Author: Anwar Hakim

  • জুলেখা বাদশাহর মেয়ে

    • জুলেখা বাদশাহর মেয়ে।
    • আনোয়ার হাকিম।

    ছোট বেলায় আধো আধো বোলে পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছবি প্রধান অনেক গল্প পড়িতে হইত। পড়িতাম আর নানারুপ কল্পনা করিতাম। তখন সব কিছুই মধুর আর রঙ্গীন লাগিত। সেইরুপ একটি গল্প হইলোঃ জুলেখা বাদশার মেয়ে। তার ভারী অহংকার। একদিন সে বাগানে গেল। দেখিল একটি মেয়ে ফুটফুটে চাঁদের মতো। জুলেখা কহিল,”কে তুমি ?এখানে কেন”? মেয়েটি কহিল,”আমি ফুলপরী। ফুলদের ঘুম ভাঙাই”। জুলেখা রাগিয়া গেল। কহিল, “আমার বাগানে আর আসিবে না”। মেয়েটি চলিয়া গেল। পরদিন জুলেখার বিবাহ। বাগানে ফুল ফুটিল না। পাখিরা গান গাইল না। জুলেখা কাঁদিতে লাগিল। এমন সময় ফুলপরী আসিল। কহিল, “তুমি কাঁদিতেছ কেন”? জুলেখা কহিল, “আজ আমার বিবাহ। কিন্তু আমার বাগানে কোন ফুল ফুটিল না, পাখিরা গান গাহিল না। তাই মনের দুঃখে আমি কাঁদিতেছি। তোমাকে চিনিতে পারি নাই। তুমি আমাকে মাফ করিয়া দাও”। ফুলপরী হাসিয়া উঠিল। সাথে সাথে বাগানে ফুল ফুটিল, পাখিরা গান গাহিল। জুলেখার মনও খুশীতে ভরিয়া উঠিল।

    ছবির সহিত বড় বড় হরফে মুদ্রিত এই গল্প পড়িয়া কত কি যে ভাবিতাম,কত কি যে মনে হইত তাহা বলিয়া বুঝানো যাইবেনা। এই গল্পের মোরাল কি ইহা লইয়া বিন্দুমাত্র ভাবিতাম না। বাবা, মা বুঝাইতেন যে অহংকার করা ভাল না। আজ এতকাল পর ইহার সহিত দৃশ্যমান কাব্যনাট্য মিলাইতে গিয়া সর্বত্র বিষম লাগিতেছে।

    আজকাল আগের মত আর রাজা, বাদশা নাই। থাকিলেও অতি অল্প। যাহারা আছে তাহারাও আগের সেই চমক, ঠমক লইয়া নাই। গুটি কয়েক অবশ্য আজো আছেন। তবে ইহাদের ইমেজ ঘৃণার উদ্রেক করে। সে যাহাই হোক, ইহা লইয়া আমার বিশেষ মাথা ব্যাথা নাই। আমি আন্তর্জাতিক জগত লইয়া মাথা ঘামাই না। দেশীয় সার্কাস দেখিয়াই কুল পাইতেছি না। আজকালকার জুলেখারা রুপে আঙ্গুর, মেকআপে ডানা কাটা। ইহাদের বংশে কেহই রাজা, বাদশা তো দূরের কথা নায়েব, কোতোয়াল পর্যন্তও ছিলনা। ইহাদের পূর্বপুরুষেরা হয়ত পুষ্টি দুর্যোগে ছিল হতশ্রী আর শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অনগ্রসর। তাহাতে কি? ইহারা এখন এক চিমটি পরিমাণ পুষ্টি পাইয়া আর এক চিমটি পরিমাণ শিক্ষা নামক এ প্লাস পাইয়া মেকআপ আর রুপের ঘুটা দিয়া বেশ করিয়া খাইতেছে। কম্পিটিটিভ মার্কেটে ইহাদের বেশুমার কদর। এক শ্রেণীর বেনিয়া ফকির ইহাদের ফেরি করিয়া বেড়াইতেছে। ইহাদের কাউকে অবিবাহিত কুইন বানাইয়া আবার কাউকে বিবাহিত প্রিন্সেস আখ্যা দিয়া ওপেন মার্কেটে ছাড়িয়া দিয়াছে। ইহাদের পিছনে অঢেল লগ্নি করিতেছে, বিভিন্ন প্লাটফরম খুলিয়া, বাহারি খেতাব ইত্যাদি দিয়া লগ্নিকৃত অর্থ পকেটস্থ যেমন করিতেছে তেমনি ইহাদের রস নিংড়াইয়া লইতেছে।আগেই বলিয়াছি আজকাল আমাদের এ ভূ-খন্ডে রাজা-বাদশা না থাকিলেও ভূঁই ফোঁড় অজস্র জুলেখার নিত্য জন্ম হইতেছে।প্রচারের গুণে আর যৌবনের ঝিলিকে জুলেখা আর পরীরা এখন একাকার হইয়া আকাশ জুড়িয়া ফানুস হইয়া শোভা বৃদ্ধি করিতেছে। দেহজ তৈল শেষ হইয়া যাইবার আগেই বৈরি বাতাসে ইহাদের দুলন মাত্রা ও পতন যাত্রা শুরু হইয়া যায়। ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের চক্রে ইহারা যতদিন অনুকূল বাতাসে থাকে ততদিন চারিদিক আলোকিত করিয়া রাখে। নীতি বাক্যের ফুল ঝুড়ি আর কীর্তির সার্কাস দেখিয়া আমজনতা চরম পুলক অনুভব করে আর চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া জিহ্বা লালায়িত করিয়া অজান্তেই বলিয়া উঠে, বাহ,বেশ তো। কতক কাল পর অংকের গড়মিলে বা ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের চক্রে পড়িয়া এই সব জুলেখা আর পরীদের আমল নামা জন সম্মুখে উদয় হয়। ইহার জন্য কোন গোয়েন্দা গিরি করিতে হয়না। সাংবাদিকদের কাহারো নিকট ধর্ণা দিতে হয়না। ইহারা নিজেরাই, ক্ষেত্র বিশেষে ইহাদের অতি নিকটস্থ বা সন্নিহিত আপন জনরাই এই সব তথ্য- চিত্র অডিও ভিডিও আকারে মার্কেটে ছাড়িয়া দেয়। জুলেখারা বাদশার মেয়ে। তাহাদের ভারি অহংকার।স্বভাবতই তাহাদের বাগানে পরীদের আগমনে ইহাদের গোস্বা,অপমান হইবারই কথা। পরীরাও কম কিসে? যাদুর স্পর্শে ইহারা বিরান ভূমিতে উৎপাদ উৎকীর্ণ করিতে পারে, পতঙ্গ আকৃষ্টকারী মন্ত্রে যে কাউকেই ধরিয়া, পোড়াইয়া, চিড়িয়া, ছিড়িয়া, ছাড়িয়া যাচ্ছেতাই করিতে পারে। অতএব জুলেখা আর পরীরা এখন সবাই শক্তিশালী। ইহাদের নিজ নিজ বলয় রহিয়াছে। সেই বলয়ে ইহারা ততদিনই সুরক্ষিত থাকে যতদিন ইহাদের সাপ্লাই সাইড অফুরান থাকে।রাজতন্ত্র,সামন্ততন্ত্র বিদায় লইয়াছে। গণতান্ত্রিক হাওয়া একচেটিয়া খেলিয়া যাইতেছে। তাই একজন জুলেখা আর একজন পরীর মধ্যে পার্থক্য ক্রমান্বয়ে কমিয়া আসিতেছে। ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের চক্রে যাহাদেরই অভিষেক হইতেছে তাহাদের মধ্যেই “কাহারো সহিত শত্রুতা নহে, সবার সহিত বন্ধুত্ব” জাতীয় আঁতাত লক্ষ্য করা যাইতেছে। করোনা অনেক কিছুই করিতে নিষেধ করিতেছে কিন্তু ইহারা ধরিতেছে, করিতেছে, খেলিতেছে, ছাড়িতেছে জাতীয় গোল্লাছুট খেলিতেছে। এখন জুলেখাদের বাগানে পরীরাও আসে। জুলেখারাও ইহাদের ডাকে সাড়া দেয়।ফুলের বাগানও বর্ষব্যাপী হর্ষোৎফুল্ল থাকে। কিয়ৎকাল ‘কোথাও কোন দুঃখ নাই’ জাতীয় একটা আবহ বিরাজমান থাকে। পাবলিক ইহাতে চিত্তসুখ, রতিসুখ পায়।বস্তুতঃ জুলেখা আর পরীদের হর্ষ-বেদনায় পাবলিকের বিনোদনে তেমন কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয়না।পাবলিক ইহাদের হাসি-কান্না আর কেচ্ছা-কাহিনীতে সাংবৎসর বেজায় আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকে। ইহারা লাইভে আসিয়া কত কথা যে বলে তাহার ইয়ত্তা নাই। দম্ভে,হাসিতে, হুমকিতে, ধমকিতে ইহাদের জুড়িনাই। আবার চোখের অশ্রু ঝড়াইয়া বিলাপ, প্রলাপ,শ্রাব্য,অশ্রাব্য বকাবাদ্য করার ক্ষেত্রেও ইহাদের অপুষ্ট রুচির প্রমাণ মেলে।

