Author: Anwar Hakim

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (৯)
    সেলিমের জামিন হয়েছে। তবে দেখা দিয়েছে আরেক সমস্যা। জামিন পেয়ে সে কোথায় গিয়ে উঠবে? বড় মামার কড়া হুকুম আমাদের বাসায় না। মান-ইজ্জত যা গেছে সেটুকুই যথেষ্ট। নতুন করে সবার কাছে আর পরিহাসের পাত্র হওয়ার দরকার নেই। আম্মারও তাই মত। মলি ভোট দানে বিরত। আমার কাছে মনে হলো জামিন পেয়ে একবারের জন্য হলেও বাসায় যাওয়া উচিত। অন্তত তাতে আমাদের আশেপাশের আর অন্য ফ্ল্যাটবাসীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাবে যে হয়রানীমূলক বা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়েছিলো। বড় মামা একথা শুনে আমার মুন্ডুপাত করতে চাচ্ছে। ছোট মামা তাকে বুঝালেন। সেলিম জামিনে মুক্ত হয়ে বাসায় এলো। এসেই মলির রুমে গিয়ে সটান শোয়া দিলো। কোথায় সে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইবে, কান্নাকাটি করবে, অপরাধ স্বীকার করে আর করবেনা মর্মে মুচলেকা টাইপের কিছু একটা বলবে। কিন্তু এর কোনটাই করেনি। উল্টো তার হাবভাব এমন যে আমরাই অপরাধী। মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিন্তু কিছু করার বা বলার উপায় নেই। তার নিজ বাড়ীতে যাবারও কোন উদ্যোগ নেই। মলিরও এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হলো না। ভাবটা এমন যে সোনার টুকরো পিতলা ঘুঘু হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এখানেই সেলিমদের তেলেসমাতি। ওরা জানে কোনটা কার উইকনেস আর কোনটা স্ট্রেংথ। ফোন দিয়ে বললাম, “এখন কি করবা”?
    — জানিনা। তার সংক্ষিপ্ততম উত্তর।
    — কেন?
    — মাথা কাজ করে না
    — আস্তে আস্তে চিন্তাভাবনা শুরু করো।
    — জ্বী
    — বাড়ী যাবা না?
    — ইচ্ছে নাই
    — কেন?
    — ফ্যামিলি প্রেস্টিজের ব্যাপার
    — আমাদের এখানেও তো একই ব্যাপার
    — তাহলে অন্য কোথাও চলে যাবো।
    — আমি কি তাই বলেছি?
    — বেশিদিন শ্বশুর বাড়ি থাকা ঠিক না।
    — মলি কি বলে?
    — সে কি বলবে? দোষ তো আমার।
    — তাহলে তার মুখের দিকে চেয়ে কিছু করো
    — জানিনা।
    এরকম জেগে ঘুমানো ছেলেকে আর কি বলা যায়? আম্মাকে বললাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুধু। আর বললেন তাকে কিছু না বলতে। মলি মাইন্ড করে।

    মিটিং আর ওরিয়েন্টেশন কোর্সে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছি। আমি আসবো শুনে সেলিম চুল কাটার নাম করে উধাও। আবারো মহা যন্ত্রণায় পড়া গেলো তাকে নিয়ে। এদিকে মলি আমার উপর মহা ক্ষ্যাপা। সেলিমের সাথে আমার ফোনালাপ মলিকে বলে দিয়েছে সে। অনুমান করছি যতটা না অপব্যাখ্যা করেছে সে, তার চেয়ে বেশি বদ অনুমান করে নিয়েছে মলি নিজে। সকালে অফিসে যাই। ফিরতে ফিরতে সেই রাত। সেলিমের পাত্তা নেই। মলিও জানেনা কোথায়। বাসার পরিস্থিতি সেই আগের মত। মলির রুম বন্ধ। খায় তো খায় না। রুমের বাইরে আসে তো আসেনা। কথা বললে উত্তর দেয় তো দেয় না। কি যে একটা বিদঘুটে অবস্থা। আম্মার অবস্থা আরো খারাপ। বড় মামা বেজায় বিরক্ত। সিরাজগঞ্জের বন্ধুর কাছে খবর নেওয়া হয়েছে। সেখানে যায় নি। ওদের বাসায় খবর নেওয়া হয়েছে। সেখানেও যায় নি। খবর দিয়েও হয়েছে আরেক ঝামেলা। ছেলের জন্য যেন তাদের দরদ এতদিনে উথলে উঠেছে। পুনরায় নিখোঁজ সংবাদে তাদের মাতম শুরু হয়ে গেছে। একদিন জানা গেলো যাত্রা বাড়ীতে তাদের এক দুঃসম্পর্কীয় দুলা ভাইয়ের ওখানে গিয়ে ঘাটি গেড়েছে। তারাও ত্যক্ত। বিজনেস করবে তাই টাকা চাচ্ছে। অনুমান করতে অসুবিধে হলো না যে, এ ছাড়া তার বিকল্প কোন পথ খোলাও নাই। অবশেষে অনেক বলে কয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।

    কয়দিন যাবত শরীর খুব খারাপ। দুর্বল আর খাবার রুচি কমে গেছে। শরীরের সাথে মনের যোগাযোগ যে কত নিবিড় তা অসুস্থ না হলে বুঝা যায়না। বিশেষত রাতে অসহ্য লাগে। মনে থেকে থেকে যতসব অলুক্ষণে কথা এসে হাজির হয়। শুধু হাজিরই হয়না। সম্ভাব্য অশুভ পরিণতিও দেখাতে থাকে। এর মাত্রা আরো বাড়ে যখন চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যাও। স্থানীয় ডাক্তার দেখিয়েছি। বললেন, কিছুনা। টেনশন কাজ করছে তাই এমন হয়েছে। বললেন, “এই বয়সে এত টেনশন কিসের? খাবেন-দাবেন আর ঘুড়ে বেড়াবেন। চাকরি তো ভালই করেন। বিয়েশাদি করে ফেলেন”। আব্বার কথা মনে পড়লো। ছোট বেলাতে দেখেছি কারো খেতে ইচ্ছে না করলে তিনি ধরেই নিতেন, বাথরুম ক্লিয়ার হয়নি। কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষ্মণ। কখনো কখনো তাঁর কথা সত্যিও হত। আবার কখনো ক্লিনিক্যাল টেস্টে অন্য কিছু ধরা পড়ত। আর এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে মাদার অফ অল ডিজিসেস হলো এই টেনশন। ডাক্তাররাও এটা ধরে নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে থাকেন। আর রোগী যদি তরুণ বয়সের হয় তাহলে তো অবধারিত ভাবে সন্দেহের তীর এফেয়ারস আর এতদসংক্রান্ত টানাপোড়েনের উপর গিয়ে পড়বে। কি ভেবে যেন ডাক্তার মৃদু হাসলেন। কথা যে বেশ খানিকটা সত্য তা উপলব্ধি করে ঢোক গিললাম। কি কি সব ওষুধ দিলেন। সাথে মাসল রিল্যাক্স ও টেনশন রিলিফের ওষুধও। বললেন, “আপনার ঘুম দরকার। এগুলো খান। ভাল ঘুম হলেই ঠিক হয়ে যাবে”। সেই ঘুম আর আসেনা। একেবারে ভোরের দিকে শরীর ক্লান্ত হয়ে নার্ভ যখন আর কুলিয়ে উঠতে পারেনা তখন ঘুম আসে। ছুটির দিন হলে অসুবিধে হয়না। কিন্তু অফিস দিনে হয় বিপত্তি।

    আমাদের বাল্যবন্ধু লালনের জিএফ সম্পর্ক কাট অফ করে দিয়েছে। তৌহিদের কাছে জানলাম, তার অন্যত্র বাগদান হয়ে গেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। কি করে জানিনা। পারিবারিক পর্যায়েই এই ব্যবস্থা হয়েছে। লালনকে ফোন দিতে স্বস্তি পাচ্ছিনা। বুঝতে পারি তার বুকের ভেতরের দহন জ্বালা কত তীব্র! অথচ তাদের রিলেশন আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে সৌরভ ছড়াতো। মানব-মানবীর মধ্যেকার সম্পর্ক অনেক ভেরিয়েবলস এর উপর ভর করে এগোয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই প্রেম-ভালোবাসায় অনেক বাধার চিত্র পাওয়া যায়। ব্যাক্তি স্বাধীনতার এযুগে প্রেম আজকাল সামাজিক আর পারিবারিক ভাবে অনেকটাই স্বীকৃত। এই রিলেশন নিয়ে অনেক কথা চালু আছে। ফেবু পেইজে কেউ “ইন এ রিলেশন” সেঁটে দিচ্ছে। কেউ কনফিজড হয়ে লিখছে “ইন এ কমপ্লিকেটেড রিলেশন”। আজকাল ভালবাসা প্রমান সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় কথায় প্রমিজ করা আর ভাঙ্গা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাসা বাড়ীতে কারেন্টের সুইচও এত অন অফ করতে হয়না যতটা ব্রেক আপ আর ব্লক ব্লক অনুশাসন চলে। আস্থার অগ্নি পরীক্ষা দিতে তাই উভয়ের পাসওয়ার্ড উভয়ের করতলগত থাকে। তাই ফেবু জুড়ে সচিত্র প্রেমের উদগীরণ দৃশ্যমান। আসল আর মেকির এই ভেল্কি দুর্বোধ্য ও অসহনীয়।

    লালনের জন্য মন কেমন যেন করছে। তৌহিদকে বললাম ওকে এখানে নিয়ে আসতে। প্রাকৃতিক এই নিসর্গে ভাল লাগবে।

    এমন সময় আম্মার ফোন। বাসায় কুরুক্ষেত্র অবস্থা। ভোরে সেলিমের সাথে মলির তুমুল কথা কাটাকাটি। দরোজা বন্ধ। ডাকাডাকি করলেও দরোজা কেউ খুলছে না। এই কিছুক্ষণ আগে মুখের উপর ব্যাগ ছুড়ে মেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে মলি। সেলিমও ত্যাড়ামো করে সেই ব্যাগ সম্বল করে ঝটিকা বেগে বেরিয়ে গেছে। কেন এই অবস্থা বিস্তারিত জানা না গেলেও আম্মা যতটুকু জেনেছে সে মলির কাছে টাকা চেয়েছে। অথবা গয়না। বিদেশ যাবে। মলি নাকচ করে দিয়ে বলেছে তাকে ওদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে রাখতে। সেখানেই টুকটাক কিছু করতে। আব্বার অবর্তমানে আম্মাই আমাদেরকে মানুষ করেছে এতকাল। তার শরীর যথেষ্ট খারাপ। তারচেয়ে আরো খারাপ তার মানসিক অবস্থা। পৃথিবীতে সুখের সংবাদ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পেরেশানির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে তার সুখের স্মৃতিগুলো। কয়েকদিন আগে পেপারে দেখলাম দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে দ্রুত বাড়ছে। আমাকে দেওয়া ডাক্তারের ওষুধগুলোর বেশির ভাগই নার্ভ রিলাকসেশন ও নিউরো ধাঁচের। তাহলে কি আমিও সেপথে এগোচ্ছি?

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (৮)
    খাগড়াছড়ি এসেই দুটি খবর পেলাম। একটা সেলিমের আবির্ভাবের। আরেকটা হলো আগামী সপ্তাহে দাপ্তরিক কাজে ঢাকায় যাওয়ার। মিটিং প্লাস তিন দিনের ওরিয়েন্টেশন। দুটোই দারুন খুশির খবর।
    সেলিমকে পাওয়া গেছে বললে ভুল বলা হবে। সে-ই এসে উদয় হয়েছে। বোনের সাথে থেকে থেকে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। খালা মাঝখানে পরে ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছে। আম্মা বোনকে গলা খাকাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু জামাইকে তো আর সেভাবে কিছু বলতে পারছে না। চুল-দাড়ি নিয়ে কিম্ভুতকিমাকার অবস্থায় বাসায় এসে উঠেছে সে। আম্মার হয়েছে জ্বালা। বুয়াকে আসতে বারণ করে দিয়েছে। বাসার এই একশন বেইজড, সাসপেন্সে ভরপুর বিরতিহীন সার্কাস প্রত্যক্ষ না করাই ভাল, তাই। খালার উপর পড়েছে বাড়তি চাপ। সেলিম এসে সেই যে লম্বা শোয়া দিয়েছে বোনের অগ্নুৎপাতেও আর উঠার নাম নেই। বালিশে মাথা গুঁজে চুপ মেরে পড়ে আছে। মুখে রা নেই। হাতে টাকা নেই। টাকার যোগান দেবে বোন। বোনের সোর্স আম্মা। আম্মার ভরসা ফ্ল্যাট ভাড়া। অর্থনীতির এই চক্রাকার বলয়ে চলছে আমাদের জামাই-পালন অর্থনীতি। তবু সবার মন খুশি নিঁখোজ লোককে খুঁজে পাওয়া গেছে। আম্মাকে বললাম,“কি বলে ও”?
    — কি আর বলবে? চুপ মেরে আছে। মুখে কথা নাই
    — কোথায় ছিলো এতদিন?
    — সিরাজগঞ্জে, ওর এক বন্ধুর ওখানে।
    — হতচ্ছাড়া
    — আমার হয়েছে যত জ্বালা। মলিকেও কিচ্ছু বলা যায় না।
    — কেন?
    — বললে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। সেলিমকে কিচ্ছু বলা যাবেনা। যা বলার ওই নাকি বলবে।

