আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
(১২)
জামান ভাইয়ের এখন রমরমা অবস্থা। হেড অফিসে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এরিমধ্যে বিদেশেও ঘুরে এসেছেন। আরেকটি প্রকল্পের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাক্তির দায়িত্বও পেতে যাচ্ছেন। বললাম, “ভাই বিয়ে করে ফেলেন এখন”। তিনি হাসলেন। বললেন, “দেখা যাক”। তার এই ‘দেখা যাক’ শব্দটা কানে বাজলো। বিয়ের বিষয়টি যিনি তার ডিকশনারী থেকে বাদ দিয়ে ফেলেছিলেন তিনি এখন তা যুক্ত করতে চাচ্ছেন বলে মনে হলো। বললাম, “ভাই, পুরোনো বিষয়ে নতুন কোন ডেভেলপমেন্ট আছে কি”? হাসলেন। বললেন, “ওয়েট এন্ড সি”। আমি আগামাথা কিছু না বুঝেই তাকে অগ্রীম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। ঢাকায় যাওয়ার পর জীবন যাত্রায় কি-রুপ পরিবর্তন হয়েছে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, “গতি বেড়েছে। পলিউশন ডাইজেস্ট করতে হচ্ছে। আর কি যেন নেই বোধ হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে এরকম ছিলো না। একধরনের নির্জনতা ছিল। তবে ‘নেই নেই’ ক্ষেদ ছিলো না। যা ছিলো তা একান্ত ব্যক্তিগত শূন্যতা”।
তার পর্যবেক্ষণ যথার্থ। নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত আমাদের কাছে পাহাড়, নদী, বন শ্বাস ফেলার উপযুক্ত জায়গা। চারিদিকের এই নিসর্গ আর এই পিন্ পতন নিরবতার মাঝেও পাখপাখালি আর ঝর্ণাধারার চাঞ্চল্য কাউকে বিরক্ত না করে মনোহারী রুপ নিয়ে বসে আছে। ভাল লাগে চুপ করে শুয়ে, বসে সময় কাটাতে, দৃষ্টি প্রসারিত করে চক্ষু শীতল করতে। হাঁটু জলে নেমেও ঝর্ণাধারায় অবগাহনে অশেষ তৃপ্তি বোধ হয়। চারিদিকের সুনির্মল বায়ু পাহাড়ের চূড়ায় ধাক্কা খেয়ে কোথা থেকে যেন একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে। তাতে প্রাণ জুড়ায়। মন হারায়। আবার কাউকে বিষন্নতা গ্রাস করে। পাহাড়ে, সমুদ্রে, বনে একাকী জীবনযাপনে, পরিভ্রমণে তুষ্টি মেলেনা। কেবলই মনে হয় ‘কি যেন নেই’, ‘কি যেন নেই’? জেমি নেই। নির্জনতার এই প্রহর তাই আর কাটেনা। প্রতিদিন একঘেয়েমিতে পেয়ে বসেছে। আর রাত হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।
রাতে যথারীতি শৈলীর ফোন, “স্যার, কি করছেন”?
— কিছুনা। শুয়ে আছি
— শুয়ে কি করছেন
— আকাশের তারা দেখছি
— তারার মধ্যে এত কি আছে দেখার?
— কেন? অসুবিধে কি?
— অসুবিধে কিছু নাই। তবে লক্ষ্মণ ভাল মনে হচ্ছেনা
— কেন?
— জিনিয়াস আর পাগলরাই তারা দেখে, গুনে, নিরীক্ষা করে
— আমি পাগল না
— তাই বলে জিনিয়াসও না
— কথা প্যাচাচ্ছো। আসল কথা বলো। কেন ফোন দিয়েছো? কি যেন সারপ্রাইজ দিবে বলেছিলা
— আমরা পরশু ভোরে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো
— হঠাৎ? তাও আবার খাগড়াছড়ি?
— বারে। আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে না। এরপর তো ভর্তি যুদ্ধ।
— কোন হোটেলে বুকিং দিয়েছো?
— হোটেল না। রেস্ট হাউস। আব্বুর এক পরিচিত উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। তাদের রেস্ট হাউসে।
— ভাল
— আপনি হবেন আমাদের গাইড
— আমার অফিস আছে। তাছাড়া তোমার আম্মার সামনে আমি ইজি না
— সেগুলো ফাইনাল হয়ে গেছে। সাজেক যাবো। আর কোথায় যাওয়া যায় আপনি ঠিক করে রাখবেন। আব্বুকে
বলেছি। আব্বু রাজী।
— আচ্ছা দেখা যাবে।
— জ্বী, এবার আমার পাওনা আদায় করে ছাড়বো
— মানে কি?