    এখন আবার ছেলে বেলার গল্প প্রসঙ্গে ফিরিয়া আসি। তখনকার সেই গল্পের মোরাল ছিল অহংকার করা ভাল না। পরিণাম অশুভ। আগে জাতপাত ছিল। এখন নাই। অহংকার এখন গ্লামার জগতের অলংকার। পতন অনিবার্য জানিয়াও ইহাতে কর্ণপাত করা আর বোকামির খেসারত দেওয়া সমার্থক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তাই, কে কাহারে লইয়া কোথায় ডুব মারিয়া, মোন্থণ করিয়া কি আহরণ করিতেছে, কোথায় কি স্থাপন করিতেছে ইহা জানিতে কাহারো ফেলুদা হইবার দরকার হইতেছেনা। সময়েই ইহা আপনা হইতে উদ্ভাসিত হইতেছে। ইউটিউবের কল্যাণে এই সব জুলেখা আর পরীদের অডিও, ভিডিও ক্লিপিংস তাই লক্ষ ভিউ পাইতেছে। পাবলিকের বিনোদন চাহিদা যেমন ইহাতে পূরণ হইতেছে তেমনি ইউটিউবারদের থলের আকারও স্ফীত হইতেছে। আর জুলেখা, পরীরা রোলার স্কেটারে চড়িয়া কখনো অসীম আকাশে ভাসিতেছে, কখনো মাটির কাছাকাছি নামিয়া কাদা ছোড়াছুড়ি করিতেছে। সবই তো ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের খেলা।

  • গনি মিয়া একজন কৃষক

    • গনি মিয়া একজন কৃষক।
    • আনোয়ার হাকিম।

    গনি মিয়া একজন কৃষক। নিজের জমি নাই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে। ছেলের বিবাহে সে অনেক ধুম ধাম করিল। গ্রামের লোকেরা অনেক ফুর্তি করিল। ইহাতে সে অনেক কর্জ করিল। সেই কর্জ আর সে শোধ করিতে পারিল না। গ্রামের লোকেরা বলিতে লাগিল গনি মিয়া কেন কর্জ করিতে গেল?

    উপরের এই গল্পটি কয়েক যুগ আগের। সবুজসাথী নামক প্রাথমিক স্তরের বইয়ে পাঠ্যভুক্ত ছিল। তখন পড়ার জন্য পড়িতাম। পরীক্ষার জন্য মুখস্ত করিতাম। বাবার পিটুনী হইতে রক্ষা উচ্চস্বরে বারংবার পড়িতাম। কিন্তু তখন ইহার বিশেষ মানে বুঝিতাম না। মাস্টার মশাই ও বাবা শুধু এইটুকু বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে কর্জ করিয়া ঘি খাওয়া অনুচিত। ইহাতে গরীব হইতে হয়। পরিণামে কষ্টে পড়িতে হয়। আমার মাথায় অতশত ঢুকিত না। কেবলই মনে হইত ইহা গনি মিয়ার একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়। তাই ইহা লইয়া অধিক মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নিষ্প্রয়োজন।

    যুগ পাল্টাইয়াছে। যুগের এক্সেলেটরে পা রাখিয়া গনি মিয়ারাও মডার্ন হইয়াছে। সেই গল্প এখন পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাস বহির্ভূত হইয়াছে। ইহার কোন হার্ড কপি আজ যাদু ঘরেও পাওয়া যাইবে কিনা সন্দেহ। তবে কর্জ করার অভ্যাসী গনি মিয়াদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়িয়া চলিয়াছে। সঙ্গত কারণেই ইহারা আর আগের সেই গনি মিয়া নাই। আগের সেই দাদন ব্যবসায় এখন আর তেমন প্রসারও নাই। কর্জের টাকার জন্য গনি মিয়াদের এখন আর অশিক্ষিত, চামার টাইপের দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হইতে হয়না। ইহাদের চক্র বৃদ্ধি সুদ পরিশোধের তাগাদার তাড়া খাইতে হয়না। ইহাদের স্থলে সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকসমূহ কর্পোরেট সরাইখানা খুলিয়া লইয়া বসিয়া আছে। গনি মিয়ারা ফ্রন্ট ডোর অথবা ব্যাক ডোর দিয়া সেই অর্থলগ্নিকারী সরাইখানাগুলোতে বুক ফুলাইয়া এসি’র বাতাস খাইয়া আপ্যায়ন ইত্যাদিতে সম্মানিত হইয়া আন্ডার হ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড কারবার সারিয়া মিলিয়ন অংকের কর্জ হাসিতে হাসিতে হাসিল করিতেছে। অর্থলগ্নিকারী সরাইখানায় নিয়োজিত গনি মিয়াগণও পরম উৎসাহ লইয়া ইহাদের খেদমত করিতেছে। ইহারা বেতনভুক মাত্র। নিজেদের ক্যাশ নাই। তবে গনি মিয়াদের মত ইহাদেরও ‘ক্যাশপতি’ হইবার খায়েস হয়। তাই খেদমতের বিনিময়ে তাহারা উইন উইন সিচুয়েশনের ভাগ-বখরা নিজেদের ভোল্টে নির্বিঘ্নে ঢুকাইয়া লইতেছে। হতভাগ্য দুই একজন ধরা খাইতেছে সত্য। তবে তাহা অনুপাতে অনুল্লেখযোগ্য। জলের মাছ ডাঙ্গায় উঠাইবার পর ইহার যেরুপ অবস্থা হয় তাহারা কতককাল সেইরুপ ছটফট করিতে থাকে। পরে বজ্র আঁটুনি ফসকা গিরোর যাদুমন্ত্রে বেকসুর হইয়া সমাজে বিচরণ করিতে থাকে।

    কথা অন্যদিকে বাঁক লইয়াছে। তাই, ট্র্যাকে থাকাই বাঞ্চনীয়। কথা হইতেছিল আজকালকার গনি মিয়াদের লইয়া। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ যথার্থই বর্গাজীবি, নিজের জমি নাই। থাকিলেও প্রায় ভূমিহীন পর্যায়ের। বাকীদের জমি জমা আছে। তবে স্বভাবে ইহারা গনি মিয়া তুল্য। নিজের জমি তো নিজেরই। অন্যের জমিও নিজের মনে করিয়া ইহারা অন্যের জমি, অন্যের সম্পদ ধর্ষণ, কর্ষণ করিয়া থাকে। ধর্ষণের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িয়াছে। লেখার ফোকাসও অন্যদিকে বাঁক লইতে উসখুস করিতেছে। গনি মিয়ারা নিজের জমিতে কর্ষণ, ধর্ষণ করে কিনা জানিনা। ইহা তাহাদের প্রাইভেট বিষয়। ইহার কোন অডিও, ভিডিও ক্লিপিং ফাঁস হইয়াছে বলিয়া শুনি নাই। তবে ইহারা যে নিজ জমি ভিন্ন অন্যের তত্ত্বাবধানে থাকা পতিত, অনুর্বর, উর্বর, লাখারিজ, নয়নসুখ জমি পাইলেই বাছবিচার না করিয়া ধর্ষণ-কর্ষণে লিপ্ত হইতেছে ইহা ফাঁস হওয়া অডিও,ভিডিও ক্লিপিংয়ের কল্যাণে চাক্ষুষ হইতেছে। শুধু যে গনি মিয়ারাই ম্যারাডোনা স্টাইলে কহেলিতেছে ইহা সম্পূর্ণ সত্য নহে। মিস/মিজ/মিসেস গনি মিয়ারাও কম খেলিতেছে না। ইহারাও নীচতলা, উপরতলা বন্ধক রাখিয়া ভালই চলিতেছেন। ইহাদেরও অডিও, ভিডিও ক্লিপিং ফাঁস হইতেছে। এই সমস্ত লইয়া কিছু দিন মিডিয়া পাড়া সরগরম থাকে। আটপৌরে পাবলিক ইহাতে বেশুমার বিনোদন খুঁজিয়া লইতেছে। চারিদিকে গনি মিয়াদের আধিপত্য মুহম্মদ ঘোরির ঘোড়ার মত টগবগ করিতেছে।