    আম্মা এগুলো বলে আর কাঁদে। বলে বলে হাল্কা হয় বুঝি। সেলিম টাইপের ছেলেদের সম্মোহনী গুণ মারাত্মক। এই যে এত অঘটন ঘটিয়ে কপর্দক শূন্য হয়ে শ্বশুর বাড়ীতে এসে লম্বা শোয়া দিয়েছে তাতে তার না আছে কোন শরম, না আছে কোন চিন্তা। নন-স্টপ বকা দিতে দিতে মলির রাগও পড়ে গেছে। মলি মানে আমার বোন। বাসা আপাতত শান্ত। তবে যে কোন সময় তেতে উঠতে পারে। ফোন দেই, ধরেনা। ধরবে কেমনে? মলি তার ফোন সীজ করে সুইচ অফ করে রেখেছে। বললেও তাকে ফোন দেয় না। আমার ভয় তার আবির্ভাবের খবর যদি পাওনাদাররা জানতে পারে তাহলে তো বাসায় এসে আবার ক্যাচাল শুরু করে দেবে। অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাসায় খোঁজ নেই। শুনি ‘ওয়ার এন্ড পিস’ খেলা চলছে। আম্মার কাছেই শুনি, চুল-দাড়ি বড় হয়ে জংলী রুপ নিয়েছে। কিন্তু কাটার নাম নেই। বোন খোঁচা দেয় ঠিকই। কিন্তু বেশি চাপাচাপিও করেনা। কারণ, সেলুনে গেলে যদি পাওনাদাররা গলায় গামছা দেয়? গুম, খুন করে ফেলে? অবশেষে বোনের মাধ্যমে ফোনে সেলিমকে পাওয়া গেল আজ। বললাম, “কাজটা তুমি মোটেই ভাল করো নি”।
    — জ্বী। তার সরল স্বীকারোক্তি।
    — এভাবে বাসার সবাইকে টেনশনে রাখা উচিত হয়নি। বিশেষত আম্মাকে।
    — জ্বী
    — তা এখন কি করবা?
    — জানিনা
    — একটা কিছু তো করতে হবে
    — কি করবো?
    — মুদির দোকান হলেও দাও
    — পয়সা নাই
    — এত এত টাকা কি করছো?
    — লস খাইছি
    — এখন পাওনাদারদের টাকা দিবা কেমনে?
    — জানিনা
    — জানিনা বললে তো হবেনা। ওরা তো আবার আসবে। তোমাদের বাড়ীতে বলো হেল্প করতে
    — দিবেনা
    — কেন?
    — ওখান থেকেও নিয়েছি
    — সেটা দিয়ে কি করেছো?
    — সাভারে মার্কেটে দোকান নিয়েছিলাম। পজিশন পাইনা
    — কেন?
    — যার কাছ থেকে দোকান নিয়েছিলাম আসলে সে ওটার মালিক না।
    — মানে?
    — বন্ধু ভুল বুঝিয়ে টাকাটা মেরে দিয়েছে।

    তার সাথে আলাপ করতে আমার মন আর রুচির কোনটাই হচ্ছেনা। অধিক শোকে পাথর হয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। মনে মনে ভাবছি, ফোনটা না করলেই ভাল হত।

    জামান ভাইয়ের শরীর ভাল না। অফিস করেন ঠিকই কিন্তু দুর্বল দুর্বল ভাব। বললাম, “চলেন সাজেক ঘুরে আসি। ভালো লাগবে। সবার কাছেই শুনি। আমি যাইনি কোনদিন”। হাসলেন। বললেন, “ছোট ভাই, মনটা আজ কয়দিন যাবত ভালো না। কেন জানি খুব অস্বস্তি লাগছে”। “কেন” জানতে চাইলেও কিছু বললেন না। জেমির কথা মনে হলো। জেমির সাথে দেখা হওয়ার পথ রুদ্ধ। কথা বলাও। তার উপর রাগ হলো। দুঃখও হলো। রাগ না দুঃখ ঠিক কোনটা হলো বুঝে উঠতে পারছিনা। থেকে থেকে অভিমানও হচ্ছে। ইলমাকে ফোন দিতে মন চাচ্ছে। বাটনে আঙ্গুল নিয়েও ফিরিয়ে নিলাম।

    একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে নবীন চিত্র শিল্পীদের চিত্রকলা প্রদর্শনী চলছিলো। জেমিই খবর এনেছে। সেখানে সিলেকটিভ লোক জন যায়। কেউ যায় কলা দেখতে। কেউ কলকাকলি করতে। দোতলায় ঘুরে ঘুরে শিল্পীদের চিত্র কর্ম দেখছি। দেখছি বললে ভুল হবে। জেমি দেখছে। আমি তার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করছি। ভিজিটরের সংখ্যা কম। যারা এসেছে তাদের মধ্যে চার ধরনের লোক রয়েছে। এক, চিত্র বোদ্ধা। দুই, অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের পরিচিতজন। তিন, এসির বাতাস খাওয়া ও সময়ক্ষেপনকারী। আর চার, অল্প বয়ষ্ক জুটি। তারা হাত বগলদাবা করে, কখনো কাঁধে হাত রেখে, আবার কখনো আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল লেপ্টে চিত্রকলা দেখার নামে নিরবে পাশা খেলছে। এদেরকে দেখে আমার কেন জানি অসহ্য লাগছে। বললাম, “দূর ছাই। এগুলো ছাতামাতা কি এত দেখছো”? “কেন, কি হয়েছে? ভালো লাগছে না”? জেমির প্রশ্ন। বললাম, “এ জন্য ডেকে নিয়ে এসেছো এখানে”? জেমি কেমন করে যেন তাকালো। মুচকি হেসে বললো, “অন্য কোন মতলব আছে নাকি”?

    আমি থতমত খেয়ে বললাম, “মানে”? জেমি এক জুটির দিকে চোখ ফেললো। ধরা খাওয়ার লজ্জায় বললাম, “কি যে বলো? আমার সেই ভাগ্য আছে নাকি”? বলা শেষ। অমনি হাতটা নিয়ে তার হাতের সাথে লেপ্টে নিলো। আমি কারেন্টের শক খাওয়ার মত হাত ছাড়িয়ে নিলাম। জেমি হাসলো। বললো, “ভিতুর ডিম। তার আবার খায়েস কত”? কখনো কখনো লজ্জা রাখার জায়গাও পাওয়া যায় না। বললাম, “এখানে চা-কফির ব্যবস্থা নেই। নীচে পিছনের গলিতে আছে। চলো”। সেই স্মৃতি আজো মনে পড়লে হাসি পায়।

    ইদানীং সন্ধ্যার সময়টায় খুব অস্থির লাগে। দিন রাত্রির পালা বদলের এই স্বল্প সময়টায় বিষন্নতা ভর করে। মনে হয় কি যেন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে আর ফিরে আসবেনা কোন দিন। মহাকালের আবর্তে কালের এই যাত্রা অন্তহীন, নিত্যই উধাও। অস্বস্তি কাটাতে তাই মাগরিবের নামাযকেই উৎকৃষ্ট বিকল্প বলে মনে হয়। নামায শেষে মুসুল্লীদের সমাগম কিছুটা কমলে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসি। কিছু বয়ান হয়। অনেকেই মাসলা মাসালা জিজ্ঞেস করে। অনেক মাসালা আমার নিজেরও জানা। অনেক অজানা। এভাবেই ইমাম সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ব্যাক্তিগত বিষয়াদি ছাড়াও নানাবিধ আলোচনা হয়। তাঁর বাড়ী হবিগঞ্জ। উচ্চারণে সিলেটি প্রভাব নাই বললেই চলে। একদিন একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “হুজুর, কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়”? ইমাম সাহেব হাসলেন। বললেন, “বাবাজী কি পেরেশানীতে আছেন”? আমি ধরা খাওয়ার মত লজ্জা পেলাম। বললেন, “যাকে ভালোবাসেন তারে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেন”। আমি মাথা নাড়লাম। কিন্তু মানুষ চাইলেই কি নামতার মত সব ক্ষেত্রেই দুই দুগুনে চার হয়?

    অস্থিরতা এমন এক বায়বীয় জিনিস যা বুকের গভীরে থেকে বিনাশী আগ্নেয়গিরির মত থেকে থেকে চাড়া দেয়। কিছু অস্থিরতা আছে অন্য কারো সাথে শেয়ার করা যায়। তাতে বুকের ভেতরে থাকা বিষবাষ্প নিঃসরণের সুযোগ পায়। পরামর্শ পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু অস্থিরতা আছে যা কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। এর দহন জ্বালা মারাত্মক।

    আম্মার ফোন। বিপর্যয় যখন আসে তখন হাতে হাত ধরে আসে। সেলিমকে বাসা থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সেই পাওনাদাররা থানায় মামলা করেছে। বড় মামা, ছোট মামা সব থানায়। বোন থেকে থেকে মুর্ছা যাচ্ছে। আম্মার প্রেসার উপরে উঠে বসে আছে সেই থেকে। এপার্টমেন্টের সবার কাছে মানসম্মান যা যাবার গেছে। থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোন উপায় নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাল কোর্টে তোলা হবে। সেখানেই জামিনের ফয়সালা যা হবার হবে। বাসা থেকে খাবার আর কিছু কাপড় নিয়ে গেছে মলি আর মামারা। আমার কোন প্রেসারের সমস্যা ছিলো না। এখন মনে হচ্ছে মাথা ঘুরছে, ঘাড়ও ব্যাথা করছে। চোখে ঝাপসা দেখছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। জামান ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসলাম। খুলে বললাম সব। হাসলেন। বললেন, “ছোট ভাই, এতেই ঘাবড়ে গেলে? যা হবার হয়ে গেছে। লিভ ইট। এখন বোল্ডলি সিচুয়েশন ফেস করতে হবে। ইউ হেভ টু ফাইল এ বেইল পিটিশন, এন্ড কনভিন্স দা লারনেড কোর্ট সো দেট বেইল বি গ্রান্টেড”। সমস্ত কাহিনী শুনে তিনি আরো বললেন, “ফাইল কেইসেস এগেইন্সট দৌজ হু চিট হিম টু রিকভার মানি”। আরো বললেন, “দুনিয়া কো লাত্থি মারো, দুনিয়া তুমারি হ্যায়। শুনো নি”? তার কাছে বসে আলাপ করে অনেকটাই হাল্কা বোধ করলাম। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। ছোট মামা সরকারি চাকরি করেন। তাকে বললাম জামান ভাইয়ের পরামর্শ মত কাজ করতে। রাতে ডিনারের পর জামান ভাই বেলকনিতে ডেকে নিয়ে বললেন, “এখনই এত হার্ড লাইনে যাওয়া দরকার নেই। যাদের কাছে সে টাকা পায় তাদের সাথে কনটাক্ট করো, মামলার ভয় দেখাও। উকিল নোটিশ পাঠাও। এনগেজ পলিকাল পাওয়ার, ইউজ মাসল, ইফ সিচুয়েশন ডিমান্ডস সো”। কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ধরে নাও তোমরা এখন ওয়ার ফিল্ডে আছো। অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। পড় নি”? তার কথা শুনে মাথা ঘুড়ানী কমে গেল। স্পষ্ট দেখতে পারছি শামুকের মত গুটিয়ে থেকে লাভ নেই। অফেন্সিভ হতে হবে। নাচতে নেমে ঘোমটা টেনে লাভ নেই।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (৭)
    বাসায় এই কয়দিনে অনেক কাজ জমেছে। কোনটা থেকে কোনটা যে করি? এই কয়দিন আম্মাকে প্রানবন্ত মনে হচ্ছে। বিকেলের দিকে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকলাম অলিতে গলিতে। সামান্য কয়েকদিনেই কেন জানি মনে হলো ধানমণ্ডি পাল্টে গেছে অনেক। আগের সে প্রাণ নেই। মানুষজন, গাড়ী-ঘোড়া সবই আছে আগের মত। কিন্তু কি যেন নেই? হঠাৎই মনে হলো জেমির দেখা নেই। তারচেয়ে বড় কথা তার সাথে দেখা করার পথও খোলা নেই। অতি পরিচিত লেকটাকে এখন পচা দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমা মনে হচ্ছে। স্ন্যাক্স আর ফুচকাতে এখন আর কোন আগ্রহ নেই। কোল্ড বা হট কোন কফিই আর টনিক বলে মনে হয়না। কেবলই মনে হয় জেমি ছাড়া রাজধানীর এত এত আয়োজন সব অর্থহীন। অভ্যাসবশত মনের ঘোরেই জেমিদের বাসার সামনে চলে এসেছি। সামনের বারান্দায় শুকোতে দেওয়া কাপড় ঝুলছে। বুঝাই যাচ্ছে কিউটির। সিকিউরিটি গার্ড আব্বাসকে বললাম, “মামা, খবরাখবর ভাল”? মাথা নেড়ে বললো, “ভালা। তয় বড় আপার খুব অসুখ। মাথায় কি না কি সমস্যা? যান, উপরে যান”। অন্তরাত্মা ধক্ করে উঠলো। মন একশ’ মিটার স্প্রিন্ট বেগে উপরে যেতে চাইলো। কিন্তু যেতে চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না। আমার জন্য সেখানে এক শ’ চুয়াল্লিশ ধারা জারি আছে।
    ইচ্ছে করেই রাত করে বাসায় ফিরলাম। সরাফত চাচাকে এভয়েড করার জন্য। ডাইনিং এ বসে খেতে খেতে আম্মার সাথে টুকটাক আলাপ হলো। সরাফত চাচা ওয়াশ রুমে যাবার ছলে বেরিয়ে এসে বসলেন। আম্মা উঠে গেলো। আমার খাওয়ার রুচিও উবে গেল। বত্রিশ দাঁত বের করে প্লাস্টিকের হাসি দিয়ে বললেন, “বাবাজী, ভাবীজান তোমারে কিছু বলছে”?
    — না তো। কেন?
    — না, এমনি বললাম।
    — চাচা, একটা হেল্প করবেন? আমার প্রশ্ন।
    — বলো বাবা, বলো
    — আমাদের কিছু টাকার দরকার। লোন দেবেন?

