Author: Anwar Hakim

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৯)
    সাবরিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বলা চলে পালিয়ে এসে পড়লাম আরেক বিপদে। রাজউকের কাগজপত্র ফেলে এসেছি তার টেবিলে। আসার সময় উঠতে গিয়ে টেবিলের সাথে হোচট খাওয়াতেই এই বিভ্রাট হয়েছে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর মামা ফোন করে জানালেন। বললেন নিয়ে যেতে। আমি মরে গেলেও যাবো না। সাবরিনার কাছে আজ আচ্ছামত নাকাল হয়েছি। প্রেস্টিজ পাংচার যা হওয়ার হয়েছে। এবার গেলে টায়ার টিউবও যাবে। মামাকে বললাম অনেক দূর চলে এসেছি। প্রচন্ড জ্যাম। তার কাছেই যেন রেখে দেয়।

    এবার ঢাকায় এসে দারুণ অস্বস্তিতে কাটছে। বাসার পরিবেশ থমথমে। সবাই আমার সাথে ডিফেন্সিভ খেলছে। আগ বাড়িয়ে কেউ কিছু বলেনা। মনে হলো দুই শূন্য ভোটে আমার বিরুদ্ধে সাধারণ পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে। এখন স্বল্প পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। হয়ত নিকট ভবিষ্যতে আরো বড় আকারে নিষেধাজ্ঞা আসবে। আমার ভোটাধিকার নেই। সেলিম কৌশলগত কারণে ভোটদানে বিরত। তার সাথেই টুক টাক কথা হয়। তবে তারও গা ছাড়া গা ছাড়া ভাব দেখলাম। রাতে খাবার টেবিলে আম্মাকে পেলাম। কাছে গিয়ে বসলাম। আম্মা উঠে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, “টেবিলে সব দেওয়া আছে”। আমি পথ আগলে বললাম, “এরকম করছো কেন? কি হয়েছে খুলে বলো”। আম্মা চোখ বড় বড় করে তাকালো। বহুদিন এভাবে তাকায় নি। বুঝলাম তার মেজাজ সপ্তমে। বললাম, “তোমরা যা ভাবছো ব্যাপারটা আসলে ওরকম না”। “তাহলে কি রকম”? আম্মার পাল্টা প্রশ্ন। এ সময় সাঁড়াশি আক্রমণের অভিপ্রায়ে মলি রুম থেকে বের হয়ে এলো। সেও এই বিতর্কে যোগ দেবে আমি নিশ্চিত। বললাম, “কাল সকালে আলাপ করা যাবে”।

    মাথার অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ডাক্তার দেখাতে ভয় হয়। রাজ্যের আজেবাজে চিন্তা আসে। ব্রেণ টিউমার হয়নি তো? নিজেই শিউরে উঠলাম। এত অস্থিরতা নিয়ে পৃথিবীতে আর কেউ আছে কিনা জানিনা। হেসে খেলে জীবনটা তো ভালোই কাটছিলো। আম্মার ঘ্যানরঘ্যানরের কারণে বাধ্য হয়ে টিউশনি নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম টিউশনি করবো আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ট্রাই করবো। সেই টিউশনি করতে গিয়েই পড়েছি বিপদে। ইলমাকে পড়াতে গিয়ে জেমিতে আটকে গেছি। ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি কোন বিবাহিতার সাথে এভাবে জড়িয়ে যাবো। শৈলীকে পড়াতে গিয়ে কক্ষণো তার উড়ুউড়ু মনের সাথে তাল মিলাইনি। এখন তার সরব, নিরব নড়াচড়া দোলা দিয়ে যায়। মাল্টিন্যাশনালে চাকরির ইচ্ছে থাকলেও হুট করেই ইন্টারন্যাশনালে হয়ে গেলো। মাঝখান দিয়ে সেলিমের সাপলুডু খেলায় সবাই উপুর্যুপরি পেরেশান আর নাস্তানাবুদ হয়েছি। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারিও হয়েছে। অন্যদিকে সুখের খবরও হয়েছে। মলি এখন সন্তান সম্ভবা।

    জামান ভাই সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আর কোন কথা বলেন নি। মনে হয় তার চয়েস আছে বা অন্য কোন এক্সপেক্টেশন আছে। আমারও আর ঢাকায় বদলীর খবর হয়নি। জামান ভাই এখন বিদেশে। ইউ এন ডিপি ডেলিগেশনের সাথে। ছোট মামা প্রমোশন পেয়ে আগারগাঁও অফিসে বদলী হয়েছেন। সাবরিনার সাথে দেখা হওয়ার চ্যাপ্টার ক্লোজ। তবু মাঝে মাঝে তার উচ্ছ্বল স্মৃতিতে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। সবার চাপে আর নিজের শারিরীক অবস্থার কারণে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। হাজারো টেস্ট। এম আর আই পর্যন্ত করতে হয়েছে। একগাদা ওষুধ দিয়েছে। মুড়ির মত তা তিন বেলা ভাগ করে খাই। বেশির ভাগই যে নার্ভ রিলাক্সেসন সংক্রান্ত বুঝি। সারাক্ষণ তন্দ্রালু ভাব লেগেই আছে। প্রথমে মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছি। এক পর্যায়ে তিনি নিউরোকে রেফার করলেন। তার কথা বার্তা, হাব ভাব দেখে শুনে গা ছম্ ছম্ করে উঠে। যতটা না মুখে বলেন তার চেয়ে বেশি চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলেন। অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছি। বলা চলে নিতে বাধ্য হয়েছি। দিনে দিনে ওয়েট লস হচ্ছে। এম আর আই রিপোর্ট খারাপ না। তবে বাসার কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলেনা। মাঝে মধ্যে মুখ ঠেলে বমি আসে। মাথাটা সারাক্ষণ ঝিম্ ঝিম্ করতেই থাকে। কখনো কখনো চিন্ চিন্ করে। আর কানে অনবরত ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ লেগেই আছে।

    আম্মার চোখ ভেজা থাকে। ছোট মামার সাথে পরামর্শ করেন। বড় মামা এসে দেখে যান। আর বলেন, “সুস্থ হলে বিয়ে করিয়ে দাও। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। স্থিরতা দরকার”। মামাদের তত্ত্বাবধানে মাল্টিন্যাশনালে সেলিমের একটা চাকরি হয়েছে। যদিও চাকরিতে তার আপত্তি। কিন্তু পিতৃত্বের জোয়াল কাঁধে চাপায় রাজী হয়েছে। মলি খুব খুশি। সাত মাস চলছে। নবাগতের আগমনে আম্মার মুখ জুড়ে সুখের হাসি লেগে আছে। এখন মলির সেবাতেও তাকে সময় দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমাকে নিয়েও সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকতে হচ্ছে। ওষুধে বেশ কাজ হয়েছে। আগের চেয়ে অনেকটাই স্বস্তি বোধ করছি। মাথার ঝিম্, ঝিম্, চিন্ চিন্ ভাবটা অনেকটাই লাঘব হয়ে এসেছে। কিন্তু কানের ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকটা রয়েই গেছে। চাকরি বাঁচাতে খাগড়াছড়ি যেতে হচ্ছে। সব শুনে জামান ভাই হায়ার লেভেলে আলাপ করে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আমার একা একা খাগড়াছড়ি যেতে ভয় করছে। সাথে যাওয়ার কেউ নেই। সেলিম যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু মলির কথা ভেবে আমিই না করেছি। শেষ পর্যন্ত সেলিমের গ্রামের দুঃসম্পর্কের এক কাজিনকে ম্যানেজ করা হলো। এও বা কম কি? ডাক্তারদের অভিমত আমার কাউন্সেলিং জরুরি। নার্ভের উপর বেশ চাপ পড়েছে। গল ব্লাডারের অবস্থাও ভাল না।

    খাগড়াছড়িতে গিয়ে পৌছলাম প্রায় সন্ধ্যায়। মাগরিবের নামাযটা পড়ে চা নাস্তা খাচ্ছি এমন সময় ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো। খুলে দেখি শৈলীর নক। অনেক দিন পর। এক ছেলের সাথে হাস্যোজ্জ্বল কিছু ছবি। কোন ক্যাপশন নেই। বুঝতে কষ্ট হলোনা যে বুয়েটে সে খুব ভালো আছে। উইশ করতে গিয়ে দেখলাম আমি ব্লকড। ভালোই হয়েছে। একে একে নিভিছে দেউটি। চা খেতে গিয়ে আমার প্রেসার হঠাৎ বেড়ে গেলো। সহকর্মীরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। টেস্ট রিপোর্ট আর মেডিকেশন দেখে বললেন, “নার্ভাসনেস থেকে এমন হয়েছে। টেনশন থেকে গ্যাস শ্যুট করেছে। ভেতরে অস্থিরতা আছে। স্টেবল হতে সময় নেবে। কোন চাপ নেওয়া যাবে না”।

    এখন আর ফিল্ড ভিজিটে যাই না। অফিসে বসেই রিপোর্ট রিটার্নের কাজ করি। রাত্রি ভীতি পেয়ে বসেছে। সেলিমের কাজিনকে সাথে নিয়ে ঘুমাই। বড় ভালো ছেলে। ইন্টার পর্যন্ত পড়ে আর এগোতে পারেনি। আর্থিক স্বচ্ছলতা ভালো না। ক্ষেত খলা করে খায়। তার নাম হালিম। তার আন্তরিকতার ফিরতি দেওয়া সম্ভব না। জানিনা আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন কিনা? তিনি যেন হালিমের জন্য হালাল রুজির ব্যবস্থা করে দেন। রুজিতে বরকত দান করেন। হালিম এখন আমার জীবন চলার পথে অন্যতম বন্ধুস্থানীয় হয়ে গেছে। জানিনা আমার এই রাত্রি ভীতি, মনের স্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? আর হালিমই বা ক্ষেত খলা ছেড়ে কতদিন আমার সাথে থাকবে?