    আগেকার গনি মিয়ারা ফুটানি দেখাইতে যাইয়া কর্জ করিয়া ঘি খাইয়াছে। ফলত নিঃস্ব হইয়াছে। কিন্তু আজকালকার গনি মিয়ারা আঙ্গুল ফুলিয়া কলা গাছ হইতেছে। ইহারা মিলিয়ন মিলিয়ন অংক কর্জ করে। কর্জ শোধ করিবার কোন খায়েসই ইহাদের নাই। প্রথমত ইহারা অর্থলগ্নিকারী সরাইখানার সাথে আঁতাত করিয়া ধর্ষণ, কর্ষণের কাজ নির্বিঘ্নে সম্পাদন করিতেছে। উইন উইন সিচুয়েশনের অলিখিত ম্যামোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং সম্পাদন করিয়া কর্জের টাকা সরাইয়া ফেলিতেছে। ইহার কিয়দংশ দিয়া হোয়াইট কারবারে বিনিয়োগের সাইন বোর্ড লটকাইয়া সিংহভাগ বিদেশে থ্রো করিতেছে। ইহার পরের কাহিনী সবার জানা। আমেরিকা,কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই প্রভৃতি দেশে সেই কর্জের টাকা দ্বিগুণ, তিনগুণ, বহুগুণ হইতে থাকে। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিল জাতীয় আবহ সৃষ্টি হইয়া থাকে। ভাগ, বাটোয়ারা বা বখরার অর্থের কমবেশি লইয়া অথবা বঞ্চিত কাহারো ফুঁসমন্তরের কারণে কিছু কিছু হতভাগার কাহিনী ভাইরাল হইয়া থাকে। এইরুপ হইলে সরকারি যন্ত্র ‘হায়, হায়, ইহা কি হইলো, কেমনে হইলো, কাহারা করিলো, কাহারা জড়িত’ ইত্যাদি বিলাপে চারিদিক কাঁপাইয়া ফেলিতে থাকে। ইহা নিয়া সুশীলের মাতামাতি, গুঁতোগুঁতি, হাতাহাতি, খায়-খাতির, আড়াল-আবডাল খেলা চলিতে থাকে। আরেকটি ইস্যু আসিয়া ইহার অগ্নিনির্বাপণ করে।

    কথা আবারো বেলাইনে ছুটা শুরু করিয়াছে। গনি মিয়া প্রসঙ্গে কথা বলিতেছিলাম। আজকালকার গনি মিয়ারা ভাগ্যবান। ইহাদের কদর সর্বত্র। ইহারা টক শোতে বসিয়া জ্ঞানের ছবক দেন। বুভুক্ষু পাবলিক ইহাদের কথায় কখনো উত্তেজিত হয়, কখনো হাসিতে দশ খান হয়, কখনো বৌ এর ছোট ভাই সম্বোধনে খিস্তি খেউর করেন। ইহাদের মধ্যে অনেকে চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন দিয়া, সেলিব্রেটি এম্বেসেডার ক্রয় করিয়া ব্যবসারুপী মারণ ফাঁদ ফাঁদিয়া বসেন। অধিক ধর্ষণ, কর্ষণের জন্য বিভিন্ন এভেন্যু খুলিয়া বসেন। অর্ধভুক, বুভুক্ষু পাবলিক এই সব সেলিব্রেটিদের মোহনীয় সুর আর আগুনজ্বলা গা গতরে আকৃষ্ট হইয়া লোভাতুর, কামাতুর প্রাণীর মত ধার-কর্জ করিয়া, নিজেদের সর্বস্ব বন্ধক রাখিয়া ইহাদের কাছে নিজেদের সর্বস্ব সমর্পণ করিয়া থাকে। কালান্তরে এই সব ‘গনি মিয়া প্রাইভেট কোম্পানি’ সমূহ ইন্দ্রনাথের মত হঠাৎ দৃশ্যপট হইতে উধাও হইয়া যায় বা অলক্ষ্যে সটকিয়া পরে। সেলিব্রেটি সাইন বোর্ডধারীরা অতিশয় ধরিবাজ প্রকৃতির হইয়া থাকে। ইহারা আঁতেলেকচুয়াল বিবৃতি দিয়া মুহুর্তেই গায়ে লাগা নোংরা পানি সাফ সুতরো করিয়া ফেলে। আম পাবলিক কয়েকদিন চিল্লাচিল্লি করিয়া গলা ফাটায়, পুলিশের লাত্থিগুঁতা খায়। কর্তৃপক্ষ ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিয়া বিবৃতি সর্বস্ব হুংকার দিতে থাকে। ইহাতে কাহারো হাতে, কাহারো কোমরে দড়ি পরে। ইহাদের কাউকে আটক ফাটক করিয়া সামনে দাঁড় করাইয়া ফটো সেশন হয়। পরে কি হয় জানি না।

    কথা হইতেছিল গনি মিয়াদের লইয়া। ছোটবেলার পড়া গনি মিয়া গল্পের শেষাংশে ছিল একটি ম্যাসেজ। কর্জ করিয়া যে গনি মিয়া ধুম ধাম করিয়া তাহার ছেলের বিবাহতে বেশুমার খরচ করিয়া গ্রামবাসীকে খাওয়াইল, সেই গ্রামবাসীই গনি মিয়ার দেউলিয়াপণার সময় তাহাকে ভর্ৎসনা করিতে ছাড়ে নাই। তাহাদের বক্তব্য হইল গনি মিয়া কেন কর্জ করিয়া খাওয়াইল? সেইকালের গনি মিয়াদের নিজের জমি ছিল না। অন্যের জমি চাষ করিত। এই কালের গনি মিয়াদের জমি থাকুক কিংবা না-ই থাকুক তাহারা কর্জ করিতে দ্বিধাবোধ করেনা। সুযোগ পাইলেই ধর্ষণ, কর্ষণে নিজেদেরকে নিয়োজিত করিয়া ফেলে। ধর্ষক কৃষকদের টিকি পর্যন্ত ছোঁয়া যাইতেছে না। ছোঁয়া গেলেও ফুলের টোকার মত গায়ে কিছুটা বাতাস লাগিতেছে মাত্র। চূড়ান্তরুপে ইহারা ফটোসেশনে ‘ভি আঙ্গুল’ দেখাইবার নামে কার্যত পাবলিককে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করিয়া থাকে।

    কথায় কথা বাড়িতেছে। কিন্তু গল্পের নটে গাছটি ফুরাইতেছে না। এইবার এইবার খোকার থামিবার পালা। গনি মিয়ারা ধর্ষণ, কর্ষণে পরিবারকে, সমাজকে, নীতি-নৈতিকতাকে একের পর এক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিতেছে। রাষ্ট্রকেও ফোকলা করিয়া ফেলিতেছে। বিনোদনে মত্ত পাবলিক ভাবিতেছে ঘরে বসিয়া বিনা পয়সায় এইসব ধর্ষণ, কর্ষণের রগরগে কাহিনীর অডিও, ভিডিও ক্লিপিং দেখিতে, শুনিতে পাওয়া যাইতেছে ইহাই তো তাহাদের জন্য অফুরান বোনাসের। খামোখা আওয়াজ চওড়া করিয়া সরকারি, বেসিরকারি চতুর্মুখী সাঁড়াশি আক্রমণের শিকার হইতে যাইবে কেন? মূলত দেখভাল করার জন্য যাহারা নিয়োজিত আছেন ইহাদের চিন্তাও অভিন্ন। রাষ্ট্রের জন্য এই সব গনি মিয়ারা কি ভ্যাল্যু এড করিতেছে রাষ্ট্রকেই ইহা সুয়োমোটো ভাবিয়া দেখিতে হইবে।