    সরাফত চাচার গলায় মনে হলো কাশিটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বললেন, “আমারই তো টাকা দরকার। পশ্চিম পাড়ার জমির লাগ দাগে পাঁচ কানি জমি বিক্রী করবো বজলু বেপারি। পোলারে মিডিল ইস্টে পাঠাবো। জরুরি দরকার। নিয়ত করছি, আমিই রাখমু। তাই ভাবীজানের কাছে আসছি”। আমি এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলাম। বললাম,“চাচা, আমি প্ল্যান করেছি চাকরিটা ছেড়ে দেবো। পাহাড়ে চাকরি ভাল লাগেনা। তাছাড়া ওখানে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে ঘুম, খুন লেগেই থাকে। আমার ভয় করে। আর বেতনও তেমন বেশি না। বাইরে থেকে সবাই বেশি বেশি মনে করে”।

    কথাটা তার মনপুত হয়নি বুঝা গেলো। তবে তিনি দমবার পাত্র নন। কঠিন জিনিস। মুখে কুচক্রী হাসি নিয়ে বললেন, “কি কও? তোমাদের চৌদ্দ গুষ্ঠির মধ্যে কেউ ব্যবসা করে নাই। ব্যবসার তুমি কি বুঝবা”? আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অতি আপন জন ভাব করে বললাম, “লোন নিয়ে পার্টনার শীপে জমি কিনবো। সেই জমিতে ডেভেলপারের মাধ্যমে ফিফটি ফিফটি রেশিওতে ফ্ল্যাট বানাবো। চড়া দামে হট কেকের মত বিক্রী করবো একেকটি ফ্ল্যাট। আর ঠ্যাং এর উপর ঠ্যাং তুলে খাবো”। লক্ষ্য করলাম সরাফত চাচা আমাকে গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করছেন। লোভাতুর চোখে তিনি আমার প্ল্যানের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। আবার নিজের মনের ভেতর ঘুড়পাক করতে থাকা সন্দেহ নিয়ে ভেসে উঠছেন। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমোতে যাবো বলে উঠতে যাবো। তখন তিনি অন্য প্রসঙ্গ পারলেন,“বিয়ে থা করবা না? বয়স তো যায় যায়”? বললাম, “ চাচা, বিয়ের কথা মাথাতেই নাই। আগে কোটিপতি, পরে ওসব”। তিনি কি যেন ভাবলেন? মাথা নাড়তে নাড়তে ওয়াশ রুমের দিকে অগ্রসর হলেন।

    এত ব্যস্ততার মাঝেও জেমিকে ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে। ওদের সিকিউরিটি গার্ড জানালো জেমির মাথায় সমস্যা। সেটা কি ধরণের? মারাত্মক কিছু? জানিনা। জানার উপায় নেই। ইলমাকে ফোন করা যায়। কিন্তু এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয় কিনা কে জানে? মানুষের মন নিজেকে প্রবোধ দিলেও তা প্রতিনিয়ত এক শ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করে। নতুন নতুন উছিলা খুঁজে। অনেক সাহস করে ইলমাকে ফোন দিলাম কয়েকবার। প্রতিবারই কেটে দিচ্ছে। বুঝলাম পরিস্থিতি অনুকূল নয়। খাগড়াছড়ি যাবার পর আরেকবার এমন হয়েছিল । জেমির ফোন বন্ধ ছিলো। লজ্জার মাথা খেয়ে ইলমাকে ফোন দিয়েছিলাম। কয়েকবার কেটে দেওয়ার পর ইলমা না ধরে তার মা ধরলেন। আর নন স্টপ যা তা বলে গেলেন। শেষে বললেন তার মেয়ের কিছু হলে আমি এর জন্য দায়ী হবো। আরো জানালেন, জেমির হাসবেন্ড দু’মাস পর দেশে ফিরবে। এসে জেমিকেও নিয়ে যাবে। আমি কিছু বলার আগেই ফোন লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গিয়েছিলো। সে হিসেবে জেমির হাসবেন্ডের দেশে আসার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এর পর? জানিনা। মাথা আর কাজ করছে না।

    বাসায় সবার মধ্যে যুগপৎ একধরনের লুকাছাপা আর অজানা আতংক কাজ করছে। সেলিমের খবর নেই। আম্মার মানসিক অবস্থা ভাল না। বোনের অবস্থা ততোধিক খারাপ। এর মধ্যে ঝামেলা আরো বাড়িয়ে তুলেছেন সরাফত চাচা। মামু বাড়ীর আবদারের মত তার টাকা চাই। জমি কিনবেন। আমরা না পারছি তাঁকে বিদায় করতে, না তিনি নিজে থেকে বিদায় হচ্ছেন। অথচ আমরা চাচ্ছি বোনের হাসবেন্ডের লা পাত্তা হওয়া ও এতদসংক্রান্ত ঝামেলার বিষয়টি যেন তাঁর কানে না যায়। গেলেই বিপদ। ঘটনার সাথে মনের মাধুরি মিশিয়ে স্বরচিত ও স্ব প্রযোজিত রগড কাহিনী দেশের বাড়ীতে রাষ্ট্র করে ছাড়বেন। এরি মধ্যে তাঁর ফোকাস বোনের কম ম্যুভমেন্টের উপর পড়েছে। রান্না ঘরে কি যেন আনতে গিয়ে তাঁর সামনে যেই পড়েছে অমনি তিনি মিসাইল ছুঁড়ে দিলেন, “আম্মা জানের কি মন খারাপ? নাকি শরীর খারাপ”? বোন কাচুমাচু হয়ে বললো, “না চাচা, ভাল আছি। একটু ঠান্ডা লেগেছে এই যা”। তিনি ছাড়বার পাত্র না। বললেন, “জামাই বাবাজী আসেনাই”? এই পর্যায়ে আমাকেই আগ বাড়িয়ে বলতে হলো, “চাচা, ও তো ব্যস্ত। তাছাড়া ক’দিন আগেই এসে থেকে গেছে কয়েকদিন”। আলাপের ফ্লাইট অন্য দিকে ঘুড়াতে বললাম, “আপনার কাজ শেষ”?
    — শেষ আর হইলো কই?
    — কেন?
    — হাইকোর্টের উকিল খুব ধুরন্ধর। খালি ঘুড়ায়। তয় আমিও কম না।
    — চাচা, এভাবে ঢাকায় এসে উকিলের পিছে টাকা খরচ করে লাভ কি? তারচেয়ে আপনি বাড়ী চলে যান।
    মোবাইলে খবরাখবর রাখবেন।
    — কথা খারাপ কও নাই। ভাবছি ভাবীসাহেবা একটা ব্যবস্থা করলেই চলে যামু।
    — কি ব্যবস্থা?
    — ওই যে ক্ষেত কিনার টাকা আর কি
    — চাচা, আমি আপনাকে সেদিন বললাম না আমারই অনেক টাকার দরকার। আম্মা টাকা দেবে কোত্থেকে? তাছাড়া
    দেখছেন না আম্মার শরীর ভাল না। কাজের বুয়া নেই। খালাকে আনা হয়েছে সাময়িক। আম্মার কষ্ট লাঘব করার
    জন্য। তারও তো সংসার আছে। তাছাড়া আমিও তো খাগড়াছড়ি চলে যাবো পরশু।

    সরাফত চাচা মাথা নাড়লেন। বললেন, “হ, ভাবী সাহেবার শরীরটা ভাল মনে হইতেছে না। ভাবতাছি সময় সুযোগ করে পরে আবার আসুম”। আমি আর কথা না বাড়িয়ে সুপ্ত উল্লাস চেপে রেখে বললাম, “চাচা, রাত অনেক হয়েছে। ঘুমান। ফজর মিস হয়ে যাবে”।

    আজ রাতের কোচে খাগড়াছড়ি ফেরার কথা। সরাফত চাচা বিদায় হয়েছেন। এতে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। কিন্তু আম্মার শরীরটা আবারো খারাপ করেছে। বোনের বিলাপ আর অনুযোগের শেষ নেই। তার ধারণা আমরা তার হাসবেন্ডকে খুঁজে পেতে কার্যত কিছুই করছি না। বরং তাকেই এখন আপদ ভাবছি। বললাম, “তোর শ্বশুর বাড়ীর ওদেরকেও বল। ওরাও খুঁজুক”। এই কথা বলে আমি পড়লাম তোপের মুখে। বোন পারলে এখনই বাড়ী থেকে যেদিকে দু’চোখ যায় সে দিকে চলে যায়। খালা তাকে বুঝাচ্ছে। নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। আম্মা অসন্তুষ্ট হয়ে বললো, “ জানিস ওর মন ভালো নেই। শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছিস কেন”? আমি চুপ হয়ে গেলাম। ঘড়ি দেখলাম। আরো ঘন্টা দেড়েক বাকী। এখান থেকে রাসেল স্কয়ার বাস কাউন্টারে যেতে খুব বেশি হলে পনের-বিশ মিনিট লাগবে। বোনের কাছে গিয়ে বললাম, “শুধু শুধু উল্টা বুঝিস কেন? বড় মামাসহ আমরা তো চেষ্টার ত্রুটি করছিনা। ধৈর্য্য ধর। আল্লাহকে ডাক। ইন শা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে”। বিদায়ের মুহুর্তকে আমি কোন দিনই ফেইস করতে পারিনা। আমার কাছে বিদায় মানে অতি দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে যাওয়া। আম্মার মুখের দিকে তাকাবার মত মনোবল পাইনা। ব্যাগটা হাতে নিয়ে খালাকে বললাম, “আম্মাকে দেখো”।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৬)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৬)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৬)
    এর আগে খাগড়াছড়ি আসিনি। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যে লালিত, শোভিত এই উপত্যকা যেন বর্ণিল পশরা বিছিয়ে রেখেছে সর্বত্র। আমার থাকার জায়গা হয়েছে এক ফ্ল্যাট বাড়ীতে অপর তিন সহকর্মীর সাথে। সহকর্মীরা সবাই আমার সিনিয়র। সারাদিন প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুড়ে বেড়াই কাজে। সন্ধ্যায় সব পাখী ঘরে ফেরে। তাই বাধ্য হয়েই ঘরে ফিরি। ফেবুতে মজে থাকি। বন্ধুদের সাথে ফোন আর চ্যাটিং করে রাত কাবার করে দেই। জেমির কথা থেকে থেকে মনে পরে। দিনে কাজের মধ্যে যতটা হাল্কা থাকি রাতে ততটাই জেমি নির্ভরতা পেয়ে বসে। আমারই আবেগের বেয়ারা বেগ যে পরিস্থিতিকে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তা বুঝি।

    আমাদের সিনিয়র সহকর্মী কাম হাউজ মেট রশিদ জামান ভাই বড় ভালো মানুষ। বয়স চুয়াল্লিশ-পয়তাল্লিশ হবে। বিয়েশাদি করেন নি। কাজ ছাড়া আর সব কিছুতেই তিনি বড় বেশি উদাসীন। তার কোন পিছু টান নেই। শিশুর মত সরল সহজ এই মানুষটি রাতে খাবার পর দরোজা এঁটে পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান করেন। তাও বিরহের। তার ঢেউ এসে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। তাঁকে ঘিড়ে আমার কৌতুহল বাড়তেই থাকে। তার গাওয়া গানগুলো সব বিরহের । এই গানগুলো আগে অনেকবার শুনেছি। কিন্তু হৃদয়ে এভাবে বিঁধে নি এর আগে কোনদিন। শুনতে শুনতে আমি আপ্লুত হয়ে যাই। আচমকা একদিন বললেন, “ছোট ভাই, হেভ ইউ গট এনি প্রবলেম ইন সাইড”? আমি থতমত খেয়ে গেলাম। তিনি তা বুঝতে পেরে বললেন, “আই কেন গ্যেস। লিভ ইট। ইউ নিড নট এক্সপোজ , ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডু”। আমি আরো কুঁকড়ে গেলাম। তাকে মনে হলো মাইন্ড রিডার। বললাম, “আপনিও কি কিছু বয়ে বেরাচ্ছেন”? তিনি আশ্চর্য হয়ে বিস্ফারিত চোখে বললেন, “কেন এমন মনে হলো”? আমি কাঁধ নেড়ে বললাম, “কেন জানি মনে হলো”। প্রসঙ্গ পাল্টাবার অছিলায় বললাম, “আপনার গলা কিন্তু ভারি সুন্দর। বিশেষত বিরহের গানগুলো সুপার্ব”। সেই মুহুর্ত থেকে আমাদের যৌথ অবসর কাটে নানা প্রসঙ্গে।

    খাগড়াছড়িতে আমাদের বাসার লাগোয়া জামে মসজিদ। বেশ বড়। পাঁচ বেলা আযানের ধ্বনি কানে এসে নাড়া দিয়ে যায়। অস্বস্তি ফিল করি তখন যখন মুয়াজ্জিনের কন্ঠে শুনিঃ হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ। নামাযের জন্য আসো, কল্যাণের জন্য আসো। মনে পড়ে ছোটবেলায় বাসায় নামাযের কড়াকড়ি ছিল। বাবা আঙ্গুলে ধরে নিয়ে যেতেন মসজিদে। কাতারের এক প্রান্তে নিয়ে বসতেন। বলতেন তাঁকে অনুসরণ করার জন্য। আম্মা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বা অবসরে ছোট ছোট সুরা মুখস্ত করাতেন। কাল গড়িয়ে গেছে অনেক। বাবা হয়েছেন গত। কিশোর হয়েছে যুবক । সব কিছু শিথিল হতে হতে আজ যৌবনের সম্ভারে যুক্ত হয়েছে রকমারি বিষয়াদি।।

    এখানে আসার পর ছুটির দিন গুলোতে আযানের সমর্থনে একটু একটু করে জামাতে গিয়ে দাঁড়াই। ইমাম সাহেবের কেরাত খুবই সুললিত। মনে গেঁথে যায়। সেই টানে ‘নিয়মিত’ হতে চেষ্টা করছি। বিশেষত ছুটির দিন গুলোতে। মনের ভেতর অস্বস্তি থাকলে মানুষ নিষ্কৃতির পথ খুঁজে। কেউ নেশায় সমাধান পথ বেছে নেয়। কেউ নিজেকে হনন করে, আর কেউ সন্ন্যাস পথে। এর কোন পথই আমাকে টানেনা।

    আম্মার জন্য মন পোড়ে। জন্মেছি ঢাকায়। সে অবধি আম্মার সাথেই থেকেছি বরাবর। এক নাগাড়ে এত দিনের জন্য ঢাকা ছাড়িনি এর আগে কোনদিন। ছোট বোনটা বাসায়। আছে খালাও। বোনের হাসবেন্ড সেলিমের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে বাসায় অশান্তি। আমি দুশ্চিন্তায়। সেই দুশ্চিন্তা চরমে গিয়ে পৌছলো সেদিন, যেদিন বাসায় দুই পাওনাদার এসে হাজির। আম্মার প্রেসার চরমে। বোন বিলাপে। নীচে পাওনাদারদের উচ্চস্বরে হৈ চৈ, হুংকার। তারা থানায় মামলা করার হুমকি দিয়ে গেছে। খালা ঘন ঘন ফোন দিয়ে ঢাকা যেতে বলছে। বড় মামা থানা-পুলিশের বিষয়টা দেখছেন। এ সময়ে আম্মার কাছে আমার থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ছুটি চাই কি করে? মাথায় এলো জামান ভাইকে বলে দেখা যেতে পারে। কাজও হলো। বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মস্থল ত্যাগের অনুমতি মিলেছে।