    হালিমকে নিয়েই মাগরিব আর এশার নামায মসজিদে গিয়ে পড়ি। হালিম পাক্কা নামাযী। ফজরও মিস নেই। আমি পারিনা। আফসোস হয়। সময় গড়িয়ে যায় আমার বদলীর আদেশ আর হয়না। হেড অফিসের সুপিরিয়র পজিশনে রদবদল হওয়ায় সব ক্ষেত্রে এখন স্থিতাবস্থা নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। জামান ভাই লেগে আছেন। কিছুতেই ব্যাটে বলে হচ্ছেনা। ইমাম সাহেব আমাকে দেখে খুব পেরেশানীতে পড়ে গেলেন। সুরা পড়ে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, “বাবাজী, সারাক্ষণ তাওবা-এস্তেগফার পড়বেন। আল্লাহর কাছে খালেস নিয়তে মাফ চাইবেন। ইন শা আল্লাহ ভালো হয়ে যাবেন”। তাঁর এই কথাতে মনের জোর বেড়ে গেলো অনেক। কানে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ অনেকটাই কমে গেছে। মাথাটাও আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে। নিয়ম করে নামায শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসি। নানা কথা শুনি। তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন বলে মনে হয়। হালিমকে ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ী থেকে তার ডাক এসেছে। এখন নিজের উপর কিছুটা আস্থা পাচ্ছি। তাকে বিদায় দিয়ে দরোজা খোলা রেখে বাবুর্চিকে বললাম ডাইনিংয়ে এসে শু’তে।

    এখন আর কারো কথা মনে করতে চাই না। শৈলী তার আপন ভুবন বেছে নিয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সময় ও স্রোত মানুষের মত ভুল করেনা। জেমির কথা চিন্তাতেও আনতে চাইনা। তার প্রতি মায়ার চেয়ে ঘৃণাই বেশি। সাবরিনার কথা মনে হয় মাঝে মাঝে। বিশেষত তার উচ্ছ্বলতা আর সহাস্য বদন ঈর্ষনীয়। আমার মনে হয় স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না। নিজের উপর আস্থা কমে গেছে। পৃথিবীটাকে বিবর্ণ মনে হয়। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, শীতলতা নেই। সর্বত্র ধুসর-উসর মরুময়তা। কোথাও সতেজ বৃক্ষ নেই, আছে মরু ক্যাকটাস। অবিকল সাবরিনার অফিস চেম্বারে রাখা বনসাই ক্যাকটাসের মত।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৮)
    মন অশান্ত। শান্ত হবে কবে? সারাক্ষণ এই এক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় । একা থাকলে বা রাতের নির্জনতায় এই চিন্তা আরো বেয়ারা হয়ে উঠে। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিয়ের উৎপাত। আম্মা ফোন করলেই এক কথা বলে। আমি রেসপন্স করিনা বলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে আমি এখনো সেই কিউটির মা জেমিকে নিয়েই পড়ে আছি। বিরক্ত হয়ে একদিন বললো, “কোথাকার কোন মেয়ে, কার বৌ দেখে পাগল হয়েছে। আর ঐ মেয়েই বা কেমন অসভ্য। কি জানি বাপু আমি এসব চিন্তাও করতে পারিনা। এই ছিলো আমার কপালে। বুড়োকালে এগুলোও হজম করতে হচ্ছে”? কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,“শোন্, ঐ মেয়েকে নিয়ে যদি কিছু করিস্ তাহলে আমাদের সাথে তোর আর কোন সম্পর্ক থাকবেনা। মান-ইজ্জত তো সব যেতে বসেছে”। আমি কোন উত্তর দেই না। দেওয়ার মত কিছু নেইও। আম্মা ইদানীং নিজে না করে মলিকে দিয়ে ফোন করায়। মলিও একদিন ধুম্ করে বলে বসলো, “তোমার সেই কিউটির মা’র নম্বর দাও তো”। আমি বিস্ময়ে হতবাক। বললাম, “কেন? কি হয়েছে”?
    — ফোন দেবো। কথা বলবো। প্রয়োজনে বাড়ী বয়ে কথা শুনিয়ে আসবো। মলির ঝাঁঝালো কন্ঠ।
    — হঠাৎ ক্ষ্যাপলি কেন?
    — ডিসগাস্টিং। শুনলেও গা ঘিন্ ঘিন্ করে
    — শুনিস না। আমার উত্তর
    — সেলিম জেনে গেছে।
    — কিভাবে?
    — তোমার সাথে আম্মার ফোন আলাপে। শ্বশুর বাড়ীতে আমার মুখ আর থাকলো না
    — কবে ছিলো? সেলিম যা করেছে উল্টো তাদেরই মুখ থাকার কথা না। তুইও তো কম কাহিনী করে বিয়েটা করিস নি। বলামাত্রই মলি ফোন রেখে দিলো। তার শ্বশুরবাড়ী নিয়ে কিছু বলা যাবে না। সেলিমকে নিয়েও না। জানি বেশ কয়দিন লাগবে এই অবস্থা কাটাতে।

    জেমি সম্মন্ধে আমিও ত্যক্ত। হতাশ। আগের সেই মোহের বিপরীতে ঘৃণা বোধ হচ্ছে আজকাল। বরং শৈলীর প্রজাপতি নৃত্য মাঝেমধ্যে দোলা জাগায়। জানি এটারও ভবিষ্যত নেই। তৌহিদকে খুলে বললাম। হেসে কুটি কুটি হয়ে দম নিয়ে বললো, “তোমার চোখের আর মনের অসুখ হয়েছে। যাকেই দেখো তাকেই ভালো লাগে। এক ধরণের মানসিক বৈকল্যও বলতে পারো। ডাক্তার দেখাও। বলো তো পাত্রী দেখি”। আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই তো। মানসিক কিছু সমস্যা নিশ্চয় হচ্ছে। তা না হলে বিবাহিতা জেমি, অসম শৈলী এদেরকে নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করছি কেন? জামান ভাইও দেখালেন ডানা কাটা পরী, মডেল। আজকাল মাথা প্রায়ই ঝিম্ঝিম্ করে। প্রথমে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। পরে চিন্ চিন্ করে। তারপর ক্লান্তি বোধ হয়। খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় বদলীর বিষয়টাও চাপা পড়ে গেছে। দেখতে দেখতে পাহাড়ে দেড় বছরেরও বেশি হয়ে গেলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। আমার জন্য অতি নির্জনতা যেমন দুর্বিষহ তেমনি অতি মুখরতাও অসহ্যকর। আমি মাঝারি গোছের জীবন যাপনে সিদ্ধ। সুন্দরীদের ভালো লাগে কিন্তু তাদের সাহচার্যে ভয়। স্বভাবে ভীতু ও স্বল্পবাক হলেও সাহসী ও উচ্ছ্বল প্রাণ সুন্দরীদের ভালো লাগে। কিন্তু এ কেমন অদ্ভুত বৈপরীত্য! জামান ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম, “ভাই, হাঁপিয়ে উঠেছি। আর কতদিন”?
    — বদলী? আপাতত বন্ধ। ম্যানেজমেন্ট ডিসিশন।
    — আমি তাহলে মরেই যাবো
    — পাগলামী করো না। ঐদিন যে মেয়েটাকে দেখিয়েছিলাম সে ব্যাপারে কিছু বললে না তো
    — ভাই, আমি মাফ চাই। আমার মাথা কাজ করছে না। পারলে এখান থেকে আমাকে নিয়ে যান।
    — পাগলামি করো না। মেয়ের বায়োডাটা পাঠাবো?
    — ভাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

    জামান ভাই কি বুঝলেন জানিনা। ফোন রেখে দিলেন। মনে হচ্ছে আরেক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়ছি। জামান ভাইয়ের সাথে সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আগামীতে হয়ত মন কষাকষি হবে। আমার ঢাকার বদলীও ঝুলে যেতে পারে। আমার ভেতরের মনোরোগ আবার চাগা দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। মাথা আর নিতে পারছেনা।

    অসময়ে আম্মার ফোন। বাসায় ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে নোটিশ এসেছে। এবারের রিটার্ন এখনো জমা প্রদান করা হয়নি। ট্যাক্স রিটার্ন হয় আম্মার নামে। আমাদের এক পরিচিত উকিল চাচা আছেন। তিনি প্রতি বছর আম্মার সাথে আলাপ করে রিটার্ন দাখিল করেন। এবার পারিবারিক ঝামেলার কারণে আম্মা খেয়াল করেনি। আর উকিল চাচাও খবর করেন নি। এখন উপায়? উকিল চাচাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা। ফোন লাগাতার বন্ধ। তিনি বসেন শ্যামলীতে। এমন তো কোনোবার হয়না। করোনার মধ্যে অবশ্য তার সাথে যোগাযোগও হয়নি। উনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তাও জানিনা। ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর সম্মন্ধে সাধারণ ট্যাক্সপেয়িদের দারুণ ভীতি কাজ করে। বেছে বেছে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ফাইল নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। অথচ কোটি কোটি টাকা যারা ফাঁকি দেয় তাদের কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। হলেও আন্ডার হ্যান্ড ট্রানজেকশনে দফারফা হয়ে যায়। ছোট মামার স্মরণাপন্ন হওয়া ভিন্ন কোন পথ নাই। মামা সার্কেল কমিশনারকে বিস্তারিত বলে একটা টাইম পিটিশনের ব্যবস্থা করেছেন। স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু মাথার উপর ঘন্টা ঝুলেই রইলো।

    বহুদিন পর উকিল সাহেবকে পেয়ে ভালোই লাগলো। তবে সাথে নতুন উপদ্রব যোগ হলো। আলাপের শেষে এসে বললেন, “বাবাজী, আপনার অবস্থা কি”? বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ”। তিনি আরো পরিষ্কার করে বললেন, “আপনার রিটার্ন দিয়েছেন তো”? আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “আমার আবার কিসের রিটার্ন”? উকিল সাহেব বেশ রসিক। এখন অবশ্য করোনার খোঁচা খেয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছেন। বললেন, “চাকরি করলে রিটার্ন দিতে হবে। আর আপনি তো মা শা আল্লাহ ভাল চাকরিই করেন”। বললাম, “অফিস তো সেলারি থেকে ট্যাক্স কেটে রেখেছে”। “খুব ভালো করেছে। এখন সেই কাগজ পত্র দিয়ে আপনার নামে নতুন ফাইল খুলতে হবে”। বুঝলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমারই খেয়াল করা উচিত ছিলো। বললাম, “চাচা, টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি মেইলে কাগজপত্র পাঠাচ্ছি। আপনি ফাইল ওপেন করে রিটার্ন দাখিল করার ব্যবস্থা করেন”। উকিল চাচা টাকার কথা শুনে গদ্ গদ্ হয়ে গেলেন। দেশের মানুষ। আব্বার পরিচিত ছিলো। বিশ্বস্তও।

    মতিঝিলে তৌহিদের অফিস। তাকে নিয়ে রাজউকে যাবো কাজে। ঐ অফিসের কথা শুনলেই আমার আত্মা থেকে থেকে চমকে উঠে। অগনিত লোকের আনাগোনা। কারো কোন উচ্চবাচ্য নেই। কার কি ব্যাথা, কার কত খসলো জানার উপায় নেই। রেফারেন্স নিয়ে কোন কাজে গেছেন তো আপনার পদে পদে বিপদ। এটা নাই, ওটা লাগবে। এভাবে হবেনা। আজ সম্ভব না। কাগজগুলো অস্পষ্ট ফেয়ার কপি দিতে হবে। আর যেই মাত্র দফারফা হয়ে গেল আপনি বুঝবেন সরকারি অফিস কত আন্তরিক। কাজ হচ্ছে ‘ফেল কড়ি ধরো পোয়া’ গতিতে। তৌহিদ পোড় খেতে খেতে এখন সিজনড। সেকশনের পিওন দেখামাত্রই দৌড়ে আসে। ঠান্ডা গরম কি খাবে জিজ্ঞেস করে। তার মাধ্যমেই আমাদের উত্তরা প্লটের রেজিস্ট্রেশন কাজ শুরু হলো। আমাকে সালাম দিয়ে পিওন বললো, “স্যার, নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। সব দায়িত্ব আমার। ফোন দিলে এসে কাগজ নিয়ে যাবেন”। শুনেই সুখ লাগলো। পকেট যতই ফাঁকা হোক। সেই তৌহিদকে নিয়ে লালনের কাছে গেলাম। পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জে তার অফিস। ইনসিওরেন্স কোম্পানীর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। কাজও ছিলো। আমাদের পুরোনো গাড়ীটার ইনসিওরেন্স রিনিউ করাতে হবে। বরাবর সে-ই করে দেয়। বললো এখন আর লাগবেনা। বিস্মিত হলাম। বললাম, “পুলিশের ছত্রিশ বাহানার এক বাহানা এই ইনসিওরেন্স পেপার। লাগবেনা মানে”? জানলাম, থার্ড পার্টি ইনসিওরেন্সের এখন আর প্রয়োজন নেই। পুলিশও আর দেখতে চাইবেনা। তার অফিসেই লাঞ্চ হলো। কথা প্রসঙ্গে তৌহিদই প্রসঙ্গটা তুললো। লালন থতমত খেয়ে বললো, “লিভ ইট। যে যাবার সে চলে গেছে। বাট কুডন্ট নো হোয়াই”?। লালনের গার্ল ফ্রেন্ড চার বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে হুট করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছে কানাডা প্রবাসী এক জনের সাথে। নিজেকে বাঁচাতে সে কথা ঘুড়িয়ে ফোকাস ফেললো আমার উপর। নাচুনে কাঠি তৌহিদ সরব হয়ে উঠলো। টিপ্পনী কেটে বললো, “উনার দীপিকা পাডুকোন ফেসিনেশন রোগ হয়েছে”। লালন হাসলো। সে হাসিতে তাচ্ছিল্য বা রঙ্গ জাতীয় কিছু বোধ হলো না। যা বুঝলাম তা হলো সবই কপালের লিখন। লালনের ওখান থেকে বের হয়ে তৌহিদ চলে গেলো তার অফিসে। আর আমি উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকলাম।