    ছোটবেলার একটি প্রবন্ধ বয়সকালে পাঠ করিয়া কি সব প্যাচাল পারিলাম বুঝিতেছি না। ইহাকে বিলাপ বা প্রলাপ বলা সমীচীন কি-না ইহা যাচাই করার দায়িত্ব পাঠকের। স্কুল-কলেজে ‘একাল-সেকাল’ লইয়া রচনা লিখিতে হইত। সেই অভ্যাস আজো সুযোগ পাইলেই উঁকি মারে। তাই, গনি মিয়াদের লইয়া এই তুল্যমূল্য নিবন্ধ। গনি মিয়ারা ধর্ষণ, কর্ষণে আরো প্রভূত ধুরন্ধর ও আগ্রাসী হইয়া উঠুক ইহাতে আমার কি? আমি শুধু একালের গনি মিয়াদের চরিত্র চিত্রণের প্রয়াস পাইয়াছি। ইহাতে বেয়াদবি হইলে নিজ গুনে মাফ করিয়া দিলে বেশুমার খুশি হইবো। অধমের প্রাণ সংহারের ভীতি ইহাতে কিঞ্চিৎ দূরীভূত হইবে।

  • কা আ আ আ চা বাদাম

    • বাদামে বাদামে বাদামময়।
    • কা আ আ আ চা বাদাম।
    • আনোয়ার হাকিম।

    ডিজিটাল যুগে আজকাল কত কথাই তো শুনিতেছি। কত কিছুই না দেখিতেছি, জানিতেছি। ফেসবুক,ম্যাসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার, ইন্সটাগ্রাম,ইউটিউব এখন মুড়ি মুড়কির মত সহজলভ্য হইয়া গিয়াছে। এই গুলিই এখন ডিজিটাল প্লাটফর্ম।

    আমাদের সময়, তারও আগে, প্রেমিক প্রেমিকাদের শত কথার ফুলঝুড়ির মাঝে বাদাম বিরাট একটা উদ্দীপকের ভূমিকা রাখিত। যাহাদের এই ভাগ্য হয়নাই তাহারাও অতি প্রিয় বন্ধু, সুজন লইয়া পার্কে বা নদীর পাড়ে বসিয়া বাদাম চিবাইতে চিবাইতে বেশুমার আনন্দ উপভোগ করিত। এই বাদাম বলিতে ভাজা বাদামকেই বুঝাইতেছি। ছোট বেলায় বাদাম টানা খাইয়াছি। জিহ্বায় পানি চলিয়া আসিত। সিঙ্গারার মধ্যেও বাদাম পাইয়াছি। প্রকারভেদে কিছু বাদামের সাথে নামে ও চিত্রে পরিচিত হইলেও ইহারা তেমন জনপ্রিয় হইয়া উঠিতে পারেনাই। সম্প্রতি ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির ডায়েট চার্টে ইহাকে অতিশয় গুরুত্বযোগ করায় আমরা স্থুলকায়রা ইহাকে আপন করিয়া লইবার কোশেশ করিতেছি। পেশাজীবি হিসাবে বাদাম বিক্রেতাগণ স্ট্যাটাসের দিক দিয়া বরাবরই সমীহ পাইয়া আসিয়াছেন। বালিকা আর রমনীকূল ইহাদেরকে পেলব কন্ঠে বিভিন্ন সম্পর্কে সম্বর্ধিত করিয়া থাকে। আজো ইহার রকম ফের হয় নাই। পৃথিবীতে বাদাম একবারই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা পাইয়াছিল। তবে সেটা কাঁচা বাদাম। সবার মুখে মুখে তখন বাদাম পেশা কুলীন মর্যাদায় উচ্চারিত হইত। আমি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের কথাই বলিতে চাহিতেছি। তিনি হোয়াইট হাউসের জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্বাচিত বলিয়া ঘোষিত হইলে পাপ্পারাজ্জীদের বদৌলতে বিশ্ববাসী প্রথম জানিতে পারে যে তাঁহার পারিবারিক ব্যবসা এই বাদাম। এরপর বাদাম আর বিশেষ সুবিধা করিতে পারেনাই। তবে একান্ত আলাপনে, বিশেষ মুহুর্তে ইহা তাহার আগের সমীহ জাগানো র‍্যাংকিং ধরিয়া রাখিয়াছে। আমি বাদাম বলিতে চীনেবাদামকেই বুঝাইতেছি। বাদামের সহিত চীনের কি সম্পর্ক তাহা গবেষণার বিষয়। পাবলিক গবেষণা করিয়া খাদ্য নির্বাচন করেনা।

    অতি সম্প্রতি বাদাম আবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব পাইয়াছে। তাও মুখ রোচক, কুড়মুড়ে ভাজা বাদাম না। এক্কেবারে উদ্ভিদজাত ফ্রেশ কাঁ আ আ আ আ চা বাদাম। ভারতের বীরভূম জেলার ভুবন বাদ্যকার নামীয় এক প্রৌঢ় জীবিকার তাগিদে পুরানো মোটর সাইকেলে করিয়া ইহা ফেরি করিয়া বেড়ায়। তিনি সিটি গোল্ড বা চেইন বা মোবাইলের ভাঙ্গা বডির বিনিময়ে কাঁ আ আ চা বাদাম বিনিময়ের আর্থিক সূত্র গানের কলিতে সুর তুলিয়া গ্রামান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। ইহাতে দিন শেষে তাহার দুই-আড়াই শত টাকার সংস্থান হইয়া থাকে। ইহা তিনি বহুদিন যাবতই করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু প্রচারের পাদ প্রদীপে আসেন নাই। সম্প্রতি কোন এক টিক টকার বা ইউটিউবার ইহাতে মোহিত হইয়া ইহাকে ক্যামেরাবন্দী করিয়া ছড়াইয়া দিয়াছে।মুহুর্তেই ইহা ভাইরাল হইয়াছে। এখন ইহাকে নিয়া ছেলে মেয়েরা অসংখ্য টিক টক করিতেছে।বাংলাদেশ হইতেও টিক টকাররা ছুটিয়া গিয়াছে বীরভূম জেলায় ভুবন বাদ্যকারের গ্রামে। তাহার ইন্টারভিউ লইতেছে। ফেসবুক খুলিলেই তাহাকে ও টিকটকারদেরকে একই গান বিভিন্ন ভঙ্গীতে বিভিন্ন অনুষঙ্গ যোগে নাইতে, গাইতে দেখা যাইতেছে। ইহাতে ভুবন বাদ্যকারের ভাগ্যের চাকা স্থায়ীভাবে কতটুকু ঘুড়িবে বলিতে পারিনা। রাণু মন্ডলকে লইয়া এইরুপ একবার মাতামাতি হইয়াছিল। স্টেশনে রাত্রি যাপনকারী রানু মন্ডলের উত্থান বোম্বের রেকর্ডিং স্টুডিও পর্যন্ত হইয়াছিল। কিন্তু মোহ ভঙ্গ হইবার পর ইহার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন হইয়াছিল সেই রেল স্টেশনেই। তবে ভুবন বাদ্যকার এই ক্ষেত্রে আলাদা বলিয়াই মনে হইল।বাংলাদেশের এক তরুণীর প্রলুব্ধকর কথায় তিনি জিহ্বায় পানি না আনিয়া বলিয়াছেন স্ত্রী,পুত্র,কন্যা লইয়া তিনি এইভাবেই সুখে থাকিতে চাহেন।

    আজ দুই বাংলা বাদামে বাদামময় হইয়া গিয়াছে।তাও আবার কাঁ আ আ আ চা বাদামে। কয়েকদিনের মধ্যে হয়ত ইহার ব্যাপ্তি আরো বাড়িতে পারে। আরো কয়েকদিন পর হয়ত নতুন কোন প্রোডাক্ট আসিয়া ইহার জায়গা দখল করিয়া লইবে। ভুবন বাদ্যকাররা কাঁ আ আ চা বাদাম বিক্রী করিয়াই জীবনাতিপাত করিতে থাকিবে। ছেলেবেলা হইতে দেখিয়া আসিতেছি এক প্রকার লোকে বান্দর নাচাইয়া ক্যানভাস ইত্যাদি করিয়া জীবিকার পথ করিয়া নিয়াছে। বান্দরের সেই অবস্থার কিন্তু উন্নতি হইতে দেখিনাই। আজ ভুবন বাদ্যকারকে নিয়া যাহারা টিক টক, ইউটিউব কনটেন্ট বানাইতেছে তাহারা কি নিছক নিজেদেরকে ভাইরাল করিবার জন্য অথবা ইউটিউব হইতে ডলার কামাইবার জন্যই ইহা করিতেছেন? আর আমরা যাহারা ইহা দেখিয়া অফুরান আনন্দ পাইতেছি তাহারা কি বান্দরের খেলা দেখিতেছি? ভুবন বাদ্যকারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হইলে আর তাহার ভীমরতি না হইলে প্রচারের এই ঝলকানি তাহার জন্য সুখকর হইতে পারে। সেটাই কাম্য।