    নাইট কোচে রওনা দিয়ে যখন বাসায় গিয়ে পৌছলাম তখন খুব ভোর। আম্মাকে পেলাম কোরআন তেলওয়াতরত। খালা রান্নাঘরে। বোনের রুম লকড। তবে বাসায় নতুন অতিথির আগমন হয়েছে। আম্মা ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললো,“সরাফত এসেছে। অতএব সাবধান”। সরাফত আব্বার দূরসম্পর্কের চাচাত ভাই। অতিশয় বৈষয়িক ও কথাকে ইচ্ছেমত মাল্টি চ্যানেলে সম্প্রচারে চ্যাম্পিয়ন। তাকে দেখলেই আমার কেন জানি বিটিভি নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রয়াত ফখরুল হাসান বৈরাগীর কথা মনে হয়। দেখতে অবিকল তারই মত। আচার-আচরণ ও কথাবার্তাতেও। আমি নিজের মনকে শাসন করলাম এই বলে যে, এমন ভাব করতে হবে যেন কোথাও কিচ্ছু হয়নি। সব কিছুই আগের মত চলছে। ওয়াশরুমে যাওয়ার মুখে তার সাথে দেখা। দেখা না, বলা ভাল তিনি দেখা দিলেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন,“ভাতিজা, তুমি নাকি অনেক টাকার চাকরি পাইছো”? আমি প্রমাদ গুনলাম। এর উত্তরে কি বলি আর উনি কি থেকে কি তর্জমা করেন কে জানে? বললাম,“চাচা, সারা রাত জার্নি করে এই এলাম। আপনি নাস্তা-টাস্তা করেন। পরে কথা হবে”। ভেবেছিলাম এতে সাময়িক মুক্তি পাবো। কিন্তু মাথা নেড়ে বললেন,“তা ঠিক। তবে আমারও তাড়া আছে। হাই কোর্টে যাইতে হবো। বরং দুইজনেই নাস্তা করি আর জরুরি কিছু কথা আছে, সেগুলি সারি। এই সাংসারিক আরকি”। আমার প্ল্যান ভস্মীভূত হয়ে গেলো। বললাম, “আইচ্ছা”।
    ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আম্মার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,“উনি কেন এসেছেন”? আম্মার উত্তর, “কেন আবার? টাকা চাইতে। ক্ষেত কিনবে”।
    –টাকা কি গাছের গোটা? চাইলেই হলো? আমার উত্তর।
    — সেটা তো আর সে বুঝবে না।
    — ব্যস। এই টাকা চাইতেই এসেছেন?
    — আরো একটা উছিলা আছে
    — কি?
    — তোর বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে। গ্রামের মেম্বরের একমাত্র মেয়ে। জমিজমা প্রচুর। ইন্টার পড়ছে।
    আমার মাথায় রক্তের স্ফুটনাঙ্ক উচ্চ স্কেলে গিয়ে অনবরত বাড়ি মারছে। গত রাত্রে এসেছেন। টাকা পেলেই চলে যাবেন। বাসার সাম্প্রতিক খবরাখবর এখনো জানতে পারেন নি। তবে ছুটাবুয়া এলেই জেনে যাবেন নিশ্চিত । তবে ভাগ্য ভাল যে, আম্মা তাকে আজকে আসতে বারণ করেছে।
    সেই সরাফত চাচার সাথে খাবার টেবিলে আলাপ। আমার উদ্দেশ্য নাস্তা করিয়ে বিদায় করা। বললাম, “আজই চলে যাবেন”?
    — মনে হয় সেটা হবে না। তবে তাড়াতাড়ি যাওয়াই দরকার। বাড়ীতে আমার অনেক কাজ।
    — ঢাকায় কি কাজে এসেছেন?
    — আমাদের গ্রামের কাসেম মাস্টারের পোলার হাইকোর্টের মামলার খোঁজ নিতে
    — আপনি কেন? তারা খোঁজ নিতে পারেনা? শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট দেয়।
    — আরে ওরা কি লাইন ঘাট এত বুঝে?
    — আপনি বুঝেন?
    — আল্লাহর রহমতে গাও গেরামে এই বিষয়ে আমার নাম আছে।
    — আর কোন কাজ?
    — আছে। সেটা ভাবীরে কইছি। তুমি চাকরি পাইছো শুনলাম। বিদেশি অফিস। মনে হয় ট্যাকা পয়সা ভালই পাও।

    আমি গরম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেললাম। বিরক্তি চেপে বললাম, “চাচা, আমি টায়ার্ড। এখন ঘুমাবো”। এতে তিনি যেন বিস্মিত হলেন। চা খেয়ে কেউ ঘুমায় নাকি? তাই তো। আমি তাড়াতাড়ি আমার রুমে গিয়ে দরোজা লক করে দিলাম। এ যেন ফাঁসির আসামীর মত কনডেম সেলে নিজেকে বন্দী করে রাখা।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৫)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৫)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৫)
    রাজউক অফিসে এসেছি। এক আত্মীয়ের পূর্বাচল প্লটের রেজিস্ট্রেশন কাজে। অফিস আদালতের কাজে আমার বড়ই বিরক্তি। সরকারি অফিস হলে তো আরো। এখানে সব অদ্ভুতুড়ে কায়কারবার হয়। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। সেবা আছে, পাওয়া যায় না। আবার লাইন ঘাট, চেনা-জানা থাকলে মিলে যায় সহজে। এখানে কর্তাব্যক্তি থেকে নীচের পিওন পর্যন্ত সবাই যেন কেমন মন মরা, ম্যাড়মেড়ে। কথা বললে শুনে কি শুনে না, বুঝে কি বুঝে না জাতীয় ভাব নেয়। কোন পেপার বা ডকুমেন্ট দেখালে দেখতে পায় কিনা তাও বুঝিনা। অথচ শক্তিশালী কারো রেফারেন্স নিয়ে গেলে বা সিন্ডিকেটের হাত ধরে গেলে এসি রুমে অপত্যস্নেহে বসিয়ে পই পই করে সব কিছু বললে শুনে আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দেখালে গুরুত্ব দিয়ে দেখে। আর যদি কেবলাকান্ত’র মত একাকী যান তাহলে মধুমক্ষিকাদের কবলে পড়তে হবে। অনুযোগ করবেন? নথী গায়েব হয়ে যাবে। নয়ত রাজধানীর ক্যাবল জটের মত আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারবেন না। এমন প্যাচ কষবে যেন মনে হবে এর চেয়ে ছোটবেলার তৈলাক্ত বাঁশে বানরের আরোহন-অবরোহন অংকই অনেক সহজ ছিলো। তাই পারতপক্ষে সরকারি অফিসে যাইনা। যেতে চাইনা। তৌহিদ সেক্ষেত্রে হরফুন মাওলা, সকল কাজের কাজী। তাকে ফোন দিয়ে নিয়ে এসেছি উদ্ধার করার জন্য।

    কাজ শেষে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। রাজউক ভবনের পাশের গলিতে নিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অল্প তেলে ভাজা গরম গরম পরোটা আর ডাবল ডিম মামলেট দিয়ে করা দেশজ রোল খেতে খেতে আলাপ জমে উঠলো। হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলো, “সেই মহিলাটা কে? কি করে? কদ্দিন চলছে”? মুখে দেওয়া খন্ডিত রোল গলায় আটকে গেল। গলা শুকিয়ে গেছে। রোল আর নামছেও না, বেরও হচ্ছেনা। পানি খেলাম। বললাম, “আরে না। ওরকম না। সে তো ম্যারিড। তার এক কিউটিও আছে”। “ডিভোর্সি”? তৌহিদের পাল্টা প্রশ্ন। আমার খাওয়ার ইচ্ছে শেষ। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। অসহায়ের মত সরল স্বীকারোক্তি দিলাম, “ না”। ততোধিক বিস্ময় নিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “তাহলে কেমনে কি? এর পরিণতি কি”? আমার অস্বস্তি লাগছে। বললাম, “জানিনা। লিভ ইট”। তৌহিদ স্বগতোক্তির মত অস্ফুটস্বরে বললো, “পরকীয়া”? শব্দটা কানে যতটা বাজলো তার চেয়ে গুনিতক হারে হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা মারলো। লজ্জায়, শংকায়, অপমানবোধে সব কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন লাগছে। তৌহিদকে বিদায় দিয়ে যতই এগোচ্ছি ততই একটা শব্দ ‘ইকো’ হতে থাকলো। তা হলো পরকীয়া।

    বাসায় ফিরে গুগলে সার্চ দিলাম। পরকীয়া মানে কি? তেমন কনভিন্সিং কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। যা পাওয়া গেল তাহলো, স্বামী বা স্ত্রী অন্য কারো সাথে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে দোষী সাব্যস্ত হবে। ব্যভিচারী বলে গণ্য হবে। আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম, আমাদের সম্পর্ক এই সংজ্ঞায় পড়ে না। কিন্তু মাথায় অনেক প্রশ্নের উদয় হলো। পরকীয়া তাহলে কি? কারা এর পর্যায়ভুক্ত? কেবলই বিবাহিত পুরুষ আর বিবাহিতা নারীরাই এর আওতাধীন? যদি তাই হয় তবে আমাদের সম্পর্ক সে পর্যায়েও পড়ে না। পরক্ষণেই জানার আগ্রহ আরো বাড়লো। একজন বিবাহিত আর অপরজন অবিবাহিত হলে কি তাদের সম্পর্ক ‘পরকীয়া’ বলে গণ্য হবে? এ বিষয়ে কোন সদুত্তর পাওয়া গেলনা। মন আরো জিজ্ঞাসু হয়ে উঠলো। তাহলে কি পরকীয়ার জন্য বিবাহিত হওয়া আর যৌন সম্পর্ক স্থাপন আবশ্যকীয় শর্ত? যদি তাই হয় তাহলে দু’জন বিবাহিতের বিবাহ বহির্ভূত অথচ যৌনতা মুক্ত সম্পর্ককে কি পরকীয়া বলা যাবে? আচ্ছা, এর কারণইবা কি? এর কারণ শুধুই কি মনস্তাত্ত্বিক নাকি দৈহিকও? নাকি উভয়ই? এর উপকারিতাই বা কি? এর উপকারিতা ততক্ষনই বেশুমার আনন্দময় থাকে যতক্ষণ তা অনুকূল আবহাওয়ায় থাকে। তাহলে এর অপকারিতা কি? এর অপকারিতা অপরিসীম। কপাল মন্দ হলে প্রতিকূলতায় এর পরিণতি মৃত্যু অবধি সম্প্রসারিত। নিদেন পক্ষে লাঞ্চনা-গঞ্জনা, জেল আর ডিভোর্স অতি স্বাভাবিক। অনেকটা দু’কুল হারাবার মত। নীতির মানে তা অনৈতিক। সামাজিক মানদন্ডে গর্হিত। ধর্মীয় ফয়সালায় ইহকাল চৌচির আর পরকালের ডেস্টিনেশন হাবিয়াময়। মাথা আউলিয়ে গেলো। তাহলে মোটের উপর দাঁড়ালো কি? যাই দাঁড়াক আমি এর মধ্যে পড়িনা। তৌহিদকে ফোন দিতে গিয়েও দিলাম না। একটা জায়গায় গিয়ে আটকে গেলাম। জেমি বিবাহিতা। পরক্ষণেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই ভেবে যে এত অংক কষে আর যা হোক প্রেম-ভালোবাসা হয় না।

    দুপুর থেকেই মনটা বিষন্ন। শুয়ে শুয়ে ভাবছি অনেক কিছু। পুরনো দিনের। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই বছর। ভালবেসে যাকে বিয়ে করেছে সে একটা জিনিস বটে। যত সব উদ্ভট আর মেগা মেগা চিন্তা তার। কাজের বেলায় বিরাট অশ্ব ডিম্ব। এই ধরনের ছেলেদের আমি ছাত্রাবস্থা থেকেই অপছন্দ করতাম। পকেটে নাই দুই টাকা অথচ গপ সপ লক্ষ টাকার। মানুষও এদের কথায় বিমোহিত হয়। নিজে যেমন অলীক স্বপ্ন দেখে তেমনি তার চারপাশ ঘিড়ে থাকা লোকজনকেও দেখিয়ে ছাড়ে। বলা নেই কওয়া নেই, বাসার চাল চুলোর খবর নেই হঠাৎ করেই একদিন পুরোনো এক কার নিয়ে হাজির। তার শ্বাশুড়িকে দেখাতে। আমাকে বলেনি। জানে, এগুলো আমার মোটেই পছন্দ না। শ্বাশুড়িকে সারপ্রাইজ দিয়ে জামাই হিসেবে তার উপযুক্ততা প্রমানের এই প্রয়াস হাস্যকর সন্দেহ নাই। কিন্তু জীবন যাপন প্রণালীর ভবিষ্যত হিসেবে আশংকার বটে। সেই কার নিয়ে সে বোনকে সাথে করে ঘুড়বে আর বন্ধুদের সাথে ফুটানী করে বেড়াবে এটাই তার মিশন, ভিশন। অদ্ভুত। গাড়ীর জ্বালানী কোত্থেকে আসবে? এর উত্তর নাই। যোগানের ব্যবস্থাও নেই। তার উপর আরেকজনের গছিয়ে দেওয়া সেই পুরোনো গাড়ী এক কিলো যেতে তিন বার বন্ধ হয়ে যায়। আজ তার টায়ার পাংচার তো কাল লাইট জ্বলেনা। পরশু হর্নে সমস্যা। তরশু ব্রেক সু প্রবলেম। বোন দুয়েকবার তার সাথে গাড়ী চড়ে ঘুড়তে গিয়ে এই বিড়ম্বনায় পড়ে আর উঠেনা। বাসায় এই নিয়ে থমথমে পরিবেশ। আম্মা পড়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে জামাই বলে কথা। হোক তা ‘না পছন্দ’। অন্যদিকে নিজের মেয়ে ও তার সংসার।

    হঠাৎ একদিন শুনি সেই গাড়ী অর্ধেক দামে বিক্রী করে দিয়েছে। ভাবলাম সুমতি হয়েছে। অন্তত দুঃশ্চিন্তা থেকে তো বাঁচা গেলো। কিছুদিন যেতেই দেখি বাসায় চিল্লাচিল্লি। বোনের। আম্মা থেকে থেকে চোখ মুছছে আর বোনকে বলছে, “আমার হয়েছে জ্বালা। হুট করে বিয়ে করে বসলি এই ছেলেকে। কতবার বললাম এর চাল চুলো ঠিক নেই। এখন বুঝ”। আমার ঘুমে যথেষ্ট ব্যাঘাত হচ্ছিলো। ভাবলাম নিত্যকার টপিক একটু পরেই থেমে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই কান গরম হয়ে গেলো, “আর একটা পোলা খালি ঘুমায়। চাকরি বাকরির খবর নাই। ইচ্ছাও নাই। খায় দায় আর বাবুগিরি করে বেড়ায়’। এ পর্যন্ত তবু মেনে নেওয়া যায়। ঠিকই তো বলেছে। কিন্তু পরের কথাটা ধক করে বুকে সুই ফোঁটালো, “ আমারে বিধবা করে তুমি কই রেখে গেলা”? আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। রুম থেকে বের হয়ে এলাম। আম্মাকে বললাম, “কি হয়েছে আম্মা? এ আর অমন নতুন কি? সেলিম তো এরকমই। তোমার মেয়েই তো গোঁ ধরে এই বিয়ে করেছে। আমি তো তখনই বলেছিলাম এই বিয়েতে আমার মত নেই। এখন পস্তাচ্ছো কেন”? এই কথা বলা শেষ আর পাশের রুম থেকে বোনের বিলাপ শুরু, “বাবা তুমি আমারে কই রেখে গেলা? আমার তো কেউ নাই”। বোনের এই বিলাপে মেজাজ শূন্য ডিগ্রীতে নামিয়ে আনলাম। বোনের কান্না সহ্য হয়না। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে চাইনি। আম্মার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কি হয়েছে বলো তো”। আম্মার কথা শুনে চক্ষু চড়কগাছ। বোনের হাসবেন্ড মানে সেলিম লাখ পাঁচেক টাকা তার এক বন্ধুকে দিয়েছিল যৌথ ভাবে গার্মেন্টসের স্টক লটের ব্যবসা করবে বলে। এর মধ্যে আম্মার দুই আর বোনের দুই। বাকী টাকা সেলিমের গাড়ী বিক্রির। সেই বন্ধু স্টক লট ব্যবসা শুরু করার আগেই স্টপ করে সোজা মালয়েশিয়ায় চলে গেছে কাউকে না জানিয়ে। এর আগেও আম্মার কাছ থেকে নিয়েছে তিন লাখ আর বোনের বিয়ের গয়না বিক্রি করে নিয়েছে তিন লাখ। আমি জানিনা। এই টাকা ই-ভ্যালিতে খাটিয়েছে। সেটাও খোয়া গেছে।

