আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১)

Photo of author

By Anwar Hakim

  • আজিমপুর টু উত্তরা
  • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
  • আনোয়ার হাকিম।


শ্রোতব্যঃ
(গল্প লেখার ঝক্কি অনেক। তাও আবার উত্তম পুরুষে লেখায়। এর বাইরে প্রায়শই যে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় তাহলো, গল্পের আকার আর ফিনিশিং নিয়ে। গল্পের আকার একটু বড় হলে বেশির ভাগ তরুণ পাঠকই অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠে আকার কমাতে। আবার একদল আছে যারা ছোট লেখা পড়ে বলে বসে, এরপর? অন্যদিকে অনেকেই, বিশেষত মেয়েরা গল্পের হ্যাপী এন্ডিং পছন্দ করে। অন্যরা চান ঘটমান বাস্তবতার মত ‘পাইয়াও হারাইবার বেদনা’। মূলত ট্র্যাজিক এন্ডিংই কমবেশি সবার হৃদয় স্পর্শ করে যায়। এই দুই টানাপোড়েনে কলম ধরতে বড় সংশয় জাগে।
এই গল্পটি তাই উভয় প্রকার পাঠকের চাহিদাকে সম্মান দিয়ে লেখা। গল্পটি বড়। তবে পর্ব করে একূল- ওকূল দু’কূল রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। আবার গল্পের এন্ডিং নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত আছি। তাই একটা ‘সমাপ্তি পর্ব’ ঠিক করে রেখেছি সত্য। তবে পর্ব চলাকালীন পাঠকদের মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা দেখে ভিন্ন চিন্তাও করা যেতে পারে। আপাতত কৈফিয়ত আকারে এটুকুই থাক)।


(১)
বাসার আবহাওয়া খুব গরম। অনেক দিন হলো আম্মা বেজায় রেগে আছেন। প্রায়ই বাসায় এরকম গরম গনগনে মৌসুমি আবহাওয়া বিরাজ করে। এবার প্রলম্বিত। আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার একমাত্র কারণ আমি। আম্মার ইচ্ছে আমি বিসিএস দেই। আমার সাফ উত্তর ‘না’। আমি চাই ব্যবসা করতে। আম্মার এক কথা ‘কভি নেহি’। সকাল থেকেই শুরু হয় আম্মার চিল্লাচিল্লি, “মরার আমার হয়েছে জ্বালা। দামড়া পোলা দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। কাম নাই, কাজ নাই। ধান্ধাও নাই, চিন্তাও নাই”। আমার ঘুমে ব্যাঘাত হয়। বালিশ কান চাপা দিয়েও ঘুম জমাতে পারিনা। থেকে থেকে আম্মার চোখা চোখা কথা কানে আসে। আর মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়। বারোটার দিকে সকালের নাস্তা করতে গেলেই দিনের প্রথম বোমা ফাটা শুরু হয়। সঙ্গত কারণেই লাঞ্চের সময় হয় বিকেলে। সেটা অবশ্য বাইরেই সেরে নেই। আর বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই রাত এগারো-বারো। খেতে খেতে রাত একটা। তখন শুরু হয় আম্মার বোমা ফাটানোর ক্লোজিং সেশন।