  • ব্রিলিয়্যান্ট ছেলে তৈরির বিদ্যা বিপনিবিতান ও প্রাসঙ্গিক কিছু ভাবনা

    • ব্রিলিয়্যান্ট ছেলে তৈরির বিদ্যা বিপনিবিতান ও প্রাসঙ্গিক কিছু ভাবনা।
    • আনোয়ার হাকিম।

    আমাদের সন্তানদের বিদ্যা শিক্ষা লইয়া এখন আর দুঃশ্চিন্তার কিছু নাই বলিয়াই মনে হইতেছে। আমরা আমাদের উত্তরাধিকারদেরকে দুধে ভাতে রাখিবার বাসনায় প্রথমত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করাকেই নিয়ামক ধরিয়া লইয়াছি। দ্বিতীয়ত ইহাকে আভিজাত্যের, কৌলিন্যের প্রতীকও বানাইয়া ফেলিয়াছি। সমাজের লোকেরা কি বলিবে বা ‘ওয়াও’ বলিয়া মারহাবা টাইপের আশকারা দিয়া গৌরবান্বিত করিবে এবং ইহাতে জাত- মান উভয়ই রক্ষা পাইবে ইহাও মননে মস্তিষ্কে গাঁথিয়া লইয়াছি। তৃতীয়ত শিক্ষা পন্ডিতগণও শিশু বয়সে “যাহাই দিবেন তাহাই সহিবে” এমন ছবক দিয়া যাইতেছেন। তাই বিদ্যার্থীদের পিঠে সাত কেজি ওজনের বিদ্যার বালিশ চড়াইয়া দিতে আমরা রীতিমত প্রতিযোগিতা করিয়া চলিতেছি। চতুর্থত বানিজ্যে লক্ষীর বসবাস এই মন্ত্রে বাঙ্গালী বড়ই অগ্রণী। যাহাই ব্যতিক্রম, যাহাই কঠিন, যাহাই হাই ফাই আর যাহাই রঙ ঢং এ মোড়ানো তাহাই টংকার অংকে চড়া হইবে অর্থনীতির এই সূত্র অতি স্বভাবিক। তাই বিদ্যা বিপনীবিতান গুলা নানা নামে, নানা বর্ণে নিজেদেরকে সাজাইয়া খদ্দের ধরার প্রয়াস পাইতেছে।খদ্দেরগণও সিস্টেমের কাছে কিছুটা অসহায় হইয়া, কিছুটা ‘সোসাইটি ভাইব’ অক্ষুণ্ণ রাখিবার খায়েসে আর প্রকারান্তরে ‘উন্নত মাল’ বিদেশে এক্সপোর্ট করিবার অভিলক্ষ্যে এইসব বিদ্যা বিপনিবিতানের গিলোটিনে নিজেদের লম্বা শক্তপোক্ত মাংসল গ্রীবা পাতিয়া দিয়া চলিয়াছেন। ইহাই ঘটমান বাস্তব।ইহার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া লোকজনকে সোসাইটির লোকেরা গেঁয়ো, নেটিভ, টিপিক্যাল বেঙ্গলী ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করিয়া হামাম দিস্তায় পিষিতে পিছপা হইবেনা। অতএব, স্বাভাবিক নিয়মেই ইহার বিপরীত কোন কথা বা পোস্ট অনেকের কাছে নিরর্থক ও হাস্যকর হিসাবে প্রতিভাত হইবে। যে কেউ টি টুয়েন্টিতে ব্যাট করিতে নামিয়া খুচরা রান করিতে থাকিলে তাহার প্রত্যাহার, তিরষ্কার ও বহিষ্কার যেমন স্বাভাবিক ইহাও এক প্রকার তেমনি। চার, ছক্কার বাহিরে আর অন্য কোন চিন্তা করিবার সুযোগ নাই। আজকাল অভিভাবকগণ ‘অতিভাবক’ হইয়া গিয়াছেন। ইহাকে দুষনীয় বলিলে পিন্ডি চটকাইতে চটকাইতে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করিয়া ছাড়িবে।

    মাল্টিন্যাশনাল আর কসমোপলিটন ফ্লেভারের এই যুগে অনুকূল হাওয়ায় পাল তুলিয়া নিশ্চিন্ত হওয়া ছাড়া আর বিকল্প কিছু আপাতত দেখিতেছিনা। তবে ইহাও ভাবিবার মোটেই অবকাশ নাই যে, যাহারা বাংলা মিডিয়ামে তাহাদের শিশুদেরকে দীক্ষিত করিতে পাঠাইয়াছেন তাহারা নিছক দেশ প্রেম আর বাংলা প্রেমে উদ্বুদ্ধ হইয়া এই কাজটি করিতেছেন। হয় ইহাদের ট্যাকের জোর কম, নাহয় ইহাতে অর্থ বিনিয়োগ অলাভজনক বা দেখাই যাক কি হয় জাতীয় ললাট নির্ভর হইয়াই পাঠাইতেছেন।সাধ্য থাকিলে তার্কিস, স্কটিস, স্যুইডিস,দিল্লীস, ব্রিটিস,আমেরিকানস, আগা খানস গোত্রের বিদ্যা বিপনিবিতান ঠিকই খুঁজিয়া লইতেন। খেলারাম খেলিয়া যাইতেছে। দেখারাম দেখিয়া যাইতেছে। শোনারাম শুনিয়া যাইতেছে। আর হাবারামরা হা করিয়া সার্কাস দেখিতেছে। এতকিছুর পরেও শুভ দাস গুপ্তের ‘ব্রিলিয়ান্ট ছেলে’ কবিতার কথা স্মরণ করিয়া শিহরিত না হইয়া পারিতেছিনা। যাহারা এই কবিতা পাঠ করিয়াছেন তাহারা অন্তত ইহার মর্মকথা বুঝিয়াছেন। আমলে নিন আর না-ই নিন। আর যাহারা অদ্যাবধি পাঠ করেন নাই তাহাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ,অন্তত গুগল বাবাজীর সাহায্য নিয়া হইলেও, একটিবার কবিতাটি পাঠ করুন। আমলে নিন আর না-ই নিন।

  • পোস্টাফিসের সেই বাক্সটা

    পোস্টাফিসের সেই বাক্সটা।
    আনোয়ার হাকিম।

    আমাদের কৈশোরে, পোস্টম্যান ছিলো এক অপার বিস্ময়। ঝোলা হাতে বাড়ী বাড়ী চিঠি, মানি অর্ডার, পার্সেল ইত্যাদি পৌছে দেয়াই ছিলো তার কাজ। বাড়ীতে পোস্টম্যান এলে সাড়া পড়ে যেত। কখনো সেই চিঠিতে খুশীর বার্তা থাকতো। কখনো বিষাদের খবর। চিঠি অথবা টাকা দিয়েই সে চলে যেত। গুরুজনদের দেখেছি খুশীর খবর পেয়ে বা প্রয়োজনের সময় হাতে টাকা পেয়ে খুশী হয়ে সেই পোস্টম্যানকে যাইহোক জলযোগ করাতেন। কখনো কখনো হয়ত কিছু দক্ষিণাও দিতেন।

    রুগ্ন, উস্কোখুস্কো, আটপৌরে কাপড় পড়া সেই পোস্টম্যান সলাজ বদনে সেই সামান্য আতিথেয়তাকে সম্মানও করতো। আজকাল সেই পোস্টম্যান আর দেখিনা। পোস্ট অফিসে যাওয়াই হয়না আজ প্রায় এক যুগ হয়ে গেল। রাস্তার মোড়ের সেই লাল কালো রঙ এর পোস্টবক্সও এখন আর দেখিনা । ছোটবেলায় তারাশংকরের ডাকহরকরা পড়েছিলাম। রাতের ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ঝড়, বাদলা আর বিজলি উপেক্ষা করে মফস্বলের ডাকহরকরা ছুটে চলেছে লন্ঠন হাতে লাঠিকে সম্বল করে দূরের রেল স্টেশনে ডাক ধরাতে। পরে আরেকটু বড় হয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে শুনেছি সুকান্তের রানারের ছুটে চলার কাহিনী। সব কিছুই স্বপ্নের মত স্নিগ্ধ আর আন্তরিকতায় ভরপুর মনে হত তখন। মোটকথা পোস্ট অফিসের প্রতি এক নষ্টালজিক অনুভূতি তখন থেকেই মগজে গেঁথে গিয়েছিলো। আজো আছে। রবীঠাকুরের পোস্ট মাস্টার পড়ে জীবনে প্রথম ধাক্কা খেতে শিখেছি। সেই প্রথম জেনেছি, শহুরে শিক্ষিত বাবুদের অনেক ভাল কিছুর সাথে চতুরতা আর গা ঝাড়া দিয়ে শরীরের পানি সাফ সুতরো করার অনুষংগও থাকে। ছোট ছিলাম তাই বালিকা রতনের সাথে পোস্টমাস্টারের বিদায়ের শেষ ফয়সালা মেনে নিতে পারিনি। এই দৃশ্য কল্পনা করে কত রাত যে বালিশ ভিজিয়েছি তার হিসেব দিতে পারবো না। বড় হয়ে অবশ্য নাগরিক অনেক উপাদানের মত মেনে নিয়েছি, সত্যিই তো “পৃথিবীতে কে কাহার”? মানি আর না মানি এ বিশ্ব চরাচরে যন্ত্র আর যান্ত্রিকতার যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করার শক্তি কারো নেই। মানুষগুলো ‘মানুষ’ই আছে। তবে রোবটের মত আগে থেকে ইংজেক্ট করা প্রোগ্রামিংয়ের দাস হয়ে।