    পরিস্থিতি ভয়াবহ। সান্ধ্য আইন জারী করেও লাভ নেই। প্রলাপ-বিলাপের এই হৃদয় বিদারক পরিবেশ কবে কোথায় গিয়ে শেষ হয় কে জানে? আম্মাকে বললাম, “এতগুলা টাকা ওরে দিলা আমারে একবারও বললা না”? আম্মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “বললে কি তুই দিতে দিতি? তাছাড়া জামাই আর মেয়ে দু’জনেই বারণ করেছিলো”। “অবশ্যই না করতাম” মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। আম্মাও বললো, “নিজের একটা মেয়ে হলে তখন বুঝবি”। আমি থ মেরে গেলাম।

    প্রতিটি ফ্যামিলিতে এরকম একটা না একটা ‘ইন্দ্রনাথ’ টাইপের অবিমৃষ্যকারী থাকে। পুরো পরিবার এই হিডেন ডিনেমাইট নিয়েই প্রতিটি দিন গোজরান করে, কখন সেটা ফেটে সব কিছু চৌচির করে দেবে এই আতংকে। এই প্রথম মনে হলো, ফ্যামিলির জন্য কিছু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর ফলশ্রুতিতেই এই দুই টিউশনি।

    সেলিমের মত এই ধরণের উচ্ছন্ন প্রকৃতির ছেলেদের সাংঘাতিক রকমের কারিশমা দেখে আশ্চর্য্য না হয়ে পারিনা। ওয়ান টুয়ের মধ্যে যে কাউকে যাদুবশ করে ফেলতে পারে। যাদের কাছে সে ধরা খায় তারা কাছের লোক। আবার যাদেরকে সে ধরা খাইয়ে দেয় তারাও তার কাছের লোক। ঘটনাগুলো পুনঃ পুনঃ ঘটে কিন্তু বিস্ফোরণ হয়না। আজ তার প্রতি বড় রাগ হচ্ছে। “সে কোথায়” বোনকে জিজ্ঞেস করলাম। জানা গেলো, সে লাপাত্তা। কোত্থেকে যেন ফোন করে জানিয়েছে তাকে খুঁজে লাভ নেই। সামর্থবান না হওয়া পর্যন্ত সে আর তার সামনে আসবেনা।

    মানুষ বেশি বিপদে পড়লে বলে ত্রিশংকু অবস্থায় পড়েছে। আমার হয়েছে সেই দশা। আম্মার ঘরে যাই। আম্মা শুয়ে আছে। শান্তণা দেই। যদিও জানি ছেলে ভোলানোর মত শোনাচ্ছে। এর ইমিডিয়েট কোন দাওয়াই নেই। বোনের কাছে যাই। আজকাল অল্পতেই মানুষজন সুইসাইড করে বসে। আত্মা ধক করে উঠলো। আল্লাহ না করুন এমন কিছু করে বসে। তার অবস্থা ভয়াবহ। কথা বলেনা। বলে, “ওরে আমার কাছে ধরে আনো”। আমিও কৌশূলী না হয়ে বলে ফেললাম, “এনে দিলে কি করবি? তুই-ই তো সবাইকে অশান্ত করে জোর করে এই বিয়ে করেছিস। এখন বুঝ”। কথা মাটিতেও পড়তে পারেনি। তার উচ্চ বিলাপে বাসা মুখর। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন হয়ত লজ্জায় এখনো দরোজায় টোকা দিচ্ছেনা। আমি সরে পড়লাম। আম্মা উঠে এসে আমাকে মৃদু বকা দিলো। বললো, “পারলে খোঁজ নিয়ে দেখ হতচ্ছাড়াটা কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে”। সেদিনের পর থেকে সেলিমকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ।

    এদিকে জেমিকে নিয়ে আমিও প্যারার মধ্যে আছি। আম্মাকেও রেখেছি। বাতের ব্যাথাটা খুব ভোগাচ্ছে তাকে। সারাদিন গরম পানির ছ্যাঁক দেয় আর তেল জাতীয় কি যেন মালিশ করে। এ অবস্থায় খাগড়াছড়ি যেতে মন চাচ্ছেনা।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৪)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৪)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৪)
    টিউশনি শেষে বই খাতা গুছাতে গুছাতে ইলমা আচমকা আবদার করে বসে, “স্যার, আপনার সাথে কাল বিকেলে রিক্সা করে ঘুড়বো”। আমি থ। বুঝে উঠতে পারিনি। বললাম, “ না, না। তা কিভাবে সম্ভব”? ইলমা পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো, “ কেন, স্যার? ঘুরলে কি হয়”?
    — অসুবিধে আছে। তাছাড়া তোমাদের বাসা থেকে এটা এলাউ করবেনা।
    — বাসার কাউকে বলবো না তাহলে।
    — সে কি করে হবে? আর এটা হয়না।
    — কেন, আপু রাগ করবে?
    — মানে?
    — মানে, আপুকে ভয় পান? ইলমা হাসলো। সে হাসির রহস্যভেদ করা গেলনা। আমি প্রসঙ্গান্তর করার চেষ্টা করলাম। ইলমা মুখ কালো করে বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো। তবে কি ইলমা আমাদের সম্পর্কের কিছু আঁচ করতে পেরেছে? কিছুটা লজ্জায় আর ততোধিক অজানা আশংকায় নিরবে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

    বাসায় পাত্রী দেখার ধুম পড়ে গেছে। শেষতক একজনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। বড় মামার এক জুনিয়র কলিগের একমাত্র সন্তান। বিদেশী ব্যাংকে চাকরি করে। ধানমন্ডি আর বনানীতে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং আর মার্কেট আছে। বড় মামার প্রেসক্রিপশন, আমার চিত্ত বৈকল্য হয়েছে। আমি ডিট্র্যাক্ট হয়ে গেছি। বিয়ে দিয়ে দিলেই প্রবলেম সলভ। সেই মেয়েই নাকে রশি বেঁধে ট্র্যাকে উঠিয়ে নেবে। ‘বিজনেস’ ভুত মাথা থেকে পালাবে। তাঁর এই প্রেসক্রিপশন আম্মার মনমত হয়েছে। তাই কয়েক দিন যাবত তাকে ফুরফুরে লাগছে।

    বিসিএস না হোক ছেলের সুমতি হয়েছে। জীবিকার ভাল একটা রাস্তা তো হয়েছে। তাঁর কথা মত কাজ হয়েছে- সেই উত্তাপ নিয়ে বড় মামা আবার এলেন। কেন এলেন? সেলিব্রেট করতে? মোটেই না। আম্মা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে চাকরি তো হলো। এখন যদি সেই কিউটি সহ মহিলাকে বিয়ে করে বসি? মামা এসেই ওযু করে জোহরের নামায আদায় করলেন। লাঞ্চ করলেন একটু। বক বক করলেন অনেক। বললেন, “চাকরি হয়েছে ভাল। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন। সেলারি, ফ্যাসিলিটিজ, প্রসপেক্ট সবই ভাল। প্লেস অফ পোস্টিং ইজ ফার এওয়ে ফ্রম ঢাকা বাট নট দেট মাচ ব্যাড”। এই পর্যন্ত ভালই লাগছিলো। এরপর শুরু হলো, “ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন নাইনটি ওয়ান, হোয়েন আই ওয়াজ পোস্টেড ইন পানছড়ি –” । কান দিয়ে শুনছি আর বের করে দিচ্ছি। হঠাৎই এলো বিয়ে প্রসঙ্গ। পাত্রী ঠিক করা আছে। আগামী শীতে ডেট ফিক্স করে অনুষ্ঠান করা যাবে। এর আগে অন্য কোন চিন্তা মাথায় আনা যাবেনা। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। রক্ত বিদ্রোহ করতে চাচ্ছে। বুকের গভীরে হঠাৎ মোচড় মেরে উঠলো। মুহুর্তেই জেমির মুখটা ভেসে উঠলো । আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে রুমে গিয়ে লক করে দিলাম। বুকের ঠিক মাঝখানে বিষ বাষ্প জমাট বেধে আছে। নিঃশ্বাস ঠিক মত নিতেও পারছিনা। প্রশ্বাসেও স্বস্তি পাচ্ছিনা। ঘরে মন বসছেনা। মুহুর্তেই চেনা পৃথিবীটাকে খুব অচেনা আর খুব রুক্ষ বলে মনে হলো।
    আমার ‘অস্বস্তি’ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অবশেষে জেমির সাথে কথা হয় ফোনে। বললো, কি যেন জরুরি কথা আছে। দেখা করে বলবে। স্থির হলো, কিউটিকে যেদিন ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে সে দিন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। তার মা সাথে যাবে তাই। ইলমা’র কথা জেমিকে জানালাম। সে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “ লিভ ইট। এই নিয়ে বাসায় অনেক অশান্তি চলছে। আমি আর নিতে পারছিনা”।

    ইতোমধ্যে দু’টো টিউশনই আমি ছেড়ে দিয়েছি। আরো স্পষ্ট করে বললে ছাড়তে হয়েছে। কারণ দ্বিবিধ। এক, জেমিকে নিয়ে যে প্রায়ই রিক্সায় ঘোরাঘুরি করি ইলমা তা দেখেছে ও তার মা-কে জানিয়েও দিয়েছে । একদিন পড়া শেষে আচমকা বলেই ফেললো, “আপুকে নিয়ে তো ঠিকই রিক্সায় ঘুরেন। আপু কিন্তু ম্যারিড”। আমি হতবাক। জেমিও সেদিন আর দেখা দেয়নি। বাসায় না বাইরে বুঝতে পারিনি। আর দ্বিতীয় কারন হলো, বুয়েটের ব্যাকগ্রাউন্ড আর রেজাল্ট ভাল থাকায় এক বন্ধুর কল্যাণে ইউ এন ডি পি’র এক প্রজেক্টে ভাল একটা চাকরি পেয়ে গেছি। কর্মস্থল খাগড়াছড়ি।

    প্রিয় রাজধানী ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে থাকতে হবে। যদিও পাহাড় আমার খুব প্রিয়। তবু মন সায় দিচ্ছেনা। কেন? প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে যেতে হবে, তাই? মুহুর্তেই জেমি’র মুখটা ভেসে উঠলো। মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। অনুকূল পরিবেশে পেখম মেলে। আর প্রতিকূল পরিবেশে শামুকের মত গুটিয়ে থাকে। সব কিছু ঠিক ঠাক। আগামী পরশু লাগেজ সমেত খাগড়াছড়ি যাবো। মনে হচ্ছে কারা যেন জোর করে আমাকে বোচকাসহ আর্মি লরীতে উঠিয়ে দিচ্ছে অজানা পথে। জেমির সাথে দেখা করতে মন চাইছে। কিন্তু এটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পরে যাবে কিনা ভাবছি। ছাত্রীর কুশলাদি জানার ছুতোয় যাওয়া যায়। তাতে রথ দেখা আর কলা বেচা দু’টোই হবে। পরক্ষণেই মুখোমুখি ধরা পড়ার লজ্জায় পেয়ে বসলো। লক্ষ্য করেছি আজ বেশ ক’দিন যাবত জেমির ফোন বন্ধ। ফেবু আইডি ডিএক্টিভ। ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রামে তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। কোন বিপদ হয়নি তো?