টিউশনি করি দু’টা। একটা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রীকে। ম্যাথ আর কেমিস্ট্রি। এইট স্ট্যান্ডার্ডের। নাম ইলমা। আরেকজন পাবলিক স্কুলের ছাত্রী। আগামী বছর ইন্টার দেবে। নাম শৈলী। টিউশনি করে যা পাই তা হাত খরচ হিসেবে যথেষ্ট। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের পক্ষে যৎসামান্য। আমার আবার স্টুডেন্ট ভাগ্য ভাল। এমনিতেই ওরা মেধাবী, তার উপর ফিনানশিয়াল কন্ডিশন সেইরকম সাউন্ড। তবে দু’টোতেই দু’ধরণের অস্বস্তি রয়েছে। ইলমা খুব কিউট, স্মার্ট ও স্টুডিয়াস। কিন্তু তার বড় বোনের দীপিকা পাডুকোন লুক মাথা আউলা ঝাউলা করে দেয়। তার নাম জেমি। প্রায়ই টিউশনি শেষে তার সাথে শর্ট সেশন হয়। সে অনেক কথা। টক ঝাল মিষ্টির। টিউশনির প্রথম দিনেই তার ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হলাম। আর দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলাম। এটা কি চাকরির ইন্টারভিউ নাকি পাত্রের বায়োডাটা ভ্যালিডেশন? ইন্টারভিউয়ের মাঝেই এক কিউটি এসে ঝামেলা শুরু করে দিল। জেমি কিছুটা লজ্জায় কিছুটা রেগে তাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আমি ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই পিচ্চি তোমার কে হয়”? “আমার নিস, বোনের মেয়ে” ইলমার উত্তর। আমার আউলা মাথায় যেন কারেন্টের শক খেলাম। যাহোক, সেই জেমির কাহিনী সিনেমার কাহিনীর মত। অল্প বয়সে এফেয়ার করে বিয়ে করেছে যাকে সে জনকের চিহ্ন রেখে দেশান্তরি হয়ে গেছে সেই কবে। প্রথমে মালয়েশিয়া, তারপর কম্বোডিয়া। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। জেমিকে আমার খুব পছন্দ। পছন্দ করার মতই। চেহারায়, স্মার্টনেসে, কথাবার্তায়, চোখের নড়াচড়ায়, হাসিতে, রাগে, অনুরাগে, অভিমান-অপমানে সবকিছুতেই অপূর্বা। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলাম এভাবে। আর যায় কোথায়? সেই থেকে জেমি অনন্যা হয়ে দেখা দেয়। কোন দিন দেখা না হলে দিনটাই মাটি বলে মনে হয়। জেমিও ছাত্রীর গার্ডিয়ান হিসেবে আরো সক্রিয় হয়।
আমার অন্য ছাত্রী শৈলী। সে ভাবে সপ্তমী। কিন্তু তার মা রাগে অগ্নি। সারাক্ষণ পায়চারি করেন। আর ছুতানাতা করে দেখে যান আমাদের বিদ্যা শিক্ষার শব্দমাত্রা কাংখিত মাত্রার চেয়ে নিম্নগামী কিনা। আলাপের ফ্লাইট বই, খাতার বাইরে চোখে চোখে পরিভ্রমণরত কিনা? অসহ্য ঠেকে। তবে যে কোন মেয়ের মা’র এই উদ্বেগ থাকাটা অতি স্বাভাবিক, তাও উপলব্ধি করি। আবার মজাও পাই এই ভেবে যে, তাঁকে নিত্যদিন ঘন্টাখানেকের জন্য হলেও প্যারা দিতে পারছি। শৈলী ছাত্রী হিসেবে ভাল। রেজাল্টও। তবে খুব চঞ্চল আর দুষ্টু টাইপের। বয়সটাই তো এরকম। মাঝে মধ্যে আমার সাথে সিলেবাস বহির্ভুত ফ্ল্যাগ মিটিং করতে চায়। আমি সাবধানী। কায়দা করে ফোকাস ফিরিয়ে আনি পড়ালেখায়।


প্রতিদিনের মত আজো আম্মার চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুখের উপর তিন খন্ড কাগজ আর টাকা ছুঁড়ে মেরে বললো, “আজ লাস্ট ডেট। বিল গুলো দিয়ে আসবি”। চেয়ে দেখি গ্যাস আর কারেন্টের বিল। সাথে সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের তাগিদ পত্র। এই ধরণের কাজ আমার একেবারেই নাপছন্দ। ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পিপীলিকার মত হাটি হাটি পা পা করে বিল দেওয়ার মত প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি আমাদের দেশেই বোধহয় পপুলার। অন লাইনে দিতে চাইলেও আম্মার চিল্লাচিল্লিতে চুপ হয়ে যাই।


আম্মা গরম গরম পরোটা এনে দিচ্ছে। ডিম মামলেট আর গরুর ভুনা আমার খুব পছন্দের। খেতে খেতে রাগাবার জন্য বললাম, “ব্যাংকের সাথে কথা পাক্কা হয়ে গেছে। দশ লাখ লোন নেবো”।
আম্মা চক্ষুচড়ক গাছ করে বললো, “তোকে কোন ব্যাংক লোন দেবে”?
— দেবে, দেবে। বাড়ী বন্ধক রাখবো
— বাড়ী কি তোর নামে?
— তোমার নামে। তাতে কি? তোমার নামেই নেবো
— এতই সোজা?
— বিজনেস করবো। দশ লাখ হলেই চলবে। ভাবছি ব্যবসা স্টার্ট করেই বিয়ে করে ফেলবো
— তোকে মেয়ে দেবে কে?
— মেয়ে তো স্ট্যান্ডবাই।
— তাই নাকি? তা কি করে সেই মেয়ে?
— কিছু না। একটা ছোট্ট কিউটি আছে তার।
— কি? এই বলে আম্মা চুলো নিভিয়ে বেডরুমের দরোজা লক করে দিলো। আজ আর চা মিলবেনা বুঝলাম।

চলবে…