    হঠাৎই মামার অফিসের কথা মনে হলো। অফিসে গিয়ে দেখলাম মামা নেই। মফস্বল গেছেন। তাই পিওনও আসেনি। ফিরে যাচ্ছিলাম। করিডোরে সেই উচ্ছ্বল প্রিয়দর্শিনী সাবরিনার সাথে দেখা। লাস্যময়ী সাবরিনা দেখামাত্রই ফোঁড়ন কাটলেন,“মামা নেই জেনেও ভাগ্নে অফিসে যে”? তাইতো। পরশু আলাপকালে মামা বলেছিলেন দু’দিন তিনি চিটাগাং থাকবেন অফিসের কাজে। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেলো। কোন মন্ত্র বলে কিসের নেশায় কিসের আশায় এলাম বুঝে উঠতে পারলাম না। “স্যরি, ভুলে গেছিলাম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই ঢু মারতেই এসেছি”। সাবরিনা চোখ ঈষৎ কুঁচকে বললেন, “তাই নাকি? এদিকে প্রায়ই আসেন নাকি? কই এতদিন তো টের পেলাম না”। আমার সেই ডায়ালগের কথা মনে পরে গেলোঃ হে ধরণী, দ্বিধা হও। পরক্ষণেই মনে হলো ধরণী দু’ভাগ হওয়ার চান্স নেই। আমিই বরং পাংচার হয়ে গেছি। সাবরিনাই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে বললেন, “আসেন। আমার রুমে আসেন। এক কাপ চা বা কফি খেয়ে যান। নাকি এখন আর রুচি নেই”? সত্যি আমার রুচি হাওয়া হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বললাম, “পানি খাবো”। সাবরিনা হাসলো,“সিওর”। সাবরিনার রুমটা ছোট কিন্তু পরিপাটি। চেয়ারের পাশে ফাইল কেবিনেটের উপর ক্যাকটাসের বনসাই। টেবিলে ছোট্ট পারিজাত ফুলের শোভা। বললেন এটা তার বাসার ছাদ বাগানের ফুল। পানি খেলাম। গুগলী ফেস করার আগেই কেটে পড়া উত্তম ভেবে উঠতে যাবো তখন ইশারা করে বসতে বললেন “এসেই যখন পড়েছেন তখন আলাপ করি। আপনার সম্মন্ধে জানি”। আমি ঢোক গিললাম। আমার স্বভাবে দু’ধরণের চরিত্রের মিশ্রণ আছে আমি জানি। মনোবিজ্ঞানীরা এদেরকে বলে এম্বিভার্ট। এরা খানিকটা ইন্ট্রোভার্ট আর খানিকটা এক্সট্রোভার্ট টাইপের হয়ে থাকে। পালাবার উপায় খুঁজছি। সাবরিনা নিরবতা ভাঙ্গলো, “কি ভাবছেন”?
    — এখন উঠবো
    — ভয় পাচ্ছেন?
    — উহু
    — পথ ভুল করে যখন এসেই পড়েছেন তখন আলাপ করি। স্যার নেই, তাই হাতে কাজও নেই।
    — আমার অন্য কাজ আছে
    — কি কাজ?
    — জানিনা
    — এই যে বললেন অন্য কাজ আছে
    — বাসায় যাবো
    — যাবেন তো অবশ্যই। আপনাকে কে বেধে রাখছে? তবে একসাথে লাঞ্চ করি আগে
    — জ্বীনা। থ্যাংকস
    — লাঞ্চ করেন না নাকি?
    — করি তো
    — তো এখন করলে দোষ কিসে?

    আমি এক প্রকার ছেলেমানুষী করেই উঠে পড়লাম। উঠতে গিয়ে টেবিলের পায়ায় হোচট খেলাম। সাবরিনা হাসলো। বললো, “একা বাসায় যেতে পারবেন তো”? জানি মজা নিচ্ছে। এখনো ধরণী দু’ভাগ হচ্ছেনা। কোন মতে বেরিয়ে নীচে নেমে এলাম। ভাবছি এই মেয়ে এত প্রিয়দর্শিনী, এত প্রিয়ভাষিণী কেন? পেটে খিদে তবু মন ফুরফুরে। এটা কি মনোরোগের লক্ষ্মণ?

    চলব…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৭)
    জামান ভাইয়ের স্বপ্ন সাধ পূরণ হয়েছে। করোনার কারণে সীমিত পরিসরে ওয়েডিং রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে সেনাকুঞ্জে। ভাবীর বড় ভাই মেজর জেনারেল। বিত্ত বৈভবে তারা যে অতি উচ্চে তা আয়োজন দেখেই বুঝা গেলো। জামান ভাইয়ের তরফ থেকে ভালোবাসা একতরফা হলেও ভাবী নিমরাজি ছিলেন বরাবর। তার ভয় ছিলো ফ্যামিলি থেকে মেনে নেবে কিনা? যাহোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এই মেল বন্ধন সম্ভব হয়েছে।

    হাজার পাঁচেক টাকা মূল্যমানের প্রাইজ বন্ড তোফা হিসেবে নিয়ে গিয়ে বেওকুফ বনে গেলাম। উপহার গ্রহণের কোন ব্যবস্থাই নেই। জামান ভাইকে বলে ধমক খেলাম। আমাদের জন্য রিজার্ভ টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি যাই না। যদিও যাই প্রথম ব্যাচেই বসে পড়ি। এতে সুবিধে অনেক। প্রথমতঃ বিয়ের অনুষ্ঠানে সময়মত কেউ গিয়ে পৌছায়না। ঢাকা শহরের যানজট আর মহিলাদের সাজুগুজু ইত্যাদির কারণে সম্ভবও হয়ে উঠেনা। তাই বিয়ে বাড়ীর আমেজ পুরোপুরি জমে উঠেনা। তখন পরিচিতদের সাথে নিরিবিলি পরিবেশে হাই-হ্যালো করা যায়। দ্বিতীয়তঃ প্রথম ব্যাচের খাবার টেবিলে যে পরিচ্ছন্নতা ও খাবারের স্মেল, ফ্রেশনেস আর পরিবেশনার দক্ষতা যেরুপ থাকে পরবর্তী ব্যাচে তা সে পরিমাণে পাওয়া যায় না। তৃতীয়তঃ খাওয়া শেষে পান বা কফি হাতে বাকী পরিচিত অভ্যাগতদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। চতুর্থতঃ ব্যাচেলরদের জন্য এই দীর্ঘ সময়টা খুব কাজে লাগে। পাত্রী তালাশে। এ যেন পাত্রীর হাট। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। তবে বিভ্রান্ত হতে হয় প্রায় এক রকম সাজ আর উচ্চমাত্রার প্লাস্টিক পেইন্ট এর কারুকাজ দেখে। এর মাঝেও রয়েছে হিন্দী সিরিয়ালের প্রভাব। জামান ভাই ঘুরে ঘুরে সব খোঁজ নিচ্ছেন। কানের কাছে এসে বললেন, “খেয়ে দেখা করো”। আমাদের খাবার শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারের পিছনে এসে প্রায় সবাই পরবর্তী রাউন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে গেছে। সাউন্ড সিস্টেমে হিন্দী আর বাংলা ব্যান্ডের গান উচ্চগ্রামে বাজছে। বুঝলাম জামান ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণ এখানে অনুপস্থিত। ভাবছি এখনো কি জামান ভাই রাতের খাবারের পর পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান জারি রাখতে পারবেন? পরক্ষণেই হাসি পেল। কি যা তা ভাবছি।

    এবার বিদায়ের পালা। জামান ভাইয়ের সামনাসামনি হতেই কাঁধে হাত রেখে কোণায় নিয়ে গিয়ে একটি মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “ভালো করে দেখো। পছন্দ হলে আলাপ করা যাবে। বাবা এয়ার ফোর্সে উপরের লেভেলে আছে। একমাত্র মেয়ে। নর্থ সাউথে বিবিএ পড়ছে”। আমি দেখলাম। বিস্তারিত শুনে আর মেয়েটিকে দেখে আমার রীতিমত অস্বস্তি ও ভয় ধরে গেলো। অস্বস্তি এ কারণে যে আমার মাথায় এখন জেমি ভার্সেস শৈলীর আনফিনিসড ড্রামা চলছে। আর ভয় এ কারণে যে, অতি বিত্তবানদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি। তাদের কন্যাদেরকে তো অতি অবশ্যই। এদের চিন্তা-ভাবনা, আবদার-চাহিদা আর দৌড়াদৌড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারার মত ছেলে আমি না। জামান ভাই হেসে বললেন, “ঘাবড়াও মাত। মেয়ে মডেলিং করে। নাটকেও ঝোঁক আছে”। আমি ঘন ঘন ঢোক গিললাম। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসা মাত্রই আম্মার ফোন, “তাড়াতাড়ি আয়। আমরা মলিকে নিয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালে। মাথা ঘুড়ে পড়ে গেছিলো”। বুকে প্রচন্ড একটা শক্ খেলাম। সেলিম আবার কোনো অঘটন ঘটায়নি তো? আম্মা কিছু বললেন না। বললেন, “কিছু টেস্ট দিয়েছে। এখন সেটাই করাচ্ছি”। অজানা আশংকায় মনটা থেকে থেকে খামচাখামচি করছে।