— এলেই টের পাবেন
— বাড়াবাড়ি দেখলে আমি থাকবোই না। ছুটি নিয়ে ঢাকা চলে যাবো
— ভয় পেলেন? ভীতুর ডিম।
এই একই কথা জেমিও বলতো। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ফোন রেখে দিলাম। আচ্ছা বিপদেই পরা গেল দেখছি।
ঢাকা বাসার অবস্থা নরমাল। কারফিউট তুলে নেওয়া হয়েছে। সেলিম এখন ড্রয়িং আর ডাইনিং রুম অবধি বিচরণ করে। আম্মার সাথে বেশ কথাবার্তাও বলে। কফি বানিয়ে খাওয়ায়। মাঝে মধ্যে তার স্পেশাল রেসিপিও ট্রাই করে। আম্মার মতে ওর নাকি অনেক গুণ। আমি হাসি আর শংকিত হই এই ভেবে যে, আবার না গায়েব হয়ে যায়। বড় মামার উদ্যোগে স্থানীয় থানার সহায়তায় টাকা পয়সা দেনা-পাওনার বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। সাভারের দোকানের সালামী বাবদ দেওয়া টাকার সিংহ ভাগ ফেরত পাওয়া গেছে। বাকীটা আর পাওয়া যাবে না। থানার মামলায় দু’পক্ষের আপোষরফা হয়েছে। তবে আদালতের এখতিয়ার বিধায় সময় লাগছে এই যা। টাকা আদায়ে আমার চাচাত ভাইয়েরা পলিটিক্যালি দারুন ভূমিকা রেখেছে। আজকাল এই তরিকা খুব কার্যকর। সব শুনে খুব খুশি খুশি লাগছে। আম্মার চিন্তা তবু যায় না।
সবার সবকিছুই গোছগাছ হয়ে যাচ্ছে। আমারই সব অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। জেমিকে খুব ফিল করছি। ফোন বন্ধ। একমাত্র উপায় ইলমা। আমার এই ছাত্রীটি কেন যে এত বৈরি হয়ে গেলো আজো বুঝে উঠতে পারিনি। একদিন রিক্সায় করে ঘুরতে নিয়ে যায়নি বলেই এত বৈরিতা? এত ছোট মেয়ে কখন যে ভেতরে ভেতরে এত ম্যাচিওরড হয়ে উঠেছে বুঝতে পারিনি। যা থাকে কপালে বলে ফোন দিলাম। রিং হলো। ইলমাই ধরলো, “কেমন আছেন”? প্রথমেই ‘স্যার’ শব্দটা উচ্চারিত না হওয়ায় মনটায় খট্কা বাধলো। বললাম, “কেমন আছো”?
— যেমন রেখেছেন। ইলমার নৈর্ব্যক্তিক উত্তর।
— বাসার সবাই ভাল?
— স্পেসিফিক কার সম্মন্ধে জানতে চাচ্ছেন
— এই ধরো সবাই। তোমার আব্বা-আম্মা
— উনারা ভাল নেই
— কেন?
— তা আপনিই ভাল জানেন
— মানে?
— আম্মু আপনাকে ফোন দিতে নিষেধ করেছে না?
— সে তো জেমিকে করতে নিষেধ করেছেন
— বলেন কি জানতে চান?
— তুমি ভাল আছো?
— জ্বী। যদিও জানি সেটা আপনার উদ্দেশ্য না ।
— তা না হলে ফোন দিলাম কেন?
— আপুকে পাচ্ছেন না তাই। পেলে করতেন না
— তাই?
— অবশ্যই। আপু অসুস্থ। আন্ডার ট্রিটমেন্ট
— কেন কি হয়েছে?
— তাও আপনি ভাল জানেন। আর হ্যা, আপনাকে বলতে ভুলেই গেছি দুলাভাই দেশে এসেছেন। একটু সুস্থ হলেই
আপুকে কানাডা নিয়ে যাবেন।
— আচ্ছা।
— আর ফোন না দিলেই খুশি হবো। আম্মু জানলে আমাকে ছাড়বেনা।
মনটাকে আর কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছিনা। বুকের ঠিক মাঝখানে কাঁটা বিধার মত অনবরত খচ্ খচ্ করছে। জেমির উপর খুব রাগ হচ্ছে। একটি বারের জন্যও কি ফোন দেওয়া যায়না? অথবা ম্যাসেজ টেক্সট করা যায় না? নাকি কানাডার বাতাস তাকে দুলিয়ে দিয়েছে? জানিনা। এরকম ভাবতেও কষ্ট হয়। স্বস্তির কোন জায়গা নেই যেখানে গিয়ে হাল্কা হওয়া যায়।
এশার নামায জামাতে আদায় শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসলাম। অপরাপর মুসুল্লীরাও গোল হয়ে বসেছে। স্বল্প বয়ান হবে। আজকের বয়ান আত্মহত্যা ও পরকীয়া নিয়ে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আবার শোনার আগ্রহও হচ্ছে। এক চিত্রনায়কের শ্বশুরের লাইভে এসে আত্মহত্যা প্রসঙ্গে বয়ান চলছে। হতাশা, অস্থিরতা, আস্থাহীনতা এবং ধর্ম ও ভাল মানুষের সহবতহীনতা থেকেই মানুষজন এ ধরণের চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ভদ্রলোকের কলেমার জ্ঞান ছিলো, আত্মহত্যা যে কবীরা গুনাহ তার জ্ঞানও ছিলো কিন্তু পরিণতি কত মর্মান্তিক। আখেরের ফয়সালা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। আত্মহত্যার আরেকটি কারণ হলো প্রেম, নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশা, ব্যাভিচার ও পরকীয়া। ইমাম সাহেব কোরআন, হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। সবই জানা কথা। তবু মানুষ ভুল করে। ভুল পথে আকৃষ্ট হয়। বয়ান শেষে হুজুরের কথা, “যুবক ভাই যারা আছেন, তাদেরকে বলি। কাউকে ভাল লাগলে শরিয়াহ্ মতে বিয়ে করে ফেলুন। শয়তানের ওয়াস্ ওয়াসায় পড়বেন না”। কথাগুলো শোনার সময় হুজুরের চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলাম। বয়ান শেষে সবাই সালাম বিনিময় আর মুসাফাহা করে যে যার মত চলে যাচ্ছে। আমিও এগিয়ে গিয়ে করলাম। হাত তালুবন্দী রেখে বললেন, “বাবাজী, এখন কেমন আছেন”? বললাম, “আলহাম্দুলিল্লাহ”। তিনি হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আর বলছেন, “আসেন। আল্লাহ্ কিসমতে যা রেখেছেন তা দিয়ে একসাথে খানা খেয়ে নেই”। বসবো না বসবোনা করেও বসতে হলো।
চলবে…