    পরিবর্তনের স্রোতে সমাজ ছুটে চলেছে। জনমানুষের রুচি, পছন্দ, অভ্যেস, চাহিদার যেমন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি দ্বিমুখী, ত্রিমুখী, বহুমুখীও হচ্ছে হরহামেশাই। যাযাবর দৃষ্টিপাতে বলেছেন, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। সেই বেগের দ্রুতযানে চড়ে আমরা তেপান্তর পারি দিচ্ছি নিমিষেই। আবেগ প্রকাশে নিচ্ছি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্য। ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন শুধু খেলনাপাতির মত করায়ত্তই হয়নি এর কল্যাণে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার, ইন্সটাগ্রামসহ আরো আরো বাতায়ন আবেগ গ্রহণ ও প্রক্ষেপণের একান্ত আপনার মাধ্যম হিসেবে নিত্য সহচর হয়ে উঠেছে। এখন যোগাযোগ বলতেই এইসব। পোস্টাফিসের সেই হলুদ খাম, পোস্টকার্ড আর দেখা যায় না। নেই সেই লাল কালো পোস্টবক্স। নেই পোস্টম্যানের হাকডাক। এখন সময়টাই হলো একাকীর। কোথাও কোন হাকডাক নেই। পাশাপাশি অবস্থান হলেও যে যার মত দূরের বৃত্ত তৈরি করে উদ্বেগ, আবেগ, আলাপ, বিলাপ বিনিময়ে ব্যস্ত। আজকালের কিশোর, যুবারা এতেই সিদ্ধহস্ত, তুষ্ট। আবেগ, বিরহ, উল্লাস, আনন্দ, বেদনা, যাতনা, হর্ষ, বিষাদ প্রকাশে এর চেয়ে আর কোন বিকল্প মাধ্যম এখন অবধি আবিষ্কৃত হয়নি। বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসতি। সেই বাণিজ্য ঢেউয়ে পোস্টাফিসের আটপৌরে ভঙ্গুর দশা আজ অনেকটাই প্লাস্টার উঠা চুন সুড়কির অট্টালিকা সদৃশ। এই সুযোগে বেসরকারি বণিকালয় ‘ক্যুরিয়ার সার্ভিস’র নামে অসম প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়ায়। এর চমকে, ঠমকে পোস্টাফিসের তাবৎ ভগ্নদশা আরো প্রকট হয়ে উঠলো। ভেতরের লোকজনের উদাসীনতা, দায়িত্বে নিদারুণ অবহেলা আর প্রকারান্তরে বণিকালয়ের দক্ষিণা-আনুকূল্য পেয়ে এতকালের প্রাণের ডাকঘর তাসের ঘরের মত নিজেকে সমর্পণ করে বসলো। প্রাইভেটাইজেশনের যুগে এর দায় কার তা নির্ধারণ করা কর্তাদের কাজ। তবে পোস্টাফিসের সেই পরিত্যক্ত বাক্স মুখ উঁচিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি কখনো। লোহার বাক্সে মরিচার আস্তরণ এতই জমেছে যে ঘুণে খাওয়ার মত ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। রংয়ের প্রলেপ উঠে যাওয়ায় তা এখন ছাল উঠা সারমেয় সদৃশ হয়ে পড়েছে। না পোস্টম্যান, না আমজনতা কেউই আর একে স্পর্শ পর্যন্ত করেনা এখন। বলাবাহুল্য, নগরীতেও এই বাক্সের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায়না। এর জন্য কোন হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। তার জন্য কোথাও কোন বিলাপ নেই। যদিও পোস্টাফিস আজো টিকে আছে। তবে তা নাক অবধি পানিতে দাঁড়িয়ে কেবল শ্বাস টুকু নিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি ইন্সট্রুমেন্টের বদান্যতায়। হলুদ খাম আর পোস্টকার্ড থেকে এই বিমুখতা কি বাণিজ্য ঢেউয়ের কারণে, নাকি বেগের তাড়নায়? আগে, এই কয়েক বছর আগেও, ঈদে-পার্বণে কার্ড বিনিময় উৎসবের আমেজকে শতগুণে বাড়িয়ে দিত। প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে শুভেচ্ছাদূতের কাজ করত এই কার্ড। বন্ধুতা জিইয়ে রাখার আরেকটি মাধ্যমও ছিল এই কার্ড। আজকাল আমরা সবাই সেই কার্ড থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। ছোট্ট এসএমএস এখন সেই স্থানে অপ্রতিরোধ্য চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠেছে। হলুদ খামে রুল টানা কাগজে যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভুলে না মোরে জাতীয় একান্ত ব্যাক্তিগত কথামালা আর উৎকীর্ণ হয়না। এখন আর নষ্টালজিয়ায় ভুগার সময় নাই। গিভ এন্ড টেক এর এ যুগে ধরো, মারো, করো, ভরো, ছাড়োতেই তুষ্ট সবাই।

    একাল সেকালের এরুপ চিত্র চিত্রণে রজনী শেষ হলেও তুল্যচিত্রের শেষ হবেনা। তবে দিন শেষে মানুষ তো মানুষই। যন্ত্র তাকে যতই যান্ত্রিক বানিয়ে ফেলুক তার ভেতরের স্বত্বা যেমন বিপ্রতীপ কোণের আরাধ্যকে আপনার করে পাওয়ার জন্য একান্ত কোণ চায়, তেমনি দূরের কাউকে নিজের অন্তর্গত উজ্জ্বল বিষাদের কথা, স্বপ্নের কথা, মগ্ন চৈতন্যে শীষের কথা জানাতে চিরকুট বিনিময় করতে চায়। তাই এই পোস্ট বক্স, পোস্টম্যান, হলুদ খাম, পোস্টকার্ড নিয়ে নতুন করে চিন্তার সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায় নি। সরকারি প্রতিষ্ঠান সেবামূলক। সরকার জনকল্যাণমুখী। এর বেশির ভাগই চলে জনগণের ট্যাক্সের অর্থে। অন্য অর্থে জনপ্রিয় ‘ভর্তুকি’ শব্দটি যেন সরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক, কলকারখানার সাথে সমার্থক হয়ে গেছে। সেদিক বিবেচনায় পোস্টাফিসের শতবর্ষী চিত্র অক্ষুন্ন রাখতে সেই লাল কালো পোস্টবক্স ফিরিয়ে আনা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। সেই পোস্টকার্ডে ক্ষুদে বার্তা বা উন্মুক্ত বার্তা বিনিময়ের সুযোগ আকর্ষণীয় ঢংয়ে ও মূল্যে পুনঃ প্রবর্তন করা যায় কিনা? আর একান্ত আপনার কথাগুচ্ছকে মনের মাধুরী মিশিয়ে হলুদ খামে অপর প্রান্তে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তাও ভেবে দেখা যেতে পারে।