    ল্যাব এইডে আর যাওয়া লাগেনি। সোজা বাসায় গিয়ে শুনি মলি সন্তান সম্ভবা। আম্মা খুশি। সেলিম আরো। আমারও খুব আনন্দ হলো। আমি মামা হতে যাচ্ছি। হঠাৎই আব্বার কথা মনে পড়লো। আব্বা আজ বেঁচে থাকলে কি থেকে কি যে করতেন অনুমানও করা যায় না। ছোট মামা ফোনে খোঁজ নিলেন। শেষে বললেন, “সেলিমের এখন কিছু একটা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তুমি কাল হক্কানী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার অফিস হয়ে যেও”। ঠিকই তো। সেলিমের এখন কিছু একটা করা অতি অবশ্যই দরকার। মলির মেন্টাল সাপোর্টের জন্য এটা হবে অনেক উপকারী। সেলিমের জন্য মায়া হলো। হতভাগার এসবে খেয়াল নেই। মলির জন্য কেন জানি কান্নাই পাচ্ছে। বকাবাদ্য করি, রাগারাগি করি যা-ই করি ছোট বোন বলেই করি। ক্ষেপাবার জন্যও করি। হয়ত একটু বেশিই করে ফেলি।

    হক্কানী সাহেবের অফিসে গিয়ে তাঁকে পাইনি। ব্যস্ত মানুষ। বললেন, মঙ্গলবার লাঞ্চের পর যেতে। তাঁর অধস্তন এক ভদ্রলোক সব কিছু বুঝালেন। কফি খাওয়ালেন। আর উপদেশ দিয়ে বললেন, “যিনি এটা করতে চাচ্ছেন বা করবেন তাকে অবশ্যই হার্ড ওয়ার্কিং হতে হবে আর লেগে থাকতে হবে। আর নিজের বিজনেস টেকনিক কাজে লাগাতে হবে”। তার কথা শুনছিলাম আর সেলিমের সাথে মিলিয়ে নিতে গিয়ে হতাশ হচ্ছিলাম। এর কোন গুণই ওর মধ্যে নেই। আছে উচ্চাভিলাস আর তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার উদগ্র বাসনা। টেকনিক বলে কিছু নেই, যা আছে তাও খাটায় না। আবার বেশি বুঝতে গিয়ে লেজে গোবরে করে বাসায় এসে মলির আঁচল ধরে শুয়ে থাকে। আশ্চর্য। পুরুষ মানুষ এমন হয় চিন্তা করতেও কষ্ট হয়।

    হক্কানী সাহেবের অফিস থেকে বেরিয়ে মামার অফিসে গেলাম। মামা নেই। বসতে বলেছেন। পিওন বসিয়ে দিয়ে কফি দিয়ে গেল। খাওয়ার উদ্রেক হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি। বসে বসে উইন্ড স্ক্রীণ দিয়ে ঢাকা শহর দেখছি। গলি পথে একই রাস্তায় ঠেলা চলছে। রিক্সা, লেগুনা, মাইক্রো, পিক আপ, কভার্ড ভ্যান, কুরিয়ারের কার্গো, কার, জীপসহ রকমারি যানবাহন ছুটোছুটি করছে। এর ফাঁক গলে হাজার হাজার মানুষ কিলবিল করছে। ধুলো আর কালো ধোঁয়ায় মানুষগুলোর মুখাবয়বে আলাদা পলেস্তারা পড়েছে যেন। এর সাথে রয়েছে তীব্র হর্ন। ট্রাফিক আছে। তবে জায়গামত না। টংয়ে দাঁড়িয়ে পান-বিড়ি খাচ্ছে আর পাবলিকের সাথে কথা বলছে। ভাবটা এমন যে, অনিয়মই যেখানে স্বাভাবিক সেখানে নিয়মের শাসনে গতি বাধা গ্রস্থ করে কি হবে?

    সাবরিনা মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে এলো। বললো, “স্যরি, স্যার বলে গিয়েছিলেন আপনি আসবেন। পিওনকে বলেও রেখেছি আপনি আসলে যেন খবর দেয়। ভুলে গেছে। স্যরি”। সাবরিনার মুখে ‘স্যরি’ শুনতে অদ্ভুত ভাল লাগলো। হঠাৎই মনে প্রশ্নের উদয় হলো, সাবরিনারা কেন চাকরি করে? এরকম মাথা খারাপ করা সুন্দরীদের কারো অধীনে দেখলে খারাপ লাগে। বস্তুত এরা স্বামীর অধীনেও থাকার মত না। স্বামীরাই চন্দ্রমুখ দর্শনে মোহাবিষ্ট থেকে এদের অনুশাসনে তুষ্ট থাকে। এরা আসলেই নায়িকা হওয়ার মত। সারাক্ষণ মেনকা হয়ে থাকবে। ফ্যান ফলোয়াররা ঘুরঘুর করবে। মিডিয়া এদের নিয়ে সত্য-মিথ্যার মিশাল দিয়ে চটকদার গসিপ বানাবে। পাবলিক সেগুলো গাঁটের পয়সা খরচ করে এমবি কিনে পড়বে, দেখবে। প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে দ্রষ্টব্য স্থানে তাদের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড দ্যুতি ছড়াবে। “কফি খাচ্ছেন না যে” সাবরিনার কথায় ভাবালুতা কাটলো। নড়েচড়ে বসলাম। বললাম, “খেতে ইচ্ছে করছে না”।
    — সেদিন না বললেন খাগড়াছড়ি গিয়ে কফি খোর হয়েছেন? সাবরিনার গুগলি।
    — একটু আগেই খেয়েছি। আমার ততোধিক তরল উত্তর।
    — ঢাকায় পোস্টিং হবে না
    — কেন?
    — না, এমনি। সবাই তো ঢাকাতেই থাকতে চায়
    — ইচ্ছে তো হয়। সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়?
    — আর কি ইচ্ছে হয়?
    — আছে অনেক কিছুই। কোনটা বলবো? তার চেয়ে আপনার সম্মন্ধে কিছু শুনি। আপনি বলুন।
    — আমার সম্মন্ধে? আমি সেলিব্রেটি নাকি?
    — মোর দেন দ্যাট
    — তাই নাকি? বুয়েটিয়ানরা দেখছি ইট পাথরের বাইরেও দৃষ্টি দেয়। সাবরিনা মুচকি হাসলো। সে হাসিতে দুষ্টুমির চিহ্ন সুস্পষ্ট। বললাম, “থাকেন কোথায়”?
    — কাছেই। সেগুন বাগিচায়।
    — বাসায় আর কে কে আছেন?
    — ফ্যামিলি আছে
    — ফ্যামিলিতে কে কে আছেন?
    — কি মনে হয়?
    — কিছুই মনে হয়না
    — তাহলে জানতে চাচ্ছেন যে?

    এমন সময় মামা এলেন। সাবরিনা সৌজন্যতা শেষে বিদায় হলো। হক্কানী সাহেবের প্রপোজাল নিয়ে আলাপ হলো। বললাম সেলিমের জন্য এটা মোটেই উপযোগী না। মামাও মাথা নাড়লেন। লাঞ্চ করালেন। এরি মধ্যে শৈলীর ফোন। ঘন ঘন বেজে চলেছে। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছি। শুধু শুধু জটিলতা বাড়াতে চাচ্ছিনা। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’? সাবরিনা কাজের জন্য আবার এলো। মৃদু হাসি বিনিময় হলো। আমার কাজ শেষ। তবু উঠতে ইচ্ছে করছেনা। এই বয়সেই কি গতি জড়তায় পেয়ে বসলো নাকি অন্যকিছু? অফিস থেকে বেরোবার পথে করিডোরে ব্যস্তসমস্ত সাবরিনার সাথে দেখা। হাসি বিনিময়ে বললো, “আবার আসবেন। আপনি খুব ইন্টারেস্টিং”। আমার লিফট এসে গেছে। অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ভিন্ন আর কোন পথ খোলা নাই।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৬)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৬)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৬)
    জেমির আর কোন খবর পাওয়া যায়না। ইলমাও ফোন ধরেনা। নিরর্থক জেনেও ওদের বাসার সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করি। নিজের কাছেই ব্যাপারটা অশোভন ঠেকে। বাসার সিকিউরিটি গার্ডের সাথে দেখা হয়। কথাও হয়। কিন্তু আসল কথা জানা যায়না। শুধু এটুকু জেনেছি জেমি অসুস্থ। হাসবেন্ড বিদেশ থেকে এসেছে। বিদেশে নিয়ে যাবে। তথ্য হিসেবে সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে এর চেয়ে অতিরিক্ত কি আশা করা যায়? এরিমধ্যে একদিন ইলমার সাথে তাদের বাসার গলিতে দেখা। দেখেই বললো, “আপনি এদিকে যে”? “এক আত্মীয়ের বাসায় এসেছিলাম” ঝটপট বানিয়ে বললাম। ইলমা সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, “আপুর সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন”? বললাম “না, তা কেন হবে”? “লাভ নেই” বলেই হাঁটা দিলো। আমি নিশ্চিত এ নিয়ে বাসায় আলোচনা হবে, অশান্তি বাড়বে। জেমি বিব্রত হবে। এমনকি আমার উপর বিরক্তও হতে পারে। বুঝতে পারলাম এদিকে আর ঘোরাঘুরি করা যাবেনা।

    ছোট মামা অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন। আম্মাও তাগিদ দিচ্ছে যেতে। কি কাজ জানিনা। গেলাম তার সেগুন বাগিচা অফিসে। খুশি হলেন। মামীকে নিয়ে খাগড়াছড়ি যাবেন বললেন। চা খেতে খেতে অফিসের টুকটাক কাজও সারলেন। সাবরীনাকে বেশ কয়েকবার ডাকলেন। সাবরিনা তার জুনিয়র সহকর্মী। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার ভাগ্নে। বুয়েটিয়ান। ইউ এন ডিপিতে কাজ করে। খাগড়াছড়ি পোস্টেড”। কেমন করে যেন তাকালো। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে পরিচিত। সবাই জানে। হয়ত সে কারণেই। বসের কল পেয়ে সাবরিনাকে বসিয়ে রেখে মামা চলে গেলেন। আলাপের ক্ষেত্র খুঁজে পাচ্ছিনা। কিছুক্ষণ এভাবে চুপচাপ থাকলাম।

    সাবরিনাই জড়তা কাটালো, “চা বা কফি”? বললাম, “নো, থ্যাংকস। মামার সাথে খেয়েছি”।
    — চা, কফি কি মেপে মেপে খান? সাবরিনার প্রশ্ন।
    — না, না। আমি চা খোর। খাগড়াছড়ি গিয়ে হয়েছি কফি খোর।
    — তাহলে না করছেন কেন? এই বলে সে দু’কাপ কফির অর্ডার দিলো।

    সাবরিনা বেশ সুন্দরী। সরকারি অফিসে সাধারণত এরকম নায়িকা টাইপ সুন্দরী দেখা যায় না। থাকলেও হুট করে বিয়ে হয়ে যায়। অথবা বিয়ে করেই চাকরিতে ঢোকে। আমার সমস্যা হলো সুন্দরী মেয়েদের সাথে কথা জমাতে পারিনা। মনে হয় কখন দেমাগের হেড লাইট জ্বালিয়ে দেবে। আমার আত্মসম্মানে লাগবে। তাছাড়া সুন্দরীদের সম্মন্ধে আমার কিছু নেগেটিভ সেন্স কাজ করে। এরা দেমাগী হয়। উচ্চাভিলাষী হয়। সবাইকে ইগনোর করে। প্রশংসা পাবার জন্য মুখিয়ে থাকে। সবাইকে মনে করে তাদের এডমায়ারার। মামা ফিরে এলেন। সাবরিনা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমার হাতে একটা ব্রোসিয়ার আর একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন হক্কানী সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেলিমের জন্য নতুন বিজনেস প্রপোজাল আছে।

