাতের পাখীদের ডাক শোনা যাচ্ছে। তক্ষকের ডাক ভীতি ধরালো। শৈলী পারলে আমাকে জাপটে ধরে। আমি বললাম, “সো ফার সো গুড। লেটস টেক এ ইউ টার্ন”। তাদেরকে উপরে উঠিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে মোবাইলে নিউজ ফিড দেখছিলাম। শৈলীর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। সাথে ফোন, “কাল আমরা আলুটিলা কেভ দেখতে যাবো”
— আংকেল-আন্টিও যাবেন?
— উনারা না গেলে আপনার সুবিধে হয়?
— না, তা কেন হবে? ওখানে যেতে হলে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে উঠতে হবে।
— আপনি নামতে পারবেন কিনা তাই বলেন
–পারবোনা কেন?
— আপনি যে ভীতুর ডিম। এজন্যই আপনার কিছু নেই
— কিভাবে বুঝলা?
— মেয়েরা সব বুঝে।
— তাই?
— হুম্ম।
— আচ্ছা থাকো তুমি তোমার বুঝাবুঝি নিয়ে। আমি এখন ঘুমাবো
— জ্বী না। আজ রাতে আর ঘুমুতে দিচ্ছিনা আপনাকে।

শৈলীর সাথে এ কথা সে কথায় অনেক রাত হয়ে গেছে। সকালে উঠতে তাই দেরি হয়ে গেল। আলুটিলার কাহিনী অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগেরবার এলেও আমি কেভ দেখতে নামিনি। সেখানে যেতে হলে কিছু প্রস্তুতি লাগে। আমাদের সেগুলো ছিলো না। হাতে সময়ও ছিলো না। এবার অন্তত পায়ে কেডস আর পড়নে ট্র্যাক স্যুট আছে। শৈলীরও। এ সাজে তাকে দেখবো ভাবিনি। আসলে কিছু মেয়ে আছে যাদেরকে আটপৌরে কাপড়েও মেনকা লাগে। শৈলীও তাই। মশাল হাতে কেভ এর ভেতর অগ্রসর হচ্ছি অন্যদেরকে অনুসরণ করে। শৈলী এক হাতে আমার এক হাত ধরে রেখেছে। নীচে ছড়ার পানি। তার নীচে বিভিন্ন সাইজের পাথর। হঠাৎই স্লিপ কেটে ভারসাম্যহীন হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি অপ্রস্তুত। বললাম, “আমি না ধরলে তো চিৎপটাং খেতা”। “ জ্বী না। এত বাহাদুরী নিয়েন না। আমি তো ইচ্ছে করেই ওটা করেছি। আপনি বুদ্ধু। বুঝতে পারেন নি” বলে সে কি হাসি শৈলীর! আমি আরেকবার লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেলাম।

শৈলীদেরকে বিদায় দিতে সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কারণ কি? অনেক চিন্তা করেছি। কিছু উত্তরও দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু যুতসই হয়ে উঠেনি কোনটাই। তবে কি শৈলীর ‘স্মৃতি ছাপ’ হৃদয়ের প্যান্ডুলামে দোলা দিয়ে গেলো?

চলবে…