    বিজ্ঞান আমাদেরকে বেগ দিয়েছে, আমরা এর সুফলভোগী। আবেগ বহুলাংশে কেড়ে নিয়েছে, আমরা এর শেষটুকু নিঃশ্বেস হতে দিতে চাইনা। নির্মলেন্দু গুণের আক্ষেপ ছিল, “ আমি বলছিনা ভালবাসতেই হবে/ আমি চাই কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক/ শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য/বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত—”। এই কেউ একজন শুধু প্রেমিক বা প্রেমিকাই হবে এমন নয়। পরানের বন্ধু, সহচর বা দূরের কোন বাতিঘরও হতে পারে। ভেতর থেকে দরোজ খোলার এই আয়োজন নেই আজ। সব কিছুই চাছাছোলা। ডাইরেক্ট একশন নির্ভর হয়ে গেছে আজ। মনের সুকুমারবৃত্তির উন্মেষের প্লাটফর্ম কই? আবেগ যথার্থভাবে বিনিময়ের সেই ভেতর দরোজা কই? এমসিকিউ টাইপের প্রশ্নোত্তরে যেন আমরা আজকাল বড় বেশি মাতোয়ারা। আমাদের সেই অতি প্রিয় পোস্টাফিসকে আসুন আমরা মনের রঙ্গে আবারো রাঙ্গাই। একে আরো চিত্তাকর্ষক করে তুলি। সম্ভারে সাজাই এর প্রতিটি সেবা। জনমুখী করি এর সকল দরোজা, জানালা। খালি সাসটেনেবিলিটি আর ব্যবসা-বাণিজ্যের সুদকষা, লাভ ক্ষতির হিসাব কষে নয়। রংধনুর বে নি আ স হ ক লা দিয়ে। আবার জনরবে ভরে উঠুক পোস্টাফিস। ফিরে পাক সেই আদি ও অকৃত্রিম অনুভূতি। আমাদের গেছে যে দিন/ একেবারেই কি গেছে/ কিছুই কি নেই বাকী? রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। এই যদি সত্য হয় তবে ঘুড়ে দাঁড়াবার আয়োজন একটিবারের জন্য। লেট দেয়ার বি লাইট।

  • ইনফিওরিটি কমপ্লেক্স

    ইনফিওরিটি কমপ্লেক্স

    ইনফিওরিটি কমপ্লেক্স।
    আনোয়ার হাকিম।

    ক.
    নীরার সাথে প্রথম দেখা এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে। সে উপস্থাপিকা, আর আমি সময় কাটানোর দর্শক-শ্রোতা। বিষয়ঃ বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতা। আলোচক অনেক। যুক্তিতর্কের রকমারি কাটাকুটিও চমকপ্রদ। কিন্তু আমার দৃষ্টি নীরার দিকে। ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠালামঃ কিছু বলতে চাই- একজন পড়ুয়া হিসেবে। নীরা যেন কী দেখলো! সুযোগও দিল। আমি বিজয় গর্বে উদ্দীপিত সৈনিকের মত মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিতর্কিত হবার বাসনার চেয়ে নীরার দৃষ্টি আকর্ষণের আকাংখা পেয়ে বসলো। হার্ড হিটার ব্যাটসম্যানের মত বলে গেলাম অনেক কিছু। বললাম যাদেরকে আমরা বাংলা সাহিত্যের দিকপাল বলে জানি বা মনে করে থাকি তারা আসলে কেউই আধুনিক ছিলেন না।ব্যক্তিগত জীবনে তো নয়ই লেখাতেও না। মনে হলো হলের মধ্যে যেন বোমা ফাটিয়ে দিয়েছি। তাই মঞ্চে উপবিষ্ট ভারি লেন্সধারী মফস্বলের বাংলা বিশারদরা ঘাড় কাত করে ঘন ঘন তাকাচ্ছেন। কেউ কেউ চিড়িয়া জ্ঞানে আমাকে ডায়াসে উঠার পারমিশন কে দিয়েছে সেরুপ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উশখুশ করতে থাকলেন। দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে প্রাথমিক ক্ষীণ উত্তেজনা। নীরার মুখ রক্তিম। যেন সাজানো ড্রয়িংরুম তছনছ করে দিয়েছি আমি। বললাম, এই যে মধ্যবিত্ত আর সাধারণের শরৎ বাবুর কথাই ধরুন। তিনিও কি আধুনিক হতে পেরেছেন? শ্রীকান্ত রাজলক্ষীর প্রণয় নিয়ে জাত পাতের ভেদ ভাঙ্গতে না পেরে অযথা শ্রীকান্ত উপন্যাসটিকে চার পর্ব ঘুরিয়েছেন। প্রণয় লীলা দেখিয়েছেন,পাবলিক কাঁদানো হৃদয় চেড়া কাহিনী ফেঁদেছেন। তবু রাজলক্ষীকে শ্রীকান্তের হাতে তুলে দেওয়ার সাহসটুকু পাননি। আবার হা হুতাশ করে বলেছেন, “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, দূরেও ঠেলিয়া দেয়”। আরো দেখুন, দেবদাসের সাথে পার্বতীর গাঁটছড়াও বাঁধাতে পারেননি। এই যদি হয় নমস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে আমি অন্তত আধুনিক বলতে পারিনা। তারচেয়ে আরো ইন্টারেস্টিং হলো রবি বাবুর কায়কারবার। জমিদার নন্দন রবি বাবু লেখায় রেখায় যথেষ্ট আধুনিক কাহিনী ফাঁদলেও শেষতক যে লাউ সেই কদুই। “শেষের কবিতা” উপন্যাসে দেখুন। অমিত লাবণ্যের প্রণয়কে আধুনিকতার সকল রেকর্ড ভঙ্গকারীর মত করে উপস্থাপন করার পরেও তাদের হাতের মিলন ঘটিয়ে দিতে পারেননি। “হঠাৎ একদিন” কবিতার কথাই ধরুণ। পেরেছেন কি তাঁর প্রণয়ীকে কাছে ধরে রাখতে? পারেননি। উল্টো কাব্য করে বলেছেন, “আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকী”? নিজেই প্রণয়ীনির মুখ দিয়ে দার্শনিক বাণী শুনিয়েছেন,
    “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”। দেখলাম হাউজের অবস্থা ক্রমশঃ ভারি হয়ে উঠছে। অপেক্ষাকৃত তরুনরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে সাবাস সাবাস পটকা ফোটাচ্ছে। অন্যদিকে বিদগ্ধ সুধীদের মধ্যে চুতরা পাতার চুলকানি শুরু হয়ে গেছে। এই অবস্থায় রণে ভঙ্গ দেওয়াই নিরাপদ ভেবে মঞ্চ থেকে নেমে এলাম অনেকটা স্টান্ট মারার ভঙ্গিতে। যেন আরো অনেক কিছু বলার ছিল। আরো অনেক কিছু তুলে ধরার ছিল। কেবল সময়ের কারণেই হলো না। এক শ্রেণীর তরুণের প্রচন্ড করতালি পেলাম। কেউ কেউ উচ্চকন্ঠে চালিয়ে যেতেও বললো। আমি আসনে বসে নীরার দিকে চেয়ে থাকলাম। নীরা কি আমার উপর রাগ করেছে? চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিল। মনটা চনমনে হয়ে উঠলো তার সাথে পরিচিত হতে। অনুষ্ঠান শেষে সবার নিষ্ক্রমণের পালা। হলরুম ফাঁকা প্রায়। ইচ্ছেকৃত কালক্ষেপণ করলাম। সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামার সময় নীরার কন্ঠ, “এক্সকিউজ মি”। আমার কানে তা ইকো হতে থাকলো। আমার বোধ তা গ্রহণও করলো ধীর লয়ে।
    — যা বললেন, তার সবটাই কি বিশ্বাস করেন? নীরার প্রশ্ন।
    –বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন না, এ হচ্ছে যুক্তির কথা। আমার উত্তর।
    –বলুন তর্কের কথা। সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস পড়েছেন নিশ্চয়?
    –কেন বলুন তো?
    –মানুষের বিতর্কিত হওয়ার কত ইচ্ছে- তাইনা? নীরা অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত। নীরাই নিরবতা ভাঙ্গলো, “কোথায় থাকেন”?
    –সার্কিট হাউজ
    –নিশ্চয় আমলা?
    –কেন? এলার্জি?
    –কিছুটা। আচ্ছা, চলি।
    যাবার সময় আগামী অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানালো। আগামী সপ্তাহে, এই দিনে, এই সময়ে। আমি যেন টেক্কার ট্রয় হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলাম। বুকের ভেতর বসন্তের ফিনফিনে হাওয়া হৃদপিন্ডের প্যান্ডুলামটায় মিষ্টি পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেল। আমি কি প্রথম ইনিংসে এগিয়ে গেলাম?