    পৃথিবী জুড়ে এক অদ্ভুত অসুখ এসেছে। সামান্য হাঁচি-কাশি দেওয়াও এখন ভয়ের, লজ্জার। সাধ্যমত চেপে রাখতে হয়। আগে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সর্দি, কাশি, জ্বর, গলা ব্যাথা, নাক বন্ধ, নাকে গন্ধ না পাওয়া, জিহ্বায় স্বাদহীনতা ছিলো স্বাভাবিক। সবাই ধরে নিত সাত দিন ভুগতে হবে। বেশি বেশি লংকা, পেঁয়াজ, আদা, গরম চা, গরগরা, জাম্বুরা ইত্যাদিতেই পরিত্রাণ মিলত। তীব্রতা বেশি হলে বা সহ্য ক্ষমতা কম হলে যারা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হত তাদের দেওয়া হত এন্টিবায়োটিক। এক সপ্তাহের ডোজ। আর এখন? কাশি যথাসাধ্য কন্ট্রোল করে রাখতে হয়, জ্বর গোপন রাখতে হয়, গা ব্যাথা, গলা ব্যাথা, নাকে ঘ্রাণ না থাকা ও স্বাদ বুঝতে না পারা রীতিমত চেপে যেতে হয়। চেপে চুপে আর কতক্ষণ থাকা যায়? এর কোনটির লক্ষ্মণ ধরা পরা মাত্র আপনি কট। অফিস থেকে ফরমান নাজিল হবে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। অথবা সিক লিভ নিতে বলা হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেউ কেউ নেয় আবার কেউ এটাকেই ফাঁকিবাজির হাতিয়ার বানায়। ঢাকা থেকে ফিরেই আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আমার জোড়া টনসিল আক্রান্ত হয়েছে, সে কারণে গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। সনাতনী পদ্ধতিতে যেই মাত্র গরম পানিতে গার্গেল করেছি অমনি রুমমেটরা ঘোষণা দিয়ে বসলো নির্ঘাত করোনা হয়েছে। তাদের সবার এক কথা “আইসোলেশন ইজ মাস্ট। বাট নট হিয়ার। এনি আদার প্লেস এলস হোয়ার”। সেকারণে, বলা চলে তাদেরকে আশংকামুক্ত রাখতে আর অফিসের আদেশ পালনে বাধ্য হয়ে আবার ঢাকায় ব্যাক করি। টেস্ট করানো হলো। রিপোর্ট নেগেটিভ। ডাক্তার দেখানো হলো। মুখে স্টেনলেস স্টিলের চামচাকৃতির দন্ড দিয়ে জিহ্বাকে চেপে ধরে আরেক হাতে টর্চের আলোর ফোকাস ফেলে ডাক্তার চোখ বড় বড় করে বললেন, “টু বিগ, লাইক গলফ বল”। ওষুধ দিলেন। বললেন, ওষুধে কাজ না হলে টনসিল অপসারণ ফর‍য হয়ে পড়বে।

    যাহোক, ওষুধেই সব কিছু নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। আমি কোয়ারেন্টাইন পক্ষ পালন করার পর খাগড়াছড়ি ফিরেছি। জেমির কোন খবর নেই। জেমি এখন একটুকরো স্মৃতি কথা ভিন্ন অন্য কিছু না। শৈলী নতুন ক্লাসমেট পেয়ে ‘ফার্স্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার’ ম্যুডে আছে। এ কয়দিন আমিও ফোন দেই নি। সেও না। পৃথিবীর সব কিছু একই নিয়মে চলতে থাকবে আশা করা বোকামী। বুঝতে পারছি শৈলীর এখন বসন্তকাল চলছে। চারিদিকে সৌরভ, রঙের মেলা। পিছু ফিরে তাকাবার ফুরসত নেই। এগিয়ে যাওয়াই যৌবনের ধর্ম। মাঝে মাঝে দারুণভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। জেমিতে মজলাম কোন যুক্তিতে? ভেতর থেকে উত্তর এলো, প্রেম, ভালবাসা লজিক মেনে হয়না। চকিতেই হয়ে যায়। শৈলীর সাথে ফোনালাপ আর এস এম এস এর খুঁনসুটির দায়ভার কার? সে টিন এজ বালিকা। ডানায় সদ্য শক্তি পেয়েছে, দেহে স্রোতস্বিনী যৌবনের ছলাৎ ছলাৎ আলোড়ন। তার পক্ষে এলোমেলো উচ্ছ্বাস সাজে। কিন্তু তাতে আমি কেন এত উদ্বেলিত বোধ করছি? ফাংশনাল সম্পর্কের বাইরে একজন টিউটরের দায়বদ্ধতা কি? জানিনা। খাগড়াছড়ি আসার পর থেকে তার সাথে এত বেশি ইন্টারেকশন কি নিছক সৌজন্যতা নাকি জেমিহীন পৃথিবীতে একজন চঞ্চলমতি বালিকার উজ্জ্বল উপস্থিতিজনিত আগ্রাসন? অনেক দিন হয়ে গেল শৈলীর ফোন আর আসেনা। সারাদিন এলোমেলো লাগে। রাতে প্রতীক্ষায় থাকি এই বুঝি শৈলী ফোন দিয়ে খোঁচা মেরে বললো, “আংকেল, এখনো ভাব ধরে আছেন? ভাব ধরেই থাকেন”। আগে জেমিহীন সব কিছু পানসে লাগত আর এখন তিতা তিতা লাগে। বাসায় ফোন দিতেও ভাল লাগেনা। আম্মা ফোন দিলে খবরাখবর নেই। মোটকথা কোন কিছুতেই আর উৎসাহ পাইনা। একজন জেমী বা একজন বালিকার কত শক্তি যে সব কিছু রূপহীন, রসহীন, গন্ধহীন, বর্ণহীন, ছন্দহীন, গতিহীন করে দেয় সহজেই।

    রুমমেটদের সাথে হাসি ঠাট্টা আর সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। এক সাথে উঠাবসা হয়। কিন্তু একান্ত ব্যাক্তিগত অধ্যায় শেয়ার করার মত উদ্রেক হয়না। ইমাম সাহেবের কাছে বসলে দুনিয়াদারি তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় এ দুনিয়া খেল তামাসা ছাড়া আর কিছু না। একেকবার মনে হয় তার কাছে খুলে বলি সব কিছু। বললে হয়ত হাল্কা বোধ হবে। কিছু ভাল পরামর্শও পাওয়া যেতে পারে। আজ খুব শীত পড়েছে। সন্ধ্যায় ভাল বৃষ্টিও হয়েছে। এশার নামায শেষে লোকজন যে যার মত দ্রুতই বেরিয়ে গেলো। ইমাম সাহেবকে সালাম দিয়ে গিয়ে বসলাম সামনে। আরো দু’জন ছিলো বসা। তাদের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা। একজন বলেই ফেললেন তিনি পারিবারিক ভাবে খুব পেরেশানীতে আছেন। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাই বড়। তাদেরকে শাসন করা যাচ্ছেনা। স্ত্রী তাদের হয়ে এমন ভাবে কোমর কেচে নামে বাসায় টিকাই দায়। ইমাম সাহেব হাসলেন। বললেন, “ স্ত্রীকে বেশি চাপাচাপি করবেন না। জানেন তো বাঁকা হাড় দিয়ে তৈরি। বেশি করবেন সোজা তো হবেই না বরং ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর ছেলে মেয়েদেরকে সময় দেন। তাদের চাহিদা বুঝার চেষ্টা করুন। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ”। ভদ্রলোক চলে গেলেন। অপরজনের রাতে ঘুম হয়না। ডাক্তার হাই ডোজ মেডিসিন দিয়েছে। কাজ হচ্ছে না। ইমাম সাহেব শান্ত কন্ঠে বললেন, “বাবাজী, দুনিয়াবি ঝামেলা কমিয়ে দিন। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ুন। ডিম লাইট জ্বালাবেন না। ডান কাত হয়ে শোবেন। বিসমিল্লাহ পড়ে সুরা ফাতিহা আর তিন কুল পড়তে থাকবেন। তাতেও ঘুম না এলে তাসবীহ, তাহলীল যা জানেন তা পড়তে থাকবেন। ইন শা আল্লাহ ঘুম এসে পড়বে”। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর পরই আমি বলে ফেললাম, “হুজুর,আমার একটা সমস্যা”। ইমাম সাহেব উঠতে গিয়েও বসলেন। বললাম, “আমার এক বন্ধু, কঠিন বিপদে পড়েছে”। আমার সমস্যা বন্ধুর নামে চালিয়ে দিলাম। ইমাম সাহেব হাসলেন। চুপ করে থেকে কয়েকবার নাউযুবিল্লাহ পড়লেন। পরে বললেন, “বাবাজী, এটা হাল আমলের মারাত্মক রোগ। পরকীয়া। হারাম, হারাম, হারাম। অন্যের স্ত্রীর সাথে যাই করা হবে তাই নাজায়েয। কবীরা গোনাহ। যত দ্রুত সম্ভব এ থেকে সরে আসতে বলেন। কোন ফায়দা তো নেই-ই বরং আখেরে ভীষণ মসিবত। দুনিয়াবিতেও অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে”। আমি বললাম, “এখন উপায়”? তিনি বললেন, “সামর্থ থাকলে দেখে শুনে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে বলেন। আর সামর্থ না থাকলে তাড়াতাড়ি এই হারাম কাজ থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন”। আমি চলে আসবো এমন সময় ডাক দিয়ে বললেন, “শয়তানের সবচেয়ে আনন্দ হয় তখন, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ফাটল ধরাতে পারে। তালাকের মত অপছন্দনীয় কাজে প্ররোচিত করতে পারে। আর এ কাজে আপনার বন্ধুকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে”। আমার হাত ধরে বললেন, “বাবাজী বুঝতে পেরেছি আপনি নিজেই এই কঠিন বিপদে পড়েছেন”। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে এলো। এরপর আর কথা চলেনা। বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

