আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
(১১)
সেলিম স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করায় দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব হলেও খাগড়াছড়িতে তার আবির্ভাবে খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছিনা। প্রথমত বোনের হাসবেন্ড হিসেবে রুমমেটরা হাই-হ্যালো, খায়-খাতির ইত্যাদিতে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে। তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু কখন কি বেফাঁস বলে বসে তারও ভরসা নাই। দ্বিতীয়ত তার সাথে কাজের কথা বলতে পারছিনা। সারাদিন থাকি অফিসে। সন্ধ্যার পর বাসায়। সেখানে অন্য রুমমেটরাও থাকে। থাকে বাবুর্চিও। ক্রান্তিকালীন সাংসারিক আলাপ আলোচনা , বিশেষত সার্কাস টাইপের সম্ভাব্য হাই ভোল্টেজ ডায়ালগ করার মত পরিবেশও পাচ্ছিনা। বাইরে ঘুরার নাম করে রাতে রেস্তোরাঁয় বসেও বিশেষ সুবিধে হচ্ছেনা। প্রশ্ন করলে মিনিট দুই পর এক শব্দে দ্ব্যর্থবোধক উত্তর আসে। স্পষ্ট করতে সম্পূরক প্রশ্ন করতে হয় তিনটা। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরে পাশ কেটে যায় বা নিরুত্তর থাকে। মেজাজ ধরে রাখা কঠিন।তার আসল মোটিভ কি তাও জানতে পারছিনা।
সারাদিন বাসায় থেকে লম্বা লম্বা ঘুম দিচ্ছে। ভাবছি বলে কয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেই। যদিও এতে অবস্থার আরো অবনতি হবে। সেও যেতে রাজী না। আম্মাও ঢাকা বাসায় তার এন্ট্রিতে রাজী না। মলি বাসায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে দিয়েছে। বড় মামা পিস্তল শানাচ্ছেন। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।মান-সম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। সমস্যা হয়েছে, সেলিম কোনভাবেই তাদের বাড়ীতে যাবেনা। তার কোন আত্মীয়ের বাসাতেও না। ফোনে মলিকে পাওয়া যায় না। আম্মাকে বলে দিয়েছে আমাদের দু’জনের কারো সাথে কথা বলবে না। তার মেজাজ গরম,কেন আমি সেলিমকে জামাই আদর করে জায়গা দিয়েছি? সেলিমকে বললাম ফোন দিতে। কান ধরে এমন ভাব করলো যেন এর চেয়ে ডাইরেক্ট কনডেম সেলে কারাবাসে যাওয়াও তার জন্য সহজ। বললাম, “তোমার মোবাইল কই”? উত্তর শুনে আমি হাসবো না কান্না করবো নাকি ঠাস করে দু’গালে দু চড় মারবো বুঝতে পারছিনা। মোবাইল নেই। নেই মানে নেই। এই এক উত্তর। তাহলে গেল কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর বের করা সম্ভব হয়নি। ধরে নিয়েছি, হয় ছিনতাই হয়েছে, নয়ত বিক্রী করে পুঁজির ক্রাইসিস মিটাচ্ছে। আম্মাকে আর ছোট মামাকে অনেক বলে কয়ে ম্যানেজ করলাম। আমার চাকরি ও মান-ইজ্জতের খাতিরে হলেও তাকে এখান থেকে অন্যত্র শিফট করা দরকার। হাজার পাঁচেক টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে নাইট কোচে তুলে দিলাম। সাময়িক সমাধান হলো বলে কিছুটা স্বস্তি পেলেও হঠাৎ মনে হলো সে যদি বাসায় না গিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে আবার ঘাপটি মারে? এতক্ষণ মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছিলো আর এখন প্রচন্ড ব্যাথা করা শুরু করে দিয়েছে। কোন ফ্যামিলিতে এরকম এক পিস থাকলেই যথেষ্ট। এক জেনারেশনে আর শান্তির মুখ দেখা লাগবেনা। ওকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় এসেই মনে হলো ছোট মামাকে বলি ভোরে তাকে যেন রাসেল স্কোয়ারের কাউন্টার থেকে এসকর্ট করে নিয়ে বাসায় হাওলা করে দেয়। ছোট মামা শুনে হাসলেন। বললেন, “বড্ড বিপদেই পড়া গেল দেখছি তাকে নিয়ে”।বড় মামা হলে ফোনেই শাউটিং করা শুরু করে দিতেন।
