আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
শেষ পর্ব
দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছে। বদলীর আশা ছেড়ে দিয়েছি। খাগড়াছড়িতে মনঃস্থাপন করার চেষ্টা করছি। ভাবছি পাহাড়ে এক খন্ড জমি কিনতে পারলে মন্দ হত না। সেটা নাকি অফিসিয়ালি সম্ভব না। শৈলী আরেকবার খাগড়াছড়ি , বিশেষ করে সাজেকে আসতে চেয়েছিলো। বলেছিলাম সাজেকে রাত্রিযাপন করলে সান সেটিং আর সান রাইজিং দেখার সুযোগ হবে। বলেছিলো আমি থাকলে সে আসবে। আমাকে ব্লকের মধ্যে ফেলে সে কি জিঘাংসা উপভোগ করছে জানিনা? ইচ্ছে ছিলো জেমিদেরকে এনে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো। সেটাও পরিত্যক্ত প্রকল্পের মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ইদানীং চেনাজানা লোকের আগমন নেই বললেই চলে। সারাক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকি এই বুঝি কেউ ফোন দিলো। হাই-হ্যালো করে বললো, “আসছি”। লালনের মন খারাপ। আর তৌহিদ নানাবিধ কাজে ব্যস্ত।
আজ ফজরের নামায জামাতে আদায় করলাম। মনে বড় তৃপ্তি। চারিদিকের সব কিছুই খুব সতেজ আর প্রাণবন্ত লাগছে। পাখ-পাখালীর ঘুম জাগানিয়া সুমধুর কলতান যুগপৎ কৌতুহল ও আফসোসের উদ্রেক করছে। একদিকে পাখীদের আলাপের মর্মার্থ জানার কৌতুহল হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের ভাষা বুঝিনা বলে আফসোসও হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারিদিকের নিসর্গ দেখছি আর ভাবছি দেখতে দেখতে কিভাবে ছাব্বিশ বসন্ত পার হয়ে গেলো! জীবনের চিত্র-বিচিত্র কত রুপ দেখলাম। কত মান-অপমানের খেলা দেখলাম। ভালবাসাবাসির এই রোদ, এই বৃষ্টিও দেখলাম অনেক। আপন মনেই হেসে উঠলাম। ভালোই হলো। টু বি ওর নট টু বি’র দোলাচালের পরিসমাপ্তি হয়েছে।
জেমি নারী। আবেগ তার জন্য সহজাত। প্রেম তার জন্য অলংকার। বাস্তবতা তার জন্য নির্ধারিত নিয়তি। তার কথাই হয়ত সত্য। জীবন থেমে থাকেনা। মাঝে মধ্যে দম নেয় মাত্র। নতুন উদ্যমে দৌড়াবার জন্য। যারা দৌড়াতে পারেনা তারা হারিয়ে যায়। জেমির ভবিতব্য জেমি নিজেও জানেনা। সেটা নির্ভর করছে অনেক সমীকরণের উপর। নিজেকে সে ভেবে নিয়েছে ছিটমহলে আটকে পড়া একজন উদ্বাস্তু হিসেবে। শৈলী রঙ্গীন প্রজাপতির মত হাওয়ায় উড়ছে। বয়সটাই তো এমন। উড়তে উড়তেই একদিন কোন ঠিকানায় থিতু হয়ে যাবে নিশ্চয়। আর সাবরিনা? ক্ষনিকের অতিথি সব সময় দোলা দিয়ে যায়। তার ভূত, ভবিষ্যতের গতিপথ অজানা। বাসা থেকে সাবরিনার কথা ছোট মামাকে বলা হয়েছে। মামা সাবরিনার সাথে আলাপও করেছেন। কি যেন একান্ত কিছু কথা আছে তার। সাবরিনা তা সাক্ষাতে বলতে চায়। ছিটমহলে আটকে পরা উদ্বাস্তুর ইচ্ছে ঘুড়ির নাটাই নিজ হাতে থাকেনা।
এখন সাহস করে প্রায়ই ফিল্ড ভিজিটে যাই। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি টেবিলের উপর কুরিয়ারের খাম। ঔৎসুক্য নিয়ে খুললাম।
সুজনেষু,
কোনদিন চিঠি লিখবো ভাবিনি। অনন্যোপায় হয়েই লিখছি। ধরে নাও কৈফিয়ত দিচ্ছি অথবা নিজের পজিশন ব্যাখ্যা করে দায়মুক্তি নেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছি। তোমার সাথে আমার পরিচয় পর্ব তেমন সুখকর ছিলনা। ইলমার বড় বোন হিসেবে টিউটরকে একটু পরখ করে নেওয়াই উচিত, তাই ইন্টারভিউ স্টাইলে তোমাকে বাজিয়ে নিয়েছিলাম। তোমাকে দেখেই আমি কেন জানি মনে মনে ‘সিলেক্টেড’ মার্ক দিয়ে রেখেছিলাম। কোন রকম ভণিতা না করেই বলি প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিলো। সে ভালোলাগা ছিলো নিছকই ভালোলাগা। কোনক্রমেই ভালোবাসা বা সিরিয়াস কিছু ছিলো না।