    ভাবছি, জেমি আসলে কে? তার সাথে আমার এই সম্পর্ক কি ভালবাসা, ইনফেচুয়েশন নাকি মায়া? নাকি আত্মাহুতির জ্বলন্ত অংগার? নিজেই নিজেকে বিশ্লেষণ করতে থাকলাম। এটা ঠিক যে জেমিকে দেখামাত্রই তার দীপিকা পাডুকোন লুক আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। ছাত্রীকে পড়ানোর সুবাদে আর জেমির ঔৎসুক্যে আমাদের আড়াল আবডাল গাঢ়ত্ব পেয়েছে। জেমির সাহসী ভূমিকা আমাকে খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসতে উজ্জীবিত করেছে। সেটা জেমির তরফ থেকে হতাশাকে লাঘব করার জন্য উত্তম টাইম পাস হতে পারে, হতে পারে “এমনি করেই যদি জীবনটা কেটে যায়, যাক না” জাতীয় সুখের বিকল্প অপশন। তার জন্য সিরিয়াস সিদ্ধান্ত নেওয়া যেমন কঠিন। তেমনি আমার জন্যও অনেক “যদি কিন্তু তবে” জাতীয় হার্ডেলস অতিক্রম করার কঠিন পরীক্ষা। আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি অংকের হিসেবে অনেক জটিল। মেয়েরা খুব আবেগী হয়। তাদের মননে-মগজে নানাবিধ রস খেলা করে। হাওয়া বদলের সাথে সাথে এর রুপও বদল হয়। অতি সংবেদনশীল হলেও এরা খুব বাস্তববাদী হয়ে থাকে। আবেগ তাদের খুব সহজেই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কখনো শ্লীল-অশ্লীলের পর্দা ছিন্ন করে ফেলতে পারে। কিন্তু দিন শেষে মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসে খুব সহজেই। ভাবছি এলোমেলো এমন কিছু। হঠাৎ শৈলীর ফোন। বেজেই চলছে। ধরিনা। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে জীবনকে আর জটিল করতে চাইনা।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৫)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৫)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৫)
    মানুষের জীবনটা যেন কেমন? এত ব্যস্ততা, এত পেরেশানী, এত লাভ-লোকসানের ছলচাতুরী প্রাণীকুলের আর কারো মাঝে নেই। এত রোগ,এত শোক, এত মনোবৈকল্য, এত চিকিৎসা, এত এত রিহেবিলিটেশন সেন্টার প্রাণীদেরও জন্য যদি প্রয়োজন হত তা হলে সৃষ্টিজগত ভিন্নরুপে সাজত। আগে ফ্যামিলি ছিলো সব কিছুর রক্ষাকবচ। এর কিছু সেট রুলস ছিলো। প্লাস মাইনাস করে চলত সবাই। আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিত। একের প্রয়োজনে দশজন চকিতে দৌড়ে আসত, ঝাঁপিয়ে পড়ত অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে। আর আজকাল? সামান্য স্বার্থে অতি আপনজন সরে যায়, চোখ উল্টিয়ে জিঘাংসা পুষে রাখে অন্তরে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে বোঝা মনে করে। ভুলিয়ে ভালিয়ে ফেলে রেখে আসে ফুটপাতে অথবা ব্যাক পুশ করতে করতে বাধ্য করে বৃদ্ধ নিবাসের বাসিন্দা হতে। পরিবার ভেঙ্গে হয়েছে এক একটি ব-দ্বীপ। এতেই যেন তুষ্টি, এতেই যেন মুক্তি। সেই নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির বৃত্ত ভেঙ্গে সন্তানেরা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। সেখানেই তৃপ্তি সেখানেই স্থিতি। তাই মৃত্যুকালেও বাবা-মার মুখ দর্শন নেহায়েত মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট বলে মনে হয়। জনকের পচনপ্রায় লাশ পাশে সরিয়ে রেখে ভাগ-বাটোয়ারাতে মত্ত থাকে অপত্যস্নেহে লালিত তার উত্তরাধিকার। কার জন্য এই ত্যাগ? এই কি তার প্রতিদান? পত্রিকায় এরকম খবর চোখে পড়ে আর মনটা বিষিয়ে উঠে। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেরা জীব হিসেবে। তার এই নমুনা? পত্রিকায় খবর দেখলাম দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে। জায়গায় জায়গায় তাই এত এত রিহাবিলিটেশন সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল। সর্বত্র চাপ, পরিবারের, সমাজের, লেখাপড়ার , পেশাপ্রাপ্তির, পেশা টিকিয়ে রাখার। আরো রয়েছে উন্নতির চাপ। পশ্চাতে পড়ে যাবার চাপ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চাপ। প্রেম-ভালোবাসার চাপ আর সেটা টিকিয়ে রাখার চাপ। আরো আছে বিধ্বংসী ব্রেক আপের চাপ।

    আমি নিজেই এই কয়দিন চাপের মধ্যে ছিলাম। ঢাকা থেকে হেড অফিসের লোকজন প্রকল্প ভিজিট করে গেছেন। সাথে সাইট সিয়িংও। কাজের অগ্রগতিতে তারা সন্তুষ্ট। আপ্যায়ন ও তদারকিতেও। এতে কার কি লাভ হয়েছে জানিনা। আমার পারফম্যান্সে সন্তুষ্ট ভিজিটিং টীমের রিকমেন্ডেশন আমাকে প্রকল্প মেয়াদ পূর্তি পর্যন্ত এখানেই যেন রেখে দেওয়া হয়।

    জামান ভাই বললেন আর হাসলেন। বললাম, “ভাই হাসছেন? এ মুহুর্তে আমার ঢাকা যাওয়া কত জরুরি তা আর কেউ জানুক আর না জানুক আপনি তো জানেন”। জামান ভাই মজা নিলেন। বললেন, “টেক ইট এজ ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট। ডোন্ট বি সো ডিসহার্টেন্ড”। জামান ভাই ভরসা। তাই চুপ করে গেলাম। মানুষের মন বড় নাজুক। একটুকুতেই উৎফুল্ল হয়, আবার বিপরীতে বিষাদে মুষড়ে পড়ে। বিষন্নতা আমাকে পেয়ে বসেছে। বন্যেরা বনে সুন্দর, আমি ঢাকায়।

    বাসার সব কিছু ‘টু বি কনটিনিয়ুড’ স্টাইলে চলছে। সেলিম এখন মলিকে নিয়ে হাওয়া খেতে বাইরে যায়। কফি শপে বসে। মার্কেটে টুকটাক কেনাকাটা করে। টাকার যোগানদার ওয়ান এন্ড অনলি মলি। আম্মা মন্দের ভালো হিসেবে শান্তিতে আছে। কিন্তু অজানা আতংকে আতংকিতও থাকে। আত্মীয়স্বজন বাড়ী বয়ে এসে তথ্য নিয়ে যায় সেলিম কিছু করে কিনা? তাদের মূল উদ্দেশ্য তথ্য কনফার্ম করা আর মনে মনে লাইভ সার্কাস দেখার মজা নেওয়া। শরাফত চাচা আবার এসে হাজির। এসেই ঘোষণা দিয়েছেন বেশিদিন থাকবেন না। বিশেষ কাজে এসেছেন। কাজ শেষেই চলে যাবেন। আসার সময় ক্ষেতের কিছু সব্জী আর ফল-মূল নিয়ে এসেছেন। তার এবারের মিশন হলো আবহাওয়া দপ্তরে চাকরির তদবির। ছোট মামা সরকারি চাকরি করেন। তাঁকে দিয়ে তদবির করাবেন। খবর পেয়েছেন পিওন পদে নিয়োগে পাঁচ-ছয় লাখ লাগে। তাই এসেছেন। টাকা কোন সমস্যা না। খালি নিশ্চয়তা দরকার। আম্মা বিরক্ত। ছোট মামা নিরিবিলি টাইপের মানুষ। তিনি এই ধরণের তদবির করবেন না। শরাফত চাচা উপায়ন্তর না দেখে আমাকে ফোন দিলেন।

    আমি বললাম, “চাচা, আপনি এই বয়সে এগুলো নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেন কেন”?
    — বাবাজী, গ্রামে থাকলে একে অপরের সুখ-দুঃখ দেখন লাগে।
    — যার তদবিরে এসেছেন সে কি আপনার আত্মীয়?
    — না, না। গ্রাম সম্পর্কে ভাই। তার ছেলের।
    — আজকাল চাকরি কত কঠিন, জানেন?
    — কঠিন আবার সহজও
    — কেমনে?
    — এই ধরো টাকা হলেই সব সহজ
    — টাকা কে নেয়?
    — কে নেয়না বাবাজী? টপ টু বটম
    — এখন কি করবেন? ছোট মামা এগুলোতে ইনভলভ হবে না। তাছাড়া আপনার ইন্টারেস্ট কি?
    — জসীম মিয়ার পোলার চাকরি হইলে হের ক্ষেতটা আমার কাছে বেচবো”।

    তাঁকে নরম গরম বুঝিয়ে বাড়ী চলে যেতে বললাম। তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। ভাবটা এমন যে সহজ কাজটা করে দিলাম না। সেলিমকে বাসায় দেখে তার হাজারো প্রশ্ন। তার প্রথম কৌতুহল, সে কি করে? চাকরি না ব্যবসা। সেলিমও কম না। বলেছে আউটসোর্সিং। শরাফত চাচা তা শুনে অবাক। সেলিম প্রথমে হোমিওপ্যাথিক ডোজ দিয়ে এর ব্যাখ্যা শুরু করলো। শরাফত চাচার কানের পাশ দিয়ে তা চলে গেলো। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। হা করে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর তাকে দেওয়া হলো আয়ুর্বেদি ডোজ। এবারও কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে বিষয়টা যে নতুন এটুকু বুঝতে পেরেছেন। এরপর দেওয়া হলো এলোপ্যাথি ডোজ। এবার তার কাছে বিষয়টা আগের চেয়ে ক্লিয়ার। তিনি এতটুকু বুঝতে পেরেছেন যে, এটা নতুন ধরণের ব্যবসা। মেলা টাকার ব্যাপার। তার লোভাতুর চোখ জিজ্ঞাসু হয়ে উঠে। কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে বললেন, “বাবাজী, কিরকম টাকা লাগে এতে”? সেলিম আরো আকর্ষণীয় করে উত্তর দিলো, “টাকা তেমন লাগে না বললেই চলে। টাকাই বরং হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। শুধু কায়দা মত ধরতে জানলেই হয়”। শরাফত চাচা এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। অযথা সময় ক্ষেপন করার মানুষ তিনি না।। তিনি বিদায় হলেন। কিন্তু বলে গেলেন, বিষয়টা তার মনে ধরেছে। তার এক ভাতিজা কম্পিউটার ভালো জানে। তাকে নিয়ে আবার আসবেন। সেলিম এগুলো বলে আর হাসে। আপদ তাড়াতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা আর কি।

    এই কয়দিনে শৈলী অসংখ্যবার ফোন করেছে। বেশিরভাগই ধরিনি। কিছু কেটে দিয়েছি। ব্যস্ত বলে কিছু সংক্ষিপ্ত উত্তরে সেরেছি। আর বাকী গুলো নেটওয়ার্ক পুওরের কারণে সম্ভব হয়নি। খাগড়াছড়িতে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুবই পুওর। একটু ভেতরে গেলে পাওয়াই যায় না। ডাটাও খুব স্লো চলে। এত কিছুর মধ্যেও ইন্টেরেস্টিং হলো শৈলীর ম্যাসেজ, “আম্মু বলেছে আপনাকে আংকেল বলে ডাকতে”। এটা যে আমাকে ক্ষেপানোর জন্য তা বুঝতে পারি। আমিও পাল্টা বার্তা দিলাম, “তাহলে এখন থেকে তোমার আব্বা-আম্মাকে ভাই-ভাবী বলে ডাকবো”। এরপর আর ম্যাসেজ আসেনি। এখন হয়েছে অন্য বিপদ। ঢাকা টিম ফিরে যাওয়ার পর যতই ফোন দেই শৈলী আর রিসিভ করেনা। বেশি করলে মোবাইল অফ করে রাখে। টেক্সট দিলে রিপ্লাই আসেনা। বালিকা মনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা ভালোই লাগে।