    মানুষের মন বড় বেশি সেনসিটিভ। অযত্নে কুঁকড়ে যায়। অবহেলায় অভিমানী হয়। প্রত্যাখানে হয় বিধ্বংসী । আর আলাপনে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তা কেউ টেরই পায়না। এই দহন জ্বালা ক্রমান্বয়ে যেন বাড়ছেই। স্মৃতিরা বড় বেশি ক্ষুরধার। ঘাপটি মেরে থাকা সুখময় স্মৃতিরা অসময়ে পেখম মেলে ধরে। জেমিকে নিয়ে অমল ধবল সেই সব স্মৃতিকে চেপে রাখা যায়না।

    এত কিছুর মাঝে একটা ভাল খবরও আছে। বড় মামার সিলেক্ট করা পাত্রী ভেটো দিয়ে বসেছে। তাঁর ও আম্মার সন্দেহ এটা আমার চাল । তাদের মুখ কালো। চোখে গভীর সন্দেহ। মাথায় যে গভীর শংকা সে আমি বুঝতে পারি। ক’দিন যাবত বাসার পরিবেশ বেশ শান্ত। কোথাও কোন চিল্লাচিল্লি নেই। বেলা বারোটা বাজলেও ঘুমের ব্যাঘাত আর ঘটেনা। সেই বকাবাদ্যও নেই। আম্মার জন্য মনটা সিক্ত হয়ে উঠলো। জানি জেমি প্রসঙ্গ মাথা থেকে নামিয়ে ফেললেই আবার সব কিছু আগের মত হৈ চৈ মুখর হয়ে উঠবে। নাস্তার টেবিলে আম্মা এসে বসলো। খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি কিছু বলতে চাচ্ছে। বললাম, “ কিছু বলবা”? দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, “বাবা, তোর বাবা নেই আজ কত বছর হলো। কোনদিন কোন কিছু নিয়ে এত টেনশন হয়নি। আজকাল হচ্ছে” ।
    — হঠাৎ আজকাল আবার কি হলো? আমার প্রশ্ন।
    — কি জানি বাবা? আজকাল সবসময় মনে কু ডাক শুনি। আর দুঃস্বপ্ন দেখি
    — ওগুলো তোমার নিছক দুঃশ্চিন্তা। মাথায় নিও না। শুধু শুধু প্রেসার বাড়বে।
    আম্মা কি যেন বুঝলো। হয়ত ভেবে নিয়েছে আমি ট্র্যাকে এসে গেছি। ঘন করে দুধ চা এনে দিলো। আমার খুব মায়া হলো।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা –  ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৩)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৩)
    অনেক ঘোরাঘুরির পর জেমিদের কাজটা অবশেষে হয়ে গেছে। এই অছিলায় জেমির সাথে ঘোরাঘুরিও হয়েছে বেশ। সিটি কর্পোরেশনের পেপারস গুলো প্রকিওর করে জেমির হাতে দিতেই উষ্ণ অভিবাদন পেলাম,“ থ্যাংকস। এই তো দায়িত্ববান হতে শিখছো”। এর দ্বারা জেমি কি বুঝাতে চাইলো বুজে উঠতে পারলাম না। বললাম, “ কেন?”
    — বাহ। যেচে দায়িত্ব নিলে। মানে দায়িত্ব নেওয়ার ছুতো করে মোবাইল নম্বর নিলে।
    — হুম্ম
    — হুম্ম কি?
    — কিচ্ছু না
    — আজকাল দেখা না করেই ছাত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছো যে
    — ভাবছি কাল থেকে আর সেটাও করবো না
    — মানে কি?
    — টিউশনি ফিউশনি ভাল লাগছেনা
    — কি ভাল লাগে?
    — কিচ্ছু না
    — মেয়েদের মোবাইল নম্বর নিতে ভাল লাগে?
    — সেটা ছিল মারাত্মক ভুল
    — ভুল কেন? কাজের জন্যই তো নিয়েছিলে। অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল নাকি?
    — বললাম তো ভুল হয়ে গেছে
    — মোটেই না
    — কেন?
    — একদিন না একদিন আমিও তোমার নম্বরটা নিতাম
    — কেন?
    — তোমার মত ভুল করে। কাজের বাহানায়
    — লাভ কি?
    — ক্ষতিই বা কি?
    এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। সব প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়াও যায়না। লাভ ক্ষতির হিসেব চুলোয় যাক। এর পর থেকে জেমির সাথে ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছে। সিটি কর্পোরেশনের কাজের উসিলায় ছুতোনাতা করে বাসা থেকে বেরিয়ে পরাই এখন জেমির রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাহন হিসেবে রিক্সাতেই আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে ফিক্স হতে প্রথমে জড়তা থাকলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দিনে দিনে জেমি আরো জেম হয়ে উঠছে। চেহারায় রোশনাই বেড়েছে। এমনিতেই সে বেশ সুন্দর। প্রেমেতে জড়ালে মেয়েরা নাকি উর্বশী, অপ্সরা, মেনকা হয়ে উঠে। তার সান্নিধ্য এক সময় অধরা মনে হলেও এখন তা অতি বাস্তব। আমাদের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকলেও অজানা কোথায় যে ভেসে যাচ্ছি এক সাথে সেটা বুঝতে পারছি ঠিকই। সম্পর্ক গাঢ় হলে কোত্থেকে যেন ‘কুচ পরোয়া নেহি’ জাতীয় সাহসও ভর করে।
    একদিন দুপুরে ফোন এলো। জেমির। পাঁচটায় আলিয়ঁস ফ্রসেজ এর সামনে থাকতে হবে। ফ্রেঞ্চ ফেস্টিভেল চলছে সেখানে। আজ দু’টো ফ্রেঞ্চ শর্ট ফিল্ম দেখাবে। জেমি সেখানকার মেম্বার। বেশ খানিকটা আগেই সেখানে গিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। চারিদিক আলোকিত করে, বাতাসে সুগন্ধি ছড়িয়ে দীপিকা পাডুকোন এসে হাজির হলেন। আজ তার পড়নে নীল সাদা কম্বিনেশন কামিজ। একই রংয়ের মাস্ক। সাথে ম্যাচিং ওড়না। গলায় পেচানো। মেয়েদের এই বিষয়টা দেখার মত। কি বিবাহিত, কি অবিবাহিত সবারই এক স্টাইল। ম্যাচিং। বেছে বেছে ঠিকই যোগাড় করে নেয় সব। নীচ তলার ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। কফির অর্ডার হলো। সাথে স্যান্ডউইচ। বুঝলাম জেমি সেখানে পরিচিত। খানিকক্ষণ হাই হ্যালো করলো অনেকের সাথে। আমি এর আগে এখানে আসিনি। তাই জড়তা বোধ হচ্ছে। “আন ইজি লাগছে”? জেমির কথায় সোজা হয়ে বসলাম। “ভীতুর ডিম” বলে স্যান্ডউইচের দিকে ইশারা করে বললো, “এই সাহস নিয়ে প্রেম করবা কেমনে”? জেমি চোখ টিপে হাসলো। হয়ত মজাই পেল। আমি আরো কূঁকড়ে গেলাম। ছ’টায় শুরু হলো সেই কাংখিত শর্ট ফিল্ম। একেকটি চল্লিশ মিনিট করে। মাঝে দশ মিনিটের শর্ট ব্রেক। দু’টো ফিল্মই লাভ স্টোরি বেইজড। সাব টাইটেল ইংরেজীতে। আমি আবার সাব টাইটেল ফলো করতে পারিনা। ফলো করতে গেলে অনেক সীন মিস হয়ে যায়। বেশ কিছু একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত আছে তাতে। হল রুম অন্ধকার। অন্য যুগলরা কি করছে জানিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শো শেষে জেমির দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। বের হয়ে ধানমন্ডি লেকের দিকে যাচ্ছি। জেমিই নিরবতা ভাঙ্গলো, “ভালো লাগেনি”?
    — হুম্ম। মাথা নাড়লাম।
    — তাতো বুঝতেই পারছি। গুডি বয় ।
    এর দ্বারা সে কি মিন করলো বুঝতে পারিনি। হঠাৎই ডান হাতটা চেপে ধরে বললো, “দেখি পালস কত”? আমি বাধা দিলেও কাজ হয়নি। বললো, “সেকি! হার্ট এটাক হবে তো মনে হচ্ছে”। পরক্ষণেই বললো,”নো প্রবলেম। এভরি থিং উইল বি ওকে ইন ডিউ কোর্স অফ টাইম”। আমি নির্বাক।
    আরেকদিনের কথা মনে পড়ছে। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে গেলাম দু’জনে। লোক শিল্পের মেলা হচ্ছে। সেটা একটা উছিলা মাত্র। ঘুরে ঘুরে দেখছি আর কথা বলছি। এমন সময় হঠাৎই তৌহিদের আবির্ভাব। আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও এতটাই সামনাসামনি যে পার পাওয়া গেল না। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, “আমার ফ্রেন্ড। প্রাইভেট ফার্মে আছে”। এরপরেই আটকে গেলাম। হুট করেই জেমি বলে বসলো, “আর আমার পরিচয় ”? বিব্রত করার জন্য এই এক মিশাইলই যথেষ্ট। বললাম, “ ও হ্যা, তাইতো। ইনি আমার ছাত্রীর বড় বোন। আমাদের নেইবার”। কথাগুলো বলে নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। সব জায়গায় সব সময় সত্য কথন ঠিক না। তা অজস্র সম্পূরক প্রশ্নের জন্ম দেয়। মনে মনে উপলব্ধি করলাম আজ কপালে খারাপী আছে। তৌহিদ ছেড়ে দেবেনা। একান্তে দেখা হলে এর নাড়ি নক্ষত্র বের করে ছাড়বে। আর জেমির ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র তো তাক করা আছেই। যাহোক, জাদুঘর প্রাঙ্গণে গরম গরম ভাপা পিঠা তৈরি হচ্ছে। সবাই খাচ্ছে। আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম। তৌহিদ সমাদারে ওস্তাদ। জেমির সাথে খুব সহজেই ভাব জমিয়ে নিলো। সেখানেই দেখা হলো আরেক বন্ধু লালনের সাথে। সেও এসেছে তার জিএফ কে নিয়ে। তাদের সম্পর্ক বহুদিনের। বন্ধু মহলে এই নিয়ে অনেক কথা আছে। পরিবেশ জমজমাট আর আনন্দঘন হলেও আমি প্রমাদ গুনছি আবোল তাবোল অনেক কিছু কল্পনা করে। এক সময় বিদায়ের পালা এলো। আমি তৌহিদের সাথে থেকে যাবো। জেমিকে বলতেই চোখে চোখে এমন ভাবে তাকালো যে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু শুনলাম, “ভিতুর ডিম। লজ্জা লাগছে? ভয় পাচ্ছো”? যাহোক, তৌহিদ বিদায় নিয়ে চলে গেল। লালন তার জি এফ কে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি জেমিকে অনুসরণ করতে থাকলাম। সেদিনের পর থেকে দু’দিন জেমি কোন যোগাযোগ করেনি। ফোন করেও পাওয়া যায় নি। একদিন আচম্বিত ফোন করলো। বললাম, “ফোন ধরো না কেন? কোন প্রবলেম”?
    — প্রবলেমই তো
    — কি রকম?
    — ভেবে দেখলাম, যে ছেলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় তার সাথে এই ‘সম্পর্কে’র নাম কি?
    — মানে?
    — মানে মানে করবা না। আমি কি বলতে চেয়েছি তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো
    — উহু। তুমি বলো।
    — আচ্ছা রাখছি। লেবেন চুস খাও গিয়ে।
    আমার হাসি পেলো। বুঝলাম। জেমি তার সম্পর্কের একটা আইডেনটিটি চাচ্ছে। হাওয়া যখন অনুকূলে বয় তখন সারাকাল বসন্তকাল বলে মনে হয়। আমারও হয়েছে তাই। কাউকে কি সিম্পটন ধরে ধরে বোঝাতে হবে এখন বসন্তকাল চলছে?

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (২)
    ব্যাংক পর্ব শেষ করে সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে যখন পৌছলাম তখন লাঞ্চ পিরিয়ড চলছে। অফিসের লাঞ্চ পিরিয়ড কখন শুরু হয় আর কতক্ষণ পর্যন্ত চলে তার টাইম টেবিল কাগজে আছে, প্র্যাক্টিসে নেই। যার কাছে কাজ তিনি চেয়ারে নেই। হঠাৎই চোখে পড়লো দূরে চেয়ারে বসে আছে ইলমার বড় বোন জেমি। পরনে হলুদ প্রিন্টেড কামিজ। ম্যাচ করা মাস্ক। সাথে সাদা ওড়না গলায় পেচানো। চুল হাল্কা সোনালী কালার করা। কানে দুল, সরু লতার মত । হাসি বিনিময় করে বললাম, “কতক্ষণ ধরে এখানে”?
    — প্রায় ঘন্টাখানেক।
    — কেন?
    — নতুন ফ্ল্যাটের হোল্ডিং খুলবো।
    — কি বলছে এখানকার লোকজন?
    — যিনি করবেন তিনি নেই। কোথায় যেন গেছেন। এই এসে পড়বে বলছে সবাই। কিন্তু আসছেন না।
    — এই হচ্ছে আমাদের অফিস কালচার।
    — কি রকম?
    — এই যে নামায আর লাঞ্চের নাম করে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত কাউকেই পাওয়া যায়না।
    জেমি প্রসঙ্গ পাল্টালো, “ছাত্রীর পড়াশোনা কেমন চলছে”?
    — সে তো আপনিই ভাল বলতে পারবেন।
    — ইলমা তো তোমার গুণে মুগ্ধ
    — আর আপনি? কথাচ্ছলে মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। জেমি চোখটা ঈষৎ বড় করে কেমন করে যেন তাকালো। কি যেন ভাবলো। তার পর বললো, “তোমার কি মনে হয়”?
    — জানিনা। স্যরি, বেয়ারা প্রশ্ন হয়ে গেল। রিয়েলি স্যরি।
    এমন সময় অফিসের রেভেনিউ সেকশনের সেই ভদ্রলোক এলেন। এসেই চরম বিরক্ত। কোথাও কেউ কোন কাজ করেনা। কাউকে ডেস্কে পাওয়া যায়না ইত্যাদি খিস্তি আওড়াতে থাকলেন। আমি থ মেরে শুনছিলাম তার কথা আর ভাবছিলাম সেই প্রবচনের কথা, একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে? যাহোক, আমার কাজটা হলো। কিন্তু জেমির কাজ হলো না। কিছু পেপার শর্ট আছে। সেগুলো নিয়ে পরে আসতে হবে। জেমির মুখ কালো। আমার আলো। ভদ্রলোক নামাযের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। বসে থাকা বৃথা। বললাম, “এখন কি করবেন”?
    — বুঝতে পারছিনা
    — দু’টো কাগজ লাগবে। তারপর অন্য কথা।
    — সে তো শুনলামই। ঝামেলাই দেখছি।
    — কেন? ঝামেলা কেন?
    — এই যে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে
    — কাউকে দিয়ে করিয়ে নেবেন
    — সেরকম কেউ তো নেই এগুলো করার মত
    — আমি করে দিতে পারি
    — তুমি মিছেমিছি করতে যাবে কেন
    — মিছেমিছি করবো বলিনি তো
    — তো
    — কন্ডিশন আছে। আমি বললাম।
    — আমারো একটা কন্ডিশন আছে। জেমির পাল্টা উত্তর।
    — কি?
    — এখন থেকে তুমি করে বলবে। জেমি দুষ্টু হাসিতে, চোখের ফাঁসিতে আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “সে পরে দেখা যাবে”।
    আমার অন্তরাত্মা ধক করে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রিয়দর্শিনী, প্রিয়ংবদা জেমি আমার উপর দশ মনি বস্তা চাপিয়ে দিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগলো। আমি তার পিছু পিছু। নীচে তার গাড়ী প্রস্তুত। গাড়ীতে চেপে ইশারায় উঠতে বললো। ইতস্তত করতে দেখে বললো, “ভয় পাচ্ছো? বাসায় নামিয়ে দেবো তো”। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেপে বসলাম। ড্রাইভারকে কি যেন বললো বুঝতে পারলাম না। গাড়ী এসে থামলো ধানমন্ডির ‘পাইন উড’ রেস্তোরাঁয়। জেমির সাথে আজকের এই কাকতালীয় সাক্ষাৎ ও তার পরবর্তী অগ্রগতি অবিশ্বাস্যকর। খাবার খেতে খেতে বললো, “ভয় পাচ্ছো? কেউ দেখে ফেললে জাত যাবে”?
    — কই নাতো।
    — সে তো ভালই বুঝতে পারছি
    — ইটস ওকে
    — মোটেই ওকে না। ছাত্রীর সামনে তো টাইগার ভাব দেখাও
    — আপনি তো ছাত্রী না
    — আবার আপনি?
    — আন ইজি লাগছে
    — লাগুক। যতক্ষণ আমার সাথে আছো ততক্ষণ ভেবে নাও রিমান্ডে আছো
    — রিমান্ডে কাউকে খেতে দেয়? জানতাম না
    — বাহ। এই তো কনফিডেন্স লেভেল হাই হচ্ছে। বাকীটাও হয়ে যাবে
    — কি হবে?
    খাবার চলে এসেছে। কেতাদুরস্ত হয়ে কোন বিবাহিতা মহিলার সাথে একান্তে কোনদিন খাইনি। তাই গলা দিয়ে নামছে না।
    বাসায় এসে দেখি বড় মামা হাজির। রিটায়ার্ড জেনারেল। রাশভারি। গোঁফধারী। সম্পর্কে মামা হলেও সম্পর্ক জাহাঁবাজ বসের মত। পারতপক্ষে আমি তাঁর মুখোমুখি হইনা। আম্মার মুখ কালো। বড় মামা গম্ভীর। কাগজগুলো আম্মাকে বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে যেতেই বড় মামার সাউন্ড সিস্টেম সশব্দে গর্জে উঠলো, “দাঁড়াও”। মিলিটারি কায়দায় কুইক মার্চের পর হল্টের মত শোনালো। আমি দাঁড়ালাম। বললেন, “বসো”। আমি চেয়ার টেনে বসলাম। তাতে মেঝেতে শব্দ হলো। তিনি বিরক্ত হলেন। এটিকেট আর ম্যানার সম্মন্ধে কিছু ছবক দিলেন। কর্কশ ঠেকলেও এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম। তবে তাঁর শেষ কথাটা কানে গিয়ে ঢুকলো কিন্তু বেরোলো না। অনবরত ইকো হতে থাকলো, “তুমি নাকি এ বাড়ী বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিজনেস করবে”? চুপ করে রইলাম। লোন নেওয়ার কোন পরিকল্পনাই আমার ছিলনা কোন দিন। আম্মাকে জব্দ করার জন্য ফান করে বলেছিলাম মাত্র। চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হলো। বড় মামা অবশ্য শোনার লোক না। কমান্ড করাই তাঁর কাজ। তাঁর কথাই যেন শেষ কথা। আর এজন্যই আমি তাঁকে এড়িয়ে চলি। কপালের ফেরে আজ সেই টাইগারের মুখোমুখি হয়েছি। নিরবতা ভেঙ্গে মেঘ ডমরু নাদে বললেন, “ওসব কল্পনা টল্পনা ছাড়ো। নো বন্ধক, নো লোন, নো বিজনেস। ওকে? ট্রাই টু গেট আ জব ইমিডিয়েটলি”। এই বলে বড় মামা বিদায় নিলেন। আমি আম্মার দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে বললাম, “মামারে ভাড়া কইরা আনছো? আমি চাকরি করুম না। বিজনেসই করুম”। আম্মাও কম না। জেনারেলের বোন। তাই গলা চড়িয়ে বললেন, “টাকা পাবি কই”?
    — লোন নিমু
    — কে দেবে তোকে লোন “?
    আমি মওকা পেয়ে গেলাম। বললাম, “ যারে বিয়া করুম সেই দেবে”?
    — সে কে?
    — এক বাচ্চার মা।
    এই কথা বলা শেষ। আম্মার বড় মামাকে মোবাইল করাও শুরু। দু’জনের কি আলাপ হলো জানিনা। বাসার আবহাওয়া সেই থেকে থমথমে। বিকেলে শৈলীকে পড়াতে যাওয়ার কথা। মেজাজ চড়ে আছে। তাই, কমফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। গোল্লায় যাক সব।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা –  ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।