খুব ভোরে উঠে মনে হলো সেলিম যদি অন্য কোন মতলবে বাসায় না যাবার জন্য আরামবাগ স্টপেজে নেমে পড়ে? ছোট মামাকে বললাম। কথা সত্য। তাকে আরামবাগ কাউন্টারে ব্যাগ হাতে নামতে দেখা গেল। “এখানে কেন” জিজ্ঞেস করতেই তার উত্তর “এখানে এক বন্ধুর বাসায় দেখা করে পরে যেতাম। কিছু টাকা পাই ওর কাছে”। মামা তাকে কোন সুযোগ না দিয়েই গাড়ীতে উঠিয়ে সোজা বাসায় আম্মার হাওলা করে দিয়েছেন। এর পরের কাহিনী নাটকীয়। নারকীয়ও। প্রথমত মলি ঘুমে ছিলো। রুমের দরোজা লকড। দ্বিতীয়ত কারফিউ ব্রেক করে সে হাজির হয়েছে। তাই ঘুম থেকে তুলে ফেরারী আসামীকে তার সামনে হাজির করালে সাংঘাতিক বিপদ ঘটতে পারে। তার আপাতত ঠিকানা আমার রুম। এভাবেই আম্মা ব্যবস্থা করে তার জন্য নাস্তা তৈরি করতে কিচেনে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ পর তুমুল হট্টগোলে আম্মা কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সেলিম আমার রুমে নেই। মলির রুম লকড। রুমের ভেতর মলির গলা চড়ানো বাংলা সিনেমার হাইভোল্টেজ নন স্টপ মনোলগ বর্ষণ চলছে। আর কোন কন্ঠ শোনা যাচ্ছে না। আম্মা চুলা নিভিয়ে বুয়াকে বিদায় দিয়ে বিছানায়। আমি অসহায়।
ঘন্টাখানেক পর বাসার খবর নিতে ফোন দিলাম। বললাম, “বাসার পরিবেশ এখন কেমন”?আম্মা এমন একটা ভাব করলো যেন “অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট”। আমি বললাম, “কেমনে কি হলো”? আম্মা হেসে বললো, “দুটোই তো পাগল। এই ফাটাফাটি, এই মাখামাখি। দেখলাম মলি নিজে নাস্তা বানিয়ে রুমে বসে দু’জনে মিলে খেলো”। বিস্ময়ে আমি হতবাক। পরক্ষণেই ভাবলাম, এরই নাম প্রেম। মানুষের ভুল হতে পারে, দোষ থাকতেই পারে, বিচ্যুতিও হতে পারে। কিন্তু সাচ্চা প্রেম সব কিছু মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলে।
হঠাৎই শৈলীর ফোন, “স্যার,দারুণ সারপ্রাইজ আছে। রাতে ফোন দেবো। ধইরেন”। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে ফোন রেখে দিলো। কিসের সারপ্রাইজ? আর এখনই বা বলা গেল না কেন? টিন এজ বালিকাদের বুঝা খুব কঠিন। এদের মনের ব্যারোমিটারের ভেতর পারদ থাকেনা। থাকে ঈথার। সেই ঈথারে উল্টো পাল্টা ঢেউ লাগলেই মনের নাচন শুরু হয়ে যায়। তখন কাউকে ভালবেসে দিল ফানাফানা, নয়ত তুই-তুকারি থেকে যাচ্ছেতাই। কিন্তু আমাদের তো সে সম্পর্ক না। মাথা ঝিম ঝিম করছে। মানুষকে আল্লাহ যে কত শক্তপোক্ত করে সৃষ্টি করেছেন তা বহুর্মুখী অবস্থায় পড়ে এখন বুঝছি।
একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। পড়াবার এক ফাঁকে শৈলিকে বেশ আনমোনা দেখে বলেছিলাম, “কি ব্যাপার? পড়ায় মনে নেই যে। কী ভাবছো”? বল পয়েন্ট কামড়াতে কামড়াতে দুষ্টুমাখা হাসিতে বললো, “শুনবেন”? মাথা নাড়লাম। বললো, “না থাক। আপনি লজ্জা পাবেন”।
— কেন? লজ্জা পাবো কেন? আমার প্রশ্ন।
— কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি
— আর এখন পড়ালেখা বাদ দিয়ে বসে বসে সেটাই ভাবছো?
— হুম্ম
— বেশ তো। পাগল আর কাকে বলে
— পাগলই তো
— কে?
— কে আর? আমি। তবে আপনিও
— আমি কিভাবে?
— পাগলদের পরিপূর্ণ সেন্স থাকেনা
— তোমার আছে?
— না। তাই তো ঝামেলা
— তা কি স্বপ্ন দেখলা?
— দেখলাম, আমি আর আপনি কোথায় যেন গেছি। সমুদ্রও আছে। আবার পাহাড়, জঙ্গলও আছে।
— তারপর?
— জঙ্গল পেড়িয়ে ছড়া পাড় হতে গিয়ে পড়েছি সমস্যায়
— কি সমস্যা?
— ছোট্ট ডিঙ্গীতে করে পেরোতে হবে
— এতে সমস্যা কি?
— সেখানেই তো সমস্যা। আপনি সেই ডিঙ্গীতে কিছুতেই উঠতে চাচ্ছেন না।
— তারপর?
— তারপর আর কি? আপনি ধমক দিয়ে বললেন, কই, লিখছোনা কেন? অমনি স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
শৈলীর এই স্বপ্নের অর্থ কি আমি বুঝি। কিন্তু আসকারা পেয়ে যাবে ভেবে বললাম, “স্বপ্নে তোমার সাথে ওটা আমি না অন্য কেউ ছিল। আজেবাজে চিন্তা বাদ দাও। এভাবে আনমোনা হলে আমি চলে যাবো কিন্তু”। শৈলী এতে মর্মাহত হলো। রাতে শৈলী আবার ফোন দিলো। সাধারণত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ফোন দেয় না। তবে পরীক্ষার আগে কোন কিছু ক্লিয়ার করার জন্য রাতে এর আগেও কয়েকবার ফোন দিয়েছে। ধরলাম, “বলো,কি বলবা”?
— স্যরি
— কেন?
— দু’কারণে
— যেমন
— আপনাকে আজ পাগল বলেছি।
— লিভ ইট। আর কোন কারণ?
— আমার স্বপ্নটা মাথা থেকে সরাতে পারছিনা
— কেন?
— জানিনা
— আজেবাজে স্বপ্নের কোন মানে হয়না। খেয়ে ঘুমিয়ে পরো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
— আপনি স্বপ্নটাকে তো পাত্তাই দিলেন না।
— এনাফ ইজ এনাফ। জাস্ট স্টপ ইট।
কথাগুলো শৈলীর মোটেই মনপুত হলোনা। বললো, “স্বপ্নটা মোটেই আজেবাজে ছিলো না। আপনিই আজেবাজে ভাবছেন”।
চলবে…