    বেশ চেষ্টা করে অবশেষে শৈলীকে ফোনে পাওয়া গেল। কেন এত চেষ্টা করলাম আমি নিজেও জানিনা। এটা কি নিছক ছাত্র-টিউটর এর দায়? নাকি অন্য কিছু। ফোন ধরেই বললো, “ হঠাৎ”?
    — স্যরি, ব্যস্ত ছিলাম।
    — আমিও।
    — মানে?
    — ড্রিম কামস ট্রু
    — মানে?
    — বুয়েটে হয়ে গেছে।
    — কনগ্রেচুলেশন্স
    — লাগবেনা। বলেই ফোন রেখে দিলো। আমি হতকচিত ও লজ্জিত। এই কয়দিন দুনিয়াদারির কোন খবরই আমি রাখিনি। বুঝলাম বালিকার দিলে চোট লেগেছে প্রচন্ড। কতক্ষণ পরে আবার ফোন দিলো, “আপনার কাজিন ফারিয়া আর ক্লাস মেট মুমুর খবর ভালো”? আমি বিস্মিত। বললাম, “তাদের প্রসঙ্গ এলো কেন”?
    — তাদের খবর তো ঠিকই রাখেন
    — মোটেই না। তাছাড়া ওরা আমার সমবয়ষ্ক। তোমার অনেক সিনিয়র। আমি ক্ষেপানোর জন্য মোক্ষম অস্ত্র ছুঁড়ে দিলাম।
    — তাদের নিয়েই থাকেন। আমি তো জুনিয়র
    — জুনিয়রই তো। বলামাত্রই ফোন কেটে দিলো।

    এই সময় জেমির সরব উপস্থিতির খুব প্রয়োজন। মানুষের মন শূন্যতায় ভেসে বেড়ায়। দমকা হাওয়ায় এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে চলে যায়। কখন কোথায় গিয়ে থিতু হয় তা সে নিজেই বুঝেনা। শুক্রবার বা’দ এশার বয়ানে হুজুরের কথাগুলো খুব কানে বাজছে। সমাজে অস্থিরতার সাথে সাথে ব্যাভিচার বাড়ছে। ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশা, বেপর্দা চলাফেরা, পরকীয়া আর জেনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ছে অবিশ্বাস। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে বাড়ছে ডিভোর্স। যে কাজ শরিয়াহ অনুমোদিত নয় সে কাজের প্রচার, প্রসার, পৃষ্ঠপোষকতা, উৎসাহ আর সায় দেওয়াও গুনাহের। তালাক শরিয়াহ সম্মত একটি বিধান। কিন্তু আল্লাহতায়ালার কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয়। তালাকে ইন্ধন দান সমপর্যায়ের অপরাধ, নাপছন্দ কাজ। কথাগুলো বুকে ধাক্কা মারলো। মননে মগজে অনুরণন তুলতে থাকলো। জেমি বিবাহিতা জেনেও তার সাথে সম্পর্কে জড়ানো কি সমপর্যায়ের অপরাধ? এর দ্বারা কি জেমিকে প্ররোচিত করা হচ্ছে? জেমির এই স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা কি সংশয়ের নাকি মুক্তির প্রচেষ্টা? এসব প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক , হাজারো যুক্তি মনকে জেমিতেই মোহাবিষ্ট করে রাখে।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৪)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৪)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৪)
    বাসার অবস্থা অপরিবর্তিত। শান্ত। মলির কোন উদ্বেগ নেই। আম্মাও স্বস্তিতে আছে। তবে এর ভবিষ্যৎ কি কেউ জানেনা। যাকে নিয়ে এই উদ্বিগ্নতা আর পেরেশানি সেই সেলিম নির্বিকার। দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুরছে-ফিরছে। তার তরফ থেকে নতুন কোন প্রপোজাল নেই। মলিও কিছু বলেনা। পাছে সেলিম বাগড়া দিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বড় মামাকে সেলিমের বিষয়ে কিছু বলা যায় না। প্রসঙ্গ তুল্লেই বলেন, “ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। মুদির দোকানও চালাতে পারবে না”। সমস্যা হলো সেলিম নিজেই। তার মিশন, ভিশন অনেক উঁচু। প্রচুর টাকা থাকবে, গাড়ী-বাড়ী থাকবে। সফিসটিকেড বিজনেস থাকবে। সব কিছু টিপটপ হবে। অফিস হবে ওয়েল ডেকোরেটেড। থাকবে মৌ মৌ ফ্রেগরেন্স। কর্মচারীর সংখ্যা যতজনই হোক তারা হবে স্যুটেড-বুটেড। আরো কত কি! স্বপ্ন দেখতে সবারই ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই পার্থক্যটুকুই বুঝতে পারছে না সে। মন্দের ভালো হিসেবে সবাই তার এই স্থিতাবস্থা মেনে নিয়েছে। আর কিছু না হোক নতুন করে তো আর কোন ঝামেলার সৃষ্টি হচ্ছে না। ছোট মামার সাথে সব শেয়ার করা যায়। তিনিও চিন্তিত। এখনই একটা কিছু করা জরুরি তিনিও বুঝেন। বললাম, “মামা, ভালো কোন কিছুর ফ্রেঞ্চাইজ খুলে দিলে হয়না”? মামা সায় দিলেন। কিন্তু সেটা কি? এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। মলিকে বললাম। বললো, “আপাতত এভাবেই থাক। আগে মাথা থেকে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার পোকা বেরোক। তারপর একটা কিছু করা যাবে”। কথাটা নেহায়েত মন্দ বলেনি। উদ্ধারকৃত টাকাগুলো মলির একাউন্টে জমা আছে। অতএব টেনশন কম।

    আমরা মেয়েদেরকে যতই কমজোরি মনে করি তারা ততোটা না। বিশেষত সাংসারিক বুদ্ধিতে তাদের সুক্ষ্মদর্শী বিচার বিশ্লেষণ যাদবের পাটিগণিতের চেয়েও সমৃদ্ধ। আম্মা হাসে। বলে, দু’জনে বসে বসে লুডু খেলে। বুয়া দেখে আর হাসে। আর আম্মার কাছে এসে ধারা বর্ণনা দেয়। কিছুই করার নেই।

    শৈলী রোজ রাতে ফোন দেয়। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। নাছোড়বান্দা। আমি তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার জন্য বলি, “তোমার বয়স কত”?
    — কেন?
    — এই বয়সটা খুব ইম্পোর্টেন্ট। লাইফের টার্নিং পয়েন্ট
    — জ্ঞান দিচ্ছেন?
    — ধরো তাই
    — আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। জ্ঞানে আমি এত বেশি জ্ঞানিত হয়ে গেছি যে ভার রাখতে পারছিনা
    — বুয়েটে ভর্তির জন্য কিন্তু পড়াশোনা করতে হয় প্রচুর
    — মনে হয়না
    — কেন?
    — আপনাকে দেখে তাই মনে হলো
    — আমার জ্ঞান নেই?
    — ওটুকু ছাড়া আর কিছু নেই
    — আগে ওটুকুই অর্জন করো। চেহারা ছবি ভাল আছে। খুব সহজেই পার হয়ে যাবে
    — আপনার হিংসে হচ্ছে?
    — বারে। হিংসে হবে কেন? তুমি তো আমার অনেক জুনিয়র
    — এতদিন বসে বসে হায়ার ম্যাথ ঘেটে এই সমাধান বের করেছেন?
    — ইনফেচুয়েশন কি জিনিস বুঝো?
    — আপনি কি আমাকে সে পর্যায়ে জ্ঞান করেন?
    — বুয়েটে ভর্তি হও। প্রচুর ছেলে বন্ধু ঘুরঘুর করবে। যোগ্য সাথী পেয়ে যাবে। তখন এসব ইনফেচুয়েশন নিয়ে মনে মনে হাসবা
    — ভালই তো হবে। আপনি তখন জ্বলতে থাকবেন। আপনাকে পিক শেয়ার করবো।

    শৈলীর একটা জিনিস তারিফ না করে উপায় নেই। তার মেধা শক্তি প্রখর। সেন্স অফ আর্টিকুলেশন হাই। এর সাথে লাবণ্যতা আর মাধুর্যতা অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে। তার আরেকটি গুণ হলো সম্মোহন শক্তি। আমি ক্রমশঃ পর্যুদস্ত হয়ে যাচ্ছি তার কাছে। আর তখনই জেমির উপর সাংঘাতিক রাগ হয়। অভিমান হয়। জেমি কি তা বুঝে? মাঝে মাঝে মনে হয় আমার এ অতি আবেগ এক পাক্ষিক। এটা যেন আলো অভিমুখী পতঙ্গের এক ধরণের ‘আত্মহনন পথযাত্রা’।

    খাগড়াছড়ি আর ভাল লাগছে না। দেখতে দেখতে ছয় মাস হয়ে গেলো। বিষন্নতা আর নিঃসঙ্গতা পাহাড়ের নিসর্গকে ছাপিয়ে দম বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। চাকরির এই জীবন আমার লক্ষ্যের মধ্যে ছিলো না। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ঘরের ছেলেদের জীবনের ক্যালকুলেশনের ভেতর থাকে অনেক অনেক ডিপেন্ডেবল ভেরিয়েবল্স। এর মধ্যে অন্যতম হলো পরিবারের সেট রুলস। সেলিমের মনের অভিলাষে উচ্চাকাংখা থাকতে পারে, সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে ফারাক থাকতে পারে কিন্তু এটাও তো ঠিক সবাই এক পথে হাঁটে না। এক বেগে চলে না। এক বৃত্তে ঘুরেনা। কেউ কেউ বৃত্তের বাইরে গিয়ে স্বপ্নের সম্মিলন ঘটাতে চায়। কেউ কেউ জীবনটাকে গতানুগতিকের বাইরে আলাদা ফ্লেভারে উপভোগ করতে চায়। সংসার সাফল্যের মাপকাঠিতে সব কিছু মাপে। যার পায়ের তলার মাটি যত মজবুত, যার দৌড়ের পরিধি যত ব্যাপক, যার বিত্ত-বৈভবের ব্যালান্স যত বেশি অনুকূল সংসারে সে তত সফল।
    মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছে। এখানে বেশিদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবো নির্ঘাত। এখানে যারা সহকর্মী তাদের জীবনের লক্ষ্যই হলো চাকরি, প্রচুর ক্যাশ আর সুন্দরী বৌ। এই নিয়েই তাদের স্বপ্নের দৌড়। তাই তাদের কোন খেদ নেই। কোন টানাপোড়েন নেই। মাথায় কোন পোকা নেই। সংসারে এরাই গুড বয়।

    পাহাড়ে যারা চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে বসবাস করে তাদের স্বজন ও সুজন ভাগ্য খুব ভালো। সবাই এই সম্পর্ক ধরে পাহাড়ে ফ্যামিলি ট্যুর দিয়ে যায়। ভালোই লাগে। ঢাকায় থেকেও যাদের সাথে বছরে দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাদের সাথেও এখানে আনন্দে কেটে যায় কয়েকদিন। আমি সরকারি চাকুরে না। তাই প্রটোকলের পেরেশানি নেই।। বরং পরিচিত, আপনজন কেউ না এলে পানসে লাগে। ভাবছি আম্মাকে আর মলিকে আসতে বলবো।
    একঘেয়েমি আর নিঃসঙ্গতার মাঝে একমাত্র বৈচিত্র্য হলো শৈলীর ফোন। খেয়ালী মন। যখন তখন ফোন দিয়ে বসে। হয়ত আমাকে রাগাবার জন্যই। নিষেধ করলেও কে শোনে কার কথা? এই একটু আগেই ফোন করে বললো, “আপনি তো আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেন নি এখনো। অন্য মেয়ে হলে তো ঠিকই সময় নিতেন না”। ভুলেই গিয়েছিলাম। মাত্রই মনে পড়লো। বললাম, “বাজে কথা। আমার লিস্টে বালিকা কম”।
    — কম মানে? যা আছে তা স্পেশাল?
    — আরে না। কথা খালি টেনে অন্যদিকে নিয়ে যাও
    — ক্ষতি কি? পুরুষ মানুষের চরিত্র জানা আছে
    — কি রকম? একাধিক অপশন রাখে
    — আমার সেরকম কেউ নেই
    — গুড। ঢাকায় আসবেন কবে?
    — জানিনা। কেন?
    — সামনে পরীক্ষা। কিছু হেল্প হত।