    শ্রোতব্যঃ
    (গল্প লেখার ঝক্কি অনেক। তাও আবার উত্তম পুরুষে লেখায়। এর বাইরে প্রায়শই যে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় তাহলো, গল্পের আকার আর ফিনিশিং নিয়ে। গল্পের আকার একটু বড় হলে বেশির ভাগ তরুণ পাঠকই অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠে আকার কমাতে। আবার একদল আছে যারা ছোট লেখা পড়ে বলে বসে, এরপর? অন্যদিকে অনেকেই, বিশেষত মেয়েরা গল্পের হ্যাপী এন্ডিং পছন্দ করে। অন্যরা চান ঘটমান বাস্তবতার মত ‘পাইয়াও হারাইবার বেদনা’। মূলত ট্র্যাজিক এন্ডিংই কমবেশি সবার হৃদয় স্পর্শ করে যায়। এই দুই টানাপোড়েনে কলম ধরতে বড় সংশয় জাগে।
    এই গল্পটি তাই উভয় প্রকার পাঠকের চাহিদাকে সম্মান দিয়ে লেখা। গল্পটি বড়। তবে পর্ব করে একূল- ওকূল দু’কূল রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। আবার গল্পের এন্ডিং নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত আছি। তাই একটা ‘সমাপ্তি পর্ব’ ঠিক করে রেখেছি সত্য। তবে পর্ব চলাকালীন পাঠকদের মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা দেখে ভিন্ন চিন্তাও করা যেতে পারে। আপাতত কৈফিয়ত আকারে এটুকুই থাক)।


    (১)
    বাসার আবহাওয়া খুব গরম। অনেক দিন হলো আম্মা বেজায় রেগে আছেন। প্রায়ই বাসায় এরকম গরম গনগনে মৌসুমি আবহাওয়া বিরাজ করে। এবার প্রলম্বিত। আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার একমাত্র কারণ আমি। আম্মার ইচ্ছে আমি বিসিএস দেই। আমার সাফ উত্তর ‘না’। আমি চাই ব্যবসা করতে। আম্মার এক কথা ‘কভি নেহি’। সকাল থেকেই শুরু হয় আম্মার চিল্লাচিল্লি, “মরার আমার হয়েছে জ্বালা। দামড়া পোলা দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। কাম নাই, কাজ নাই। ধান্ধাও নাই, চিন্তাও নাই”। আমার ঘুমে ব্যাঘাত হয়। বালিশ কান চাপা দিয়েও ঘুম জমাতে পারিনা। থেকে থেকে আম্মার চোখা চোখা কথা কানে আসে। আর মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়। বারোটার দিকে সকালের নাস্তা করতে গেলেই দিনের প্রথম বোমা ফাটা শুরু হয়। সঙ্গত কারণেই লাঞ্চের সময় হয় বিকেলে। সেটা অবশ্য বাইরেই সেরে নেই। আর বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই রাত এগারো-বারো। খেতে খেতে রাত একটা। তখন শুরু হয় আম্মার বোমা ফাটানোর ক্লোজিং সেশন।


    টিউশনি করি দু’টা। একটা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রীকে। ম্যাথ আর কেমিস্ট্রি। এইট স্ট্যান্ডার্ডের। নাম ইলমা। আরেকজন পাবলিক স্কুলের ছাত্রী। আগামী বছর ইন্টার দেবে। নাম শৈলী। টিউশনি করে যা পাই তা হাত খরচ হিসেবে যথেষ্ট। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের পক্ষে যৎসামান্য। আমার আবার স্টুডেন্ট ভাগ্য ভাল। এমনিতেই ওরা মেধাবী, তার উপর ফিনানশিয়াল কন্ডিশন সেইরকম সাউন্ড। তবে দু’টোতেই দু’ধরণের অস্বস্তি রয়েছে। ইলমা খুব কিউট, স্মার্ট ও স্টুডিয়াস। কিন্তু তার বড় বোনের দীপিকা পাডুকোন লুক মাথা আউলা ঝাউলা করে দেয়। তার নাম জেমি। প্রায়ই টিউশনি শেষে তার সাথে শর্ট সেশন হয়। সে অনেক কথা। টক ঝাল মিষ্টির। টিউশনির প্রথম দিনেই তার ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হলাম। আর দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলাম। এটা কি চাকরির ইন্টারভিউ নাকি পাত্রের বায়োডাটা ভ্যালিডেশন? ইন্টারভিউয়ের মাঝেই এক কিউটি এসে ঝামেলা শুরু করে দিল। জেমি কিছুটা লজ্জায় কিছুটা রেগে তাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আমি ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই পিচ্চি তোমার কে হয়”? “আমার নিস, বোনের মেয়ে” ইলমার উত্তর। আমার আউলা মাথায় যেন কারেন্টের শক খেলাম। যাহোক, সেই জেমির কাহিনী সিনেমার কাহিনীর মত। অল্প বয়সে এফেয়ার করে বিয়ে করেছে যাকে সে জনকের চিহ্ন রেখে দেশান্তরি হয়ে গেছে সেই কবে। প্রথমে মালয়েশিয়া, তারপর কম্বোডিয়া। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। জেমিকে আমার খুব পছন্দ। পছন্দ করার মতই। চেহারায়, স্মার্টনেসে, কথাবার্তায়, চোখের নড়াচড়ায়, হাসিতে, রাগে, অনুরাগে, অভিমান-অপমানে সবকিছুতেই অপূর্বা। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলাম এভাবে। আর যায় কোথায়? সেই থেকে জেমি অনন্যা হয়ে দেখা দেয়। কোন দিন দেখা না হলে দিনটাই মাটি বলে মনে হয়। জেমিও ছাত্রীর গার্ডিয়ান হিসেবে আরো সক্রিয় হয়।
    আমার অন্য ছাত্রী শৈলী। সে ভাবে সপ্তমী। কিন্তু তার মা রাগে অগ্নি। সারাক্ষণ পায়চারি করেন। আর ছুতানাতা করে দেখে যান আমাদের বিদ্যা শিক্ষার শব্দমাত্রা কাংখিত মাত্রার চেয়ে নিম্নগামী কিনা। আলাপের ফ্লাইট বই, খাতার বাইরে চোখে চোখে পরিভ্রমণরত কিনা? অসহ্য ঠেকে। তবে যে কোন মেয়ের মা’র এই উদ্বেগ থাকাটা অতি স্বাভাবিক, তাও উপলব্ধি করি। আবার মজাও পাই এই ভেবে যে, তাঁকে নিত্যদিন ঘন্টাখানেকের জন্য হলেও প্যারা দিতে পারছি। শৈলী ছাত্রী হিসেবে ভাল। রেজাল্টও। তবে খুব চঞ্চল আর দুষ্টু টাইপের। বয়সটাই তো এরকম। মাঝে মধ্যে আমার সাথে সিলেবাস বহির্ভুত ফ্ল্যাগ মিটিং করতে চায়। আমি সাবধানী। কায়দা করে ফোকাস ফিরিয়ে আনি পড়ালেখায়।


    প্রতিদিনের মত আজো আম্মার চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুখের উপর তিন খন্ড কাগজ আর টাকা ছুঁড়ে মেরে বললো, “আজ লাস্ট ডেট। বিল গুলো দিয়ে আসবি”। চেয়ে দেখি গ্যাস আর কারেন্টের বিল। সাথে সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের তাগিদ পত্র। এই ধরণের কাজ আমার একেবারেই নাপছন্দ। ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পিপীলিকার মত হাটি হাটি পা পা করে বিল দেওয়ার মত প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি আমাদের দেশেই বোধহয় পপুলার। অন লাইনে দিতে চাইলেও আম্মার চিল্লাচিল্লিতে চুপ হয়ে যাই।


    আম্মা গরম গরম পরোটা এনে দিচ্ছে। ডিম মামলেট আর গরুর ভুনা আমার খুব পছন্দের। খেতে খেতে রাগাবার জন্য বললাম, “ব্যাংকের সাথে কথা পাক্কা হয়ে গেছে। দশ লাখ লোন নেবো”।
    আম্মা চক্ষুচড়ক গাছ করে বললো, “তোকে কোন ব্যাংক লোন দেবে”?
    — দেবে, দেবে। বাড়ী বন্ধক রাখবো
    — বাড়ী কি তোর নামে?
    — তোমার নামে। তাতে কি? তোমার নামেই নেবো
    — এতই সোজা?
    — বিজনেস করবো। দশ লাখ হলেই চলবে। ভাবছি ব্যবসা স্টার্ট করেই বিয়ে করে ফেলবো
    — তোকে মেয়ে দেবে কে?
    — মেয়ে তো স্ট্যান্ডবাই।
    — তাই নাকি? তা কি করে সেই মেয়ে?
    — কিছু না। একটা ছোট্ট কিউটি আছে তার।
    — কি? এই বলে আম্মা চুলো নিভিয়ে বেডরুমের দরোজা লক করে দিলো। আজ আর চা মিলবেনা বুঝলাম।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তর –  আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো (সূচনা পর্ব)

    আজিমপুর টু উত্তর – আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো (সূচনা পর্ব)

    • আজিমপুর টু উত্তরা।
    • আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো।
    • আনোয়ার হাকিম।