তুমি খুব ভাল। চেহারায়, স্মার্টনেসে আর সরলতায়। ইলমার মুখে তোমার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার মনটাও মোহিত হয়ে গিয়েছিলো। তাই পড়া শেষে তত্ত্বতালাশের বাহানায় তোমার সাথে আলাপের ব্যাকুলতা প্রশমন করতাম। ভাবতাম এভাবে আস্তে আস্তে মোহান্ধতা কেটে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো নেশাক্রান্ত হয়েছি আরো। তাই, নিত্যদিন অপেক্ষায় থাকতাম সেই বিশেষ সময়টুকুর জন্য। আম্মা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। নানাভাবে তার মিশ্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন। একজন মেয়ে হয়ে আমি তা ভালোই বুঝতে পারতাম।
মোহান্ধতা মানুষকে পাল্টে দেয়। মানুষ নিজেও বুঝতে পারেনা যে সে আবেশের ঘোড়ে রয়েছে। বুঝলেও হয় ইগনোর করে নয়ত এনজয় করে। মানুষের যেটাতে ঘাটতি সে সেটা পেলে সেটাতেই ডুবে থেকে সিক্ত হতে চায়। আমিও না জেনে না বুঝে সেরুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার যে একটা অতীত আছে সেটা তোমাকে বলা হয়ে উঠেনি। আসলে বলার সুযোগও হয়ে উঠেনি। সেটা ছিলো আমার প্রথম ভুল। অল্প বয়সী আবেগে ভেসে এক ছন্নছাড়াকে মনে করেছিলাম ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’র পারফেক্ট শাহরুক। তবে সে মোহ কাটতে বেশি দিন সময় লাগেনি। হঠাৎ একদিন সে উধাও। পাড়ি জমালো বিদেশে। বলতে পারো কারো কথা না শুনেই। সেখান থেকে আরেক দেশে। এরপর আর হদিস নেই। সেই কালো অতীতের উজ্জ্বল প্রমানক যে আমার কিউটি তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো। আমি তাকে নিয়ে অতীতকে ভুলে থাকতে চেয়েছি ভীষণ ভাবে। হয়ত ভেতরের সেই প্রবল চাপ হাল্কা করতে গিয়েই তোমার সাথে আলাপনের সূত্রপাত করেছি যেচে। এটি ছিলো আমার দ্বিতীয় ভুল।
সে যাহোক। অবাক হয়ে হয়ত ভাবছো তোমার ঠিকানা যোগাড় করলাম কি করে? আমার এক কাজিন ইউ এন ডি পি তে চাকরি করে। তার মাধ্যমেই এই ঠিকানা পেয়েছি। আমার ফোনের সেই সীম আর ব্যবহার করিনা। সামাজিক সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছি নানা কারণে। তবু তোমাকে না জানিয়ে এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাকে আমি মানসিক ভাবে নিতে পারছিলাম না। তাই কুরিয়ারের আশ্রয় নিয়েছি।
ইদানীং আমি ভীষণ মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এত বছর নিখোঁজ থাকার পর আমার কিউটির জনক বেশ কয়েক মাস যাবত কানাডা থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। এখন সে দেশেই। পুরুষ মানুষ যেমন ঘাড়ে চাপতে সময় নেয়না তেমনি পা ধরে বসে থাকতেও পিছ পা হয়না। আমরা মেয়েরা এখানেই বারবার ভুল করি । সে ভুলের দায় কি একান্তই মেয়েদের? বিতর্ক করার জন্য এটা উৎকৃষ্ট টপিক হতে পারে, কিন্তু লাভ কি? যে পুরুষ দায়িত্ব কি জিনিস বুঝেনা, শৃঙ্খলা কি জানেনা, সভ্যতা-ভব্যতা কি জিনিস তার পরোয়াও করেনা আখেরে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সে-ই আসে স্বামীত্ব ফলাতে। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তার ঔরসের গরিমা। আমি আর ভুলের ট্রেনে চড়তে চাইনা। তাই কিউটিকে নিয়ে টানা হেচড়া চলছে। আম্মাও সেই তথাকথিত সামাজিক অনুশাসনের পক্ষে গা ভাসিয়ে গো ধরে বসে আছে। আত্মীয় স্বজনরাও একাট্টা। জানিনা আমার কি করা উচিত। মাথা আর কাজ করছেনা। আমার পক্ষে দাঁড়াবার মত কেউ নেই। আমি বড় একা।
তুমি চলে যাবার পর একাকীত্ব পেয়ে বসে আমাকে। মনে হচ্ছিল কোথাও এতটুকু ছায়া নেই। নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। সারাদিন তবু কোন মতে কেটে যায়। কিন্তু রাত যত বাড়ে ঘুম তত পালায়। দুঃশ্চিন্তা আর বিষন্নতা এসে ভর করে। তখনি তুমি আসো। আমি প্রবল ভাবে তাড়াতে চাই তোমাকে মনের পর্দা থেকে। অনুভব করতে পারি ‘কাছের তুমি’র চেয়ে ‘দূরের তুমি’ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে আমাকে আরো গ্রাস করছো। তোমাকে জানাতে লজ্জার কিছু নেই। আমি মানসিক ট্রমার মধ্যে ডাক্তার বান্ধবীর কাউন্সেলিং এ আছি। আমার একমাত্র স্ট্রেংথ আমার কিউটি। আর আমার একমাত্র উইকনেস আমার ‘অতীত’ আর ‘তুমি’। আমি এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই। অতীত নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। পাস্ট ইজ পাস্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘তুমি’কে নিয়েই আমার যত যন্ত্রণা, হতাশা আর সংশয়। এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছি। ইলমা মাকে সব বলে দিয়েছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। গন্তব্যহীন অনিশ্চিত এই পথ চলা দু’দিন আগে হক আর পরে হোক দশ জনের চোখে পড়বেই। কিউটির বাবার পক্ষে সবাই একাট্টা হয়েছে। তারা উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে বেপথ থেকে পথে আনতে। আমার কথা কেউ ভাবেনা। নিজের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছে। জানিনা শেষতক কোথায় আমার গন্তব্য?
ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও। আমার জন্য ভেবো না। মেয়েদের নিয়ে এত ভাবাভাবির কিছু নেই। যে পাত্রে রাখা হবে সে পাত্রেই সে ধাতস্থ হয়ে যাবে। হয়ে যেতে হয়।
তোমার পক্ষে যেমন সাজেনা জীবন নিয়ে কোন এক্সপেরিমেন্ট। তেমনি আমার পক্ষেও শোভনীয় নয় চিত্ত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এমন কোন প্রজ্জ্বলন। শেষ করছি জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পুরোনো দিনের গান দিয়ে। কেন জানি ভাবতে ভালো লাগে গানের কথাগুলো যদি সত্যি হত।
পৃথিবীর যেখানে যত খাঁচার পাখী
উড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
কত ভাল হত।
হেলা ভরে ফেলে দেওয়াদের যতন করে কুড়িয়ে নেওয়া যেত যদি
কত ভাল হত।
কোথাও আলো সূর্য সমান কোথা চির অমানিশা
কোথা অগুণ্তি ধারা বহমান কোথাও মরুতৃষা
সে আলো সে জল সমানুপাতে ছড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
কত ভাল হত।
কোথাও শুধুই চাওয়া চাওয়া কোথাও পাওয়ার ক্রান্তি
কোথাও হিসাব নিজেই মিলে কোথাও শুধু ভুল ভ্রান্তি
ভুল হিসেবের ভুল চাওয়াকে ছড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
কত ভাল হত।
ইতি,
ছিটমহলে আটকে পরা উদ্বাস্তু, একজন জেমি।