    কথা কিন্তু এখানেই শেষ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার ফোন, “ভালো কথা। এবার দেখলাম আপনি নামাযী হয়েছেন। ছ্যাকা খেয়েছেন নাকি”? বললাম, “কিসের সাথে কিসের তুলনা দিলা”? কথা না বাড়িয়ে রেখে দিলো। বিচলিত হলেও ওর ফোন ভাল লাগে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করে হয়েছে আরেক বিপদ। প্রোফাইল চষে বের করেছে দু’টি নাম। ফারিয়া আর মুমু। এই নিয়ে হাজারো জেরা। জেরা মানে আমার মাথা নষ্ট করা। ফারিয়া আমার কাজিন। যেইনা বলেছি অমনি হাজারো সম্পূরক প্রশ্নের মুখে পড়লাম। আর মুমু আমার ক্লাসমেট। থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। পি এইচ ডি করছে। আর ফিরবে না। জেরার মুখে যেই বলেছি এখনো আনম্যারিড অমনি ধরেই নিয়েছে আমি আসলে বিদেশ পাড়ি দেবো। কোভিডের কারণে সময়ক্ষেপণ করছি আরকি। বুঝতে পারছি বালিকাদের সব কিছু সহজ ভাবে নিতে নেই। এর সুদুরপ্রসারি সাইড ইফেক্ট কি কি হতে পারে তাও ভেবে দেখা জরুরি। আমিও উল্টো প্যাচ দিয়ে বললাম, “এই যে তুমি খামোখা আজেবাজে চিন্তা করছো, এখন তোমাকে আমার লিস্টে দেখে যদি ওরা এরকম জেরা করে”? প্রশ্ন করে বোকা হয়ে গেলাম। ভাবতেও পারিনি এটা এভাবে ব্যাক ফায়ার করবে। শৈলী ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, “এই তো থলের বিড়াল বেড়িয়ে এলো। আমার নাম দেখে ওদের জ্বলবে কেন? তার মানে কুচ কুচ হোতা হ্যায়”।
    — দূর। মহা বিপদে পড়লাম তো
    — বিপদে আপনি পড়বেন কেন? পড়েছি তো আমি
    — কেমনে?
    — “জানিনা” বলে লাইন কেটে দিলো।

    এ যাত্রা বাঁচা গেলো মনে করে হাফ ছাড়ার আগেই আবার ফোন, “ভালো কথা, আপনি কিন্তু আমার সেই প্রশ্নের কোন উত্তর দেন নি”।
    — কোন প্রশ্ন?
    — আপনাকে কি এড্রেস করবো?
    — বলেছি তো। আমি জানিনা
    — তাহলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করি?
    — করো। চুল ছিড়ে দেবে
    — জ্বী না। আম্মু এখন আমার ভক্ত।
    — এত ডেভেলপমেন্ট?
    — হুম্ম। আগে বুয়েটে ভর্তি হয়ে নেই। দেখবেন মজা।
    — কিরকম?
    — লেট টাইম কাম। বা’বাই।

    হেড অফিস থেকে লোকজন আসবে প্রকল্প পরিদর্শনে। জামান ভাই জানালেন, এর উপর নির্ভর করছে নিকট ভবিষ্যতে আমার ঢাকায় ট্রান্সফার। বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় সহকর্মীদের নিয়ে লেগে গেলাম কাজে। প্রকল্পের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন বাড়িয়ে দিলাম। আর আপডেটেশন ও ডকুমেন্টেশনের কাজে লেগে গেলাম। সময় খুব কম। অনেক রাত অবধি কাজ করতে হয়। সাথে যোগ হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাইট ভিজিট। জামান ভাই আমাকে এর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এটা তারও ইজ্জত কা সাওয়াল। আমারও। শৈলীর ফোন আর সেভাবে রিসিভ করা হয়না। ঘটনা বলে যখন তখন ফোন দিতে নিষেধও করেছি। পারতপক্ষে এই তিন চারদিন যেন ফোন না দেয়। কিন্তু কে শুনে কার কথা? বাধ্য হয়ে কেটে দিতে হচ্ছে। জানি এর সুদূরপ্রসারী ভোগান্তি পোহাতে হবে।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৩)
    শৈলীরা এলো। রেস্ট হাউসে পৌছে ফোনও দিলো। আমিও গিয়ে দর্শন দিলাম। তার চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস আর চোরা দুষ্টুমি। শৈলীর বাবা অমায়িক মানুষ। ভদ্রলোককে এর আগে মাত্র একবার তাদের বাসায় দেখেছিলাম। কথা হয়নি। সে তুলনায় শৈলীর আম্মা এখনো ভাব-গম্ভীর। বিদেশ বিভুঁইয়ে পরিচিত কাউকে পেলে যেমন বোধ হয় এর চেয়ে তার অভিব্যাক্তিতে বিশেষ ব্যাতিক্রম কিছু অনুধাবন করতে পারলাম না । অবশ্য এটা সত্য যে, টিন এজ মেয়ে থাকলে কোন মা-ই কোন তরুণকে সহজ চোখে দেখতে পারেনা। আমার এসব গা সহা হয়ে গেছে। চা-নাস্তা সেরে তারা বেরিয়ে পড়বে। আমি অফিসের দোহাই পাড়লাম। শৈলীর মুখ কাল্সে হয়ে গেল। চোখ দিয়ে আগুন ঠিক্রে বেরোচ্ছে। কায়দা মত পেলে আমাকে ভস্মীভূত করে দেবে এমন ভাব। শৈলীর আব্বা কথা কম বলেন। শুধু বললেন, “অফিসের কাজ হ্যাম্পার করে আমি যেতে বলবো না। যদি যেতে পারো উই উইল বি রাদার হ্যাপী”। শৈলীর আম্মা কোন কথা বললেন না। শৈলী তাঁকে প্রেসারাইজ করছে, “আম্মু, তুমি বললেই স্যার যাবে। বলো না”। যাহোক, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি যাইনি। সিদ্ধান্ত হলো কাল সকালে সাজেক ভ্রমণে আমি তাদের সাথে যাবো। এই নিয়ে শৈলীর সে কি রাগ!

    রাতে ওদের সাথে আবার দেখা। স্থানীয় রেস্তোরাঁয় শৈলীর ভালো রেজাল্টের জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুত ট্রিটের ব্যবস্থা করলাম। শৈলীর আব্বা খুব উঁচু মাপের মানুষ। পড়াশোনা অগাধ। আলাপ করলেই বুঝা যায়। আমাদের আলাপের মাঝে শৈলী যেন প্রাণের স্পন্দন। শৈলীর আম্মাও গাম্ভীর্যের খোলস আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছেন। বাসার খোঁজখবর নিলেন। ঢাকায় গেলে বাসায় যেতে বললেন। আরো বললেন, “শৈলীর খুব ইচ্ছে বুয়েটে পড়বে। আর্কিটেক্ট হবে। সারাদিন আঁকা জোকা করে। জানিনা কি হয় শেষমেশ”? সুযোগ পেয়ে আলাপ জমাতে বললাম, “আন্টি, চিন্তা করবেন না। শৈলী খুব ভাল স্টুডেন্ট। রেজাল্ট ভালো। ড্রয়িং আর ডিজাইন সেন্সও খুব ভালো। হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ”। শৈলী পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সব উপভোগ করছে।

    আমাদের সাজেক যাত্রার শুরুতেই খানিকটা বিপর্যয় হলো। যে গাড়ী উন্নয়ন বোর্ড থেকে দেওয়া হয়েছে সেটাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। মবিল পড়ে যাচ্ছে। কোনক্রমেই বন্ধ করা যাচ্ছেনা। সেটা পাল্টে আরেকটা আসতে বিলম্ব হলো। প্রায় চার ঘন্টা লেগে গেলো সাজেক যেতে। পথে কয়েক জায়গায় নেমে ঘুরাঘুরি আর ফটো স্যুট। হেলিপ্যাডে পৌছামাত্র আচমকা কোথা থেকে এক রাশ ভারী মেঘ বৃষ্টি বয়ে নিয়ে এলো। তাতে আমাদের পরিধেয় কাপড় বেশ খানিকটা ভিজে গেলেও এই দুর্লভ প্রাপ্তিতে আমার আর শৈলীর খুব মজা হলো। শৈলীর আব্বা বললেন, “এই মেঘ, এই বারিষ আল্লাহর রহমত আমাদের জন্য। ঠান্ডা লেগে না গেলেই হয়”। তাঁর মুখে ‘বারিষ’ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর লাগলো। আন্টি ব্যাপারটাকে ট্যুরিস্ট ম্যুডেই নিলেন। সব মিলিয়ে খুব ভাল লাগলো। এর আগে জামান ভাই ও অন্য কলিগরা সহ এসেছিলাম। তখন মেঘ, বৃষ্টির এমন রোমান্স দেখিনি। শৈলীর স্ফুর্তি অপরিসীম। সে কি থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুপুরে সেনাবাহিনীর রেস্টহাউজ কাম রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ হলো। ফেরার আগে আবারো এদিক সেদিক ঘোরাফেরা। এবার আর আংকেল-আন্টি সাথে এলেন না। শৈলীকে এভাবে ছেড়ে দেবেন ভাবতেও পারিনি। আমি নির্লিপ্ত ভাব দেখালেও শৈলীর আনন্দ দেখে কে? হাঁটতে হাঁটতে বললো, “জায়গাটা এত্ত সুন্দর কল্পনাও করা যায় না”। আমি কথার পৃষ্ঠে কথা যোগ করলাম, “আজ তোমাদের লাকটাই ভালো”।
    — যেমন? শৈলীর ঝটপট প্রশ্ন।
    — এই আসা মাত্রই এক খন্ড মেঘ আর এক রাশ বৃষ্টির খেলা হয়ে গেলো
    — হুম্ম। আপনার ভালো লাগেনি?
    — হুম্ম। খুউব। এর আগে যেদিন এসেছিলাম সেদিন মেঘ থাকলেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি
    — দেখলেন তো আমি এলাম আর মেঘ-বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিয়ে গেলাম
    — তোমার আব্বা- আম্মাও বেশ এনজয় করেছেন। আন্টি তো আজ বেশ ইজি হয়ে গেছেন
    — আরো হবে। জাস্ট কীপ ওয়াচিং।

    এর দ্বারা কি বুঝালো বুঝিনি। ব্যাখ্যা দাবী করে সামনাসামনি লজ্জা পাওয়ার মত বোকামীর কোন অর্থ হয়