    মৌমিতার এক কথা। তার পক্ষে আমার সাথে আর এভাবে রিলেশন টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তার এ অনুযোগ নতুন কিছু না। এর আগেও বহুবার এরকম অভিযোগ এনে সে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কিছুদিন পর যেচে এসে কান ঝালাপালা করা শুরু করে দিয়েছে। তাই এবারের হুমকিকে বরাবরের মত আমলে নেইনি। ভেবেছিলাম কিছু দিন গেলেই পাখী ফিরে আসবে। কিন্তু এবারের বিরতি ঢের প্রলম্বিত হচ্ছে। ফোনে তাকে পাওয়া যাবেনা জানি। ম্যাসেঞ্জার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপেও পাওয়া যাচ্ছেনা। যাবে কি করে? আমি তো ব্লক লিস্টেড।
    অফিসের কাজে মন নেই। ক’দিন যাবত অফিসের পরিবেশও ভাল না। নতুন বস এসেছেন। এসেই আগেকার সব কিছু খারাপ, তাই পরিত্যাজ্য শ্লোগানে সবাই পেরেশানির মধ্যে আছি। আগের বস ব্যবহারে চামার প্রকৃতির হলেও কারো উপর কলম প্রয়োগ করেন নি। এই বস দেখতে আগের জনের চেয়ে পরিপাটি, পোষাকে-আশাকে ও কাজে-কর্মে। কিন্তু কথায় কথায় কলম ধরতেও ওস্তাদ। কয়েকটা চামচা জুটেছে তাঁর সাথে। পুরো অফিসটাকে সার্কাস্টিক করে তুলেছে। আমার সাথে বসের প্রথম সাক্ষাৎ মোটেই সুখকর ছিলনা। বসের সালাম মানে অবশ্যপালনীয় সাক্ষাত। টুক করে অস্ফুট স্বরে সালাম ঠুকতেই তাঁর কোপানলে পড়লাম, “সালাম দিলা না ঢুস মারলা?” আমি অপ্রস্তুত। ‘স্যরি’ বলে নিষ্পত্তি করতে গিয়ে পড়লাম আরো ভেজালে। ম্যানার আর এটিকেট সম্মন্ধে লম্বা লেকচার শুনলাম। বলাচলে ক্লাউন বনে গেলাম। চামচারা চারপাশ আলোকিত করে বসে আছে। তাদের মুখে আমার প্রতি পরিহাস আর বসের প্রতি কৃতজ্ঞতার বত্রিশ দন্তের এক্সিবিশন। মেজাজ তিরিক্ষি। কিন্তু করার কিছু নেই। চাকরি বলে কথা। করিডোরে আরো কয়েকজনের সাথে দেখা। তাদেরও মুখ কালো। তাদেরও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অফিসে এক ধরণের অস্বস্তি ও রাখঢাক ভাব। এমন সময় মৌমিতার ফোন, কই তুমি?
    — অফিসে
    — এখনই বের হও
    — কেন?
    — এত কৈফিয়ত দিতে পারবো না
    — নতুন বস। মার্শাল ল’ চলছে
    — সে তোমার বস। আমার না
    — তো
    — আমি ওসব বুঝিনা। বের হও আমি অপেক্ষা করছি।
    — এ মুহুর্তে অফিস লিভ করা যাবে না। তুমি আসো
    — আমি পারবো না। আসবে কিনা বলো
    — বললাম তো সম্ভব না
    — ঠিক আছে।
    কথা বলতে গিয়ে দেখি লাইন নেই।
    মৌমিতার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত আকস্মিক। সবেমাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছি। সরকারি চাকরি। বাবার পছন্দের। আমারও। চাকুরীজীবিদের জন্য বছর শেষে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন নেওয়ার নিয়ম। সবাই দুই প্রস্থ ফর্ম নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ছুটছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রতিবেদন সংগ্রহ করতে। সে এক এলাহী কান্ড। নির্ধারিত প্রফেসরের চেম্বারের সামনে লম্বা লাইন। একজন কর্মচারী সেগুলো জমা নিচ্ছে। আমি একজনের রেফারেন্সে গিয়ে পড়লাম বিপদে। কর্মচারীটা আমার দিকে কিভাবে যেন দৃকপাত করলো। আমি এর কারণ বুঝে উঠতে পারলাম না। দেখলাম ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে অনেকেই বিজয়ের হাসি হেসে চলে যাচ্ছে। বুঝলাম নগদানগদি কারবারের ক্যাটালিস্ট কাজ করছে। আমার এতে আপত্তি। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমার ডাক পড়লো। নির্ধারিত রুমে ঢুকেই পড়লাম জেরার মুখে। এক লেডি ডক্টর বসে আছেন। মুখ না তুলেই বললেন, “হাইট কত সেন্টি”? আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। বললাম, “ভুলে গেছি”। লেডি ডক্টর মুখ তুলে তাকালেন। বললেন,”কি বললেন”? বললাম, “ভুলে গেছি”। বিস্ফারিত চোখ মেলে শব্দ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বললেন, “মানে”? আমি স্থির হয়ে বললাম, “বমি আসছে। মাথা ঘোড়াচ্ছে”।
    — প্রেসার আছে? তার প্রশ্ন
    — জানিনা। মাপিনি কোন দিন
    — ডায়াবেটিস?
    — জানিনা
    — বড় ধরনের কোন অসুখ?
    — জানিনা।
    লেডি ডক্টর আশ্চর্যবোধক চিহ্ন চোখে-মুখে, কপালে ফুটিয়ে তুলে কলিং বেল চাপলেন। পিওন এলো। ফরমগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, “উনাকে নিয়ে গিয়ে এগুলো করিয়ে আনেন”। আমি অসহায়ের মত সেই পিওনকে অনুসরণ করলাম। রুম থেকে বেরোতে গিয়ে পিছু ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যাম, আমার কি সাংঘাতিক কিছু হয়েছে”? লেডি ডক্টর এবার হেসে উঠলেন। বললেন, “যান তো”। আমার মন কেন জানি নেচে উঠলো। যাকগে সেসব। হাইট, প্রেসার ইত্যাদি মেপে আবার ফিরে এলাম সেই ম্যাম এর রুমে। দেখলাম তিনি সিঙ্গারা খাচ্ছেন। সামনে ছোট্ট ফ্লাক্স। চায়ের। বললেন, “হয়েছে?” ফরমগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর ইনিশিয়াল দিয়ে পিওনের হাতে দিয়ে বললেন সাথে যান।
    ফর্ম হাতে অফিসে পৌছা মাত্রই ফোন। আন নোন নম্বর। ধরলাম। সেই লেডি ডক্টরের। ভুলো মনে তার টেবিলে আমার ফোল্ডার ফেলে এসেছি। ফোল্ডারেই আমার মোবাইল নম্বর ছিল। মন ইউরেকা উত্তেজনায় থেকে থেকে নেচে উঠছে। ভাবছিলাম এইসব অনেক কিছু। আবারো বসের সালাম।
    রাতে ব্যালকনিতে বসে নচিকেতার গান শুনছিলামঃ হাজারো কবিতা, বেকার সবই তা। তার কথা কেউ বলেনা। সে প্রথম প্রেম আমার, নীলাঞ্জনা। আমি নীলাঞ্জনাকে পেয়ে গেছি। সে উত্তেজনাতেই মন নেচে উঠছে, কি থেকে কি করি এই অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে। দ্বিধা চেপে রেখে ফোন দিলাম। রিং হলো। রিসিভ হলোনা। গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। সকালে নাস্তার টেবিলে মোবাইলে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখি ক্ষুদে বার্তাঃ এত রাত জেগে কি করেন? শরীর খারাপ হয়ে যাবে- মৌমিতা। খুশীতে লাফ দিতে মন চাইলো। আম্মা সামনে বসে থাকায় চেয়ারেই দৃঢ় হয়ে বসে থাকলাম। তবে ভেতরে তুমুল আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে। অফিসে গিয়ে রিং দিলাম। অনেক ক্ষণ পর রিসিভ হলো, “বলেন”।
    — অসুখ- বিসুখ রাত বিরেতেই হয়।
    — কি হয়েছে?
    — বুক চিন চিন করছে
    — কবে থেকে
    — এই তো কয়েক দিন থেকে
    — ডাক্তার দেখান
    — সেজন্যই তো ফোন দিয়েছিলাম। ধরেন নি। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল জাতীয় যদি হত
    — কথা তো ভালই জানেন দেখছি
    — এপয়েন্টমেন্ট কি হবে?
    — কিসের?
    — ডাক্তারের
    — যাকে দেখাবেন তার চেম্বারে যান। কন্টাক্ট করেন
    — আপনাকেই তো দেখাতে চাই
    — দেখাতে না দেখতে?
    — দু’টোই
    — দু’টোর কোনটাই হবে না।
    — কেন?
    — প্রথমত আমি হার্টের ডাক্তার না। আর দ্বিতীয়ত আমি চিড়িয়া না যে দ্রষ্টব্য হবো।
    এভাবেই মৌমিতা আমার নিত্যদিনের দ্রষ্টব্য হয়ে উঠে। আমাদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তবু জমে ভাল। আমি আবেগী। মৌমিতা সারাক্ষণ অপারেশনের সিজার হাতে ফোর ফোরটি ভোল্টের মত। আমার ভাল লাগে। সুন্দরীদের দেমাগ থাকে জানি। আর এই দেমাগই তাদের রাগের পাওয়ার হাউস। রাগলে মৌমিতার গাল দু’টো আরো রক্তাভ হয়। একটু ফোলা ফোলা ভাব থাকে। চোখে আলাদা তেজ প্রস্ফুটিত হয়। আমি আরো রাগাই। মৌমিতা ফিক করে হেসে উঠে , কখনো চুপ মেরে বসে থাকে।
    তার সাথে বিপত্তির শুরু আমার এক মহিলা কলিগকে নিয়ে। নাম শমরিতা। ঘটনার শুরু এক ট্যুরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। অফিসের কাজে তার সাথে যেতে হয়েছিল বান্দরবান। দু’দিনের জন্য। কথা প্রসঙ্গে আর ছবি শেয়ার করার আহাম্মকির কারণে বিষয়টি যে মৌমিতার কাছে সন্দেহের প্রশ্নবোধক ট্যাগ হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি। সেই থেকেই থেকে থেকে এই অন-অফ খেলা। চরম বিপত্তি বাধে বসুন্ধরা সিটিতে গিয়ে। শমরিতার কিছু কেনাকাটা আছে ওখানে। আমারও একটা মোবাইল সেট কেনা দরকার। অফিসের গাড়ীর সুবিধা পাওয়ায় দু’জন একসাথে গিয়েছি সেখানে। মোবাইল সেট কিনতে গিয়েই দেখা হয়ে গেল মৌমিতার সাথে। আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্বে কুশল বিনিময় হলেও বিষয়টা যে পরে কুরুক্ষেত্র বাধাবে তা আঁচ করতে পেরে ক্রমাগত ঢোক গিলতে থাকলাম। মৌমিতা তাড়া আছে বলে বলা চলে ইচ্ছে করেই চলে গেল দ্রুত। আমি কিছু বুঝতে না দিলেও আর সহজ করতে পারছিলাম না নিজেকে। মোবাইল সেট আর কেনা হয়নি সেদিন। এরপর যথারীতি মৌমিতার ফোন বন্ধ। খোলা থাকলেও রিং দিলে ধরেনা। একদিন পেয়ে গেলাম হঠাৎ। বললাম, ফোন ধরোনা কেন?
    — ধরতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা কি আছে?
    — এরকম বলছো কেন?
    — কি বলবে বলো, আমি ওয়ার্ডে রাউন্ডে যাবো
    — দেখা করতে চাই
    — কেন? কলিগ আছে না? তাকেই তো সারাক্ষণ দেখছো। তাকেই দেখে রেখো। রাখছি।
    জানি শমরিতা ফোবিয়ায় তাকে পেয়ে বসেছে। নারী যতই স্বাবলম্বী হোক, যতই আয় রোজগারি হোক যতই উদার আর উচ্চ শিক্ষিত হোক এই একটি জায়গায় তার সন্দেহ, ভয়, আর হিংসা তাকে সাধারণ নারী পর্যায়ে নামিয়ে আনে। কই, আমি তো শার্লক হোমস সেজে কখনো ভাবিনি তার পুরুষ কলিগদের সাথে তার কি সম্পর্ক? আদৌ কারো সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা? পাগলের মত তার চেম্বারে গিয়েছি। পাইনি। ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। প্রফেসর রাউন্ডে আছে তাই ঢুকিনি। মৌমিতা আর বের হয়নি। এভাবেই যোগাযোগহীন চলছে অনেক দিন। এরকম অবস্থায় মানুষের আচরণে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, যা সে নিজেও বুঝতে পারেনা। নিকটজনেরা পারে। আম্মার চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন। তাঁর নানারুপ তত্ত্বতালাশে আমি বেজায় বিরক্ত। এরমধ্যে শুরু হয়েছে পাত্রী দেখার তাগিদ। তাঁর জানাশোনা এক মেয়ে আছে। পাবলিক ভার্সিটির লেকচারার। দেখতে অপরুপা। একহারা গড়ন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। ঢাকায় বাড়ী, গাড়ী সবই আছে। এক বাপের একমাত্র সন্তান। বলা চলে রাজকন্যা। পাত্রী হিসেবে দশে দশ দেওয়া যায়। কিন্তু মৌমিতা আলাদা। তার রেটিং একান্তই মনের। মনের এই অবস্থায় শমরিতার টেক কেয়ার আরো বেড়ে গেছে। বাসা থেকে নানান খাবার নিয়ে আসে। দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত দেয়। এগারোটায় চা খেতে খেতে আলাপও হয়। শমরিতা কি তার পরিধি বাড়াচ্ছে? বুঝতে পারিনা। এমনিতে সে খুব সুন্দর, জড়তাহীন। উদার। এক ধরণের মেয়ে আছে যাদের দেখলেই দিনটা ভাল হয়ে যায়। একটু হাসলেই মনে হয় শীতের সূর্য একটু দিলখোলা হয়েছে। একদিন এমনই এক চা চক্রে অফিসে বসেই নানা আলাপ চলছিলো। হঠাৎই গম্ভীর হয়ে শমরিতা বলে, “একটা কথার ঠিক ঠাক উত্তর দিবে?”
    — বলো
    — তোমার কি কিছু হয়েছে?
    — না তো
    — সে তো বুঝতেই পারছি। আচ্ছা, বাই দা ওয়ে, সেদিনের সেই মহিলাটা কে ছিল?
    — লেডি ডক্টর
    — ব্যস, এটুকুই?
    — তো
    — তুমি কি কিছু আড়াল করছো?
    — না তো
    — উনি সেদিন ওভাবে হুট করে চলে গেলেন যে
    — আমি কি করে বলবো?
    — আর ইউ ইন আ রিলেশন উইথ হার
    — ডোন্ট নো।
    সেদিনের পর থেকে শমরিতা বেশ ফরমাল। হাই- হ্যালোতে আমাদের নিত্যদিন দেখা হয়, কথা হয়। রাখঢাক হয়। চোখাচোখি হয়। তার মুখের ভাষা বুঝি। শমরিতার কি তবে অন্য কোন চিন্তা ছিল? তার সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আর আগের মত নেই।
    এদিকে আম্মার চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে। তিনি প্রায় একরকম কথা দিয়েই ফেলেছেন সেই লেকচারার পাত্রীর বাবা-মা’কে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কোন ভাবেই মৌমিতাকে রীচ করতে পারছিনা। মেডিকেলে গিয়ে জানতে পারলাম, মৌমিতা এখন আর সেখানে পোস্টেড নেই। এম আর সিপি করতে ইংল্যান্ড চলে গেছে বেশ ক’দিন আগে। মাথাটা চক্কর মেরে উঠলো। এবার সত্যি সত্যিই বমি বমি লাগছে। মনে হয় সুগার লেভেল নেমে গেছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
    অফিস এখন আর কোনভাবেই আকর্ষণ করেনা আমাকে। শমরিতার মধ্যেও আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। পাত্রী পক্ষ দ্রুত এগোচ্ছে। আম্মা তার চেয়ে বেশি। আমি ততোধিক ব্যাক ফুটে।
    হঠাৎই হোয়াটসঅ্যাপে মৃদু গুঞ্জন তুলে মৌমিতার ক্ষুদে বার্তাঃ আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো।

    চলবে…