    খ.
    আজকের আলোচনার বিষয়বস্তুঃ সাম্প্রতিক বাংলা কবিতাঃ প্রেক্ষাপট রাজনীতি। নীরা আমার নাম ঘোষণার অনুমতি চাইলো। আমি করজোড়ে বারণ করলাম। নীরা যেন কী অর্থ করলো তার। একবার তাকালো। আমি তার অর্থ বুঝে উঠতে পারলামনা। অনুষ্ঠান শেষে আবারো আলাপ। সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নীরার সংলাপ,” আজ তর্কে নামলেন না যে”?
    –বিতর্কিত হতে চাইনা বলে
    –আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিলেন?
    –নাহ। ভুল স্বীকার করে নিলাম।
    নীরা যেন কিছুটা হোচট খেলো। আশ্চর্যবোধক চিহ্নের মত খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
    “আপনার সাথে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন”।
    –কোন বিষয়ে?
    — সাহিত্য।
    — ও বিষয়ে আমার পড়াশোনা খুব কম
    –বিনয় দেখাচ্ছেন?
    –নাহ। নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিচ্ছি। নীরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।

    গ.
    অনেকদিন নীরার সাথে দেখা নেই। অফিসের কাজে উপজেলা টু উপজেলা ঘুরছিলাম। বিকেলে আর্ট কলেজের গ্যালারিতে দেখা। নবীন শিল্পীদের আর্ট এক্সিবিশন চলছে। চোখাচোখি হতেই নীরার কন্ঠ,”বহুদিন দেখা নেই। কী ব্যাপার?
    –ব্যস্ত ছিলাম।
    –ও তাইতো। আমলাদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা
    –খোঁটা দিচ্ছেন?
    –মোটেই না।
    –তাহলে?
    –দেখলাম সহজেই রেগে যান কিনা?
    –কি দেখলেন?
    –ইগোতে লেগেছে মনে হলো
    –তাই নাকি?
    –হ্যা,ওটাই তো আমলাদের সম্বল। নীরা যেন মৃদু হাসলো।
    নীরার সাথে এভাবেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বিতর্কিত হয়েছি। আবার বিতর্কিত হয়েছি বলেই তো তার কাছে আসার সুযোগ পেয়েছি। তবু, কেন জানি শূন্যতা বোধ হয়। একদিন বলেই ফেলি,
    ” আজকাল কেমন যেন লাগে”?
    –কেমন?
    — ঘুম হচ্ছে না ঠিকমত
    –কোন প্রবলেম?
    — নানা চিন্তা
    –যেমন?
    –থাক।
    –সেই চিন্তার মধ্যে আমিও আছি নাকি?
    –হুম্ম।
    –খুব খারাপ লক্ষ্মণ তো
    –হেয়ালি করছো?
    –মোটেই না। নীরা হাসতে থাকে। ওর হাসি কাঁচ কাটা হীরার মত খচ খচ টানে হৃদয়ের প্যান্ডুলামটাকে রক্তাক্ত করে। কোথায় যেন সব জট পাকিয়ে গেছে। অথচ নীরা তা বোঝেনা। শুধুই হাসে। বলে,”আপনার কপালে অনেক দুঃখ আছে”। আমিও তেমনটা আঁচ করি। আপনি থেকে তুমিতে কিভাবে যে নেমে এলাম নিজেও জানিনা। আমি কি দ্বিতীয় ইনিংসে পিছিয়ে পড়ছি?

    ঘ.
    সময় এভাবেই গড়িয়ে চলে। আর নীরার দহন জ্বালা পোড়াতে থাকে। তাই নানা উছিলায় স্টেডিয়ামের পাশের কফি শপে সন্তর্পণে চলে আড্ডার নামে আলাপ। আলাপের নামে উষ্ণ সাহচর্য। সাহচর্য মানে সান্নিধ্য। কফি খেতে খেতে এতসব ভাবছি। কিছুক্ষণ পর নীরা এলো। বেশ গম্ভীর। বেশি কথা না বলে গাড়ীতে ওঠার ইশারা করলো। অনুগত সহচরের মত গিয়ে বসলাম। ড্রাইভিং সিটে নীরা। আমি পেছনের সীটে। নীরা অবাক হলো। কপাল কুঁচকে বললো,” আমি কি আপনার ড্রাইভার?”
    আমি হতচকিত হয়ে বলেই ফেললাম,”কেন”। “আপনার মাথা। এভাবে কথা বলা যায়?”

    “তো” আমি বোকার মত বলে ফেললাম। “সামনে বসুন” বলে বা হাত দিয়ে ইশারা করলো। আমি কিছুটা লাজে, কিছুটা ‘পাছে লোকে কি বলবে’ গোছের আড়ষ্টতা নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। পারফিউমের গন্ধে গাড়ী মৌ মৌ। এ গন্ধ কার সেন্টের আর নীরার পারফিউমের। গাড়ী ছুটে চলেছে পতেঙ্গার দিকে। নীরা গম্ভীর। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,”কাল সারারাত অনেক চিন্তা করে দেখলাম। সব কিছু আপনাকে জানানো প্রয়োজন”। আমি ঔৎসুক্য নিয়ে শুনতে থাকলাম তার অকথিত কথামালা। অল্পদিনের জানাশোনাতেই ভালোবেসে হুট করে বিয়ে করে ফেলেছিল সে। কিন্তু সে ভালোবাসা ছ’মাসও টিকেনি। একদিন সকালে ভালোবাসার সাজানো সংসার দু’পায়ে ঠেলে চলে গিয়েছিলো তার ভালোবাসার প্রাণ পুরুষ। সেও ছিলো এক আমলা। খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছিলো সে। নীরার ভালোবাসাই তাকে সাহসী করে তুলেছিল। কিন্তু সব সময় এক ধরণের কমপ্লেক্সে ভুগত সে। নীরার বাবার প্রাচুর্য আর পারিবারিক আধুনিকতার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি কখনোই। সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও হার মানে নীরা। একসময় আসে চূড়ান্ত ক্ষণ। নীরা পাড়ি জমায় কানাডায়। ওর বড় বোনের কাছে। সেখানেই তূলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে। বছরে দু’মাস কাটিয়ে আসে লন্ডনে। বড় ভাইয়ের কাছে।
    নীরা খানিকটা থামলো। গলা ধরে এসেছে তার। বা হাতে ক্যাসেটটা অন করে দিলো। কি যেন ইংলিশ মেলোডি বাজছে তাতে। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। বুকের ভেতরটায় ফায়ার ব্রিগেডের পাগলা ঘন্টাধ্বনি অনবরত বেজে চলেছে। যেন হৃদয় জুড়ে আগুন লেগেছে। নীরার দুঃখের সাথী হতে ইচ্ছে করছে। অথচ নীরা অনড়। ওর দুঃখ একান্তই ওর।

    ঙ.
    তিন মাসের ট্রেনিং শেষে কর্মস্থলে এসে দেখি টেবিলের উপর দু’টো চিঠি। একটা বদলীর। ভেদরগঞ্জ উপজেলায়। আর অন্যটা নীরার। তারিখ অনুযায়ী নীরা এখন লন্ডনে। ওখানে থেকে এরপর কানাডায়। আর আমি? এখান থেকে ভেদরগঞ্জ। হয়ত কিছুদিন পর সেখান থেকে অন্য কোথাও, অন্য কোন উপজেলায়। নীরার কক্ষপথের ব্যাপ্তি কত বড়! কত সমৃদ্ধ! আর আমার? পরিভ্রমণের বলয় ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। আমার কেবলই সেই পরাজিত মুখটার কথা মনে পড়ছে। যে নীরার মত সুন্দরীর অধিকারী হয়েও পরাজয়কে মেনে নিয়েছে সানন্দ চিত্তে। অন্যদিকে নীরার গ্লেয়ারিং এন্ড গ্লিটারিং মুখটাও অনবরত ভেসে উঠছে চোখের পর্দায়।

    শীতের রাত। দরোজা, জানালা সব বন্ধ। তবু যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। জানালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে এক পশলা হিম শীতল বাতাস সমস্ত শরীরে ঠান্ডার পরশ দিয়ে গেল। বাইরে ঘোর অমাবস্যা। শুন শান নিরবতা। হৃদয়ে ক্ষরণজনিত অস্থিরতা। অথচ নীরার মুখোমুখি হয়ে ফরোয়ার্ড মার্চ করার সাহসও হয়না। এ এক অসহনীয় অবস্থা। এরই নাম কি ইনফিওরিটি কম্পলেক্স?

    (রচনাকাল ১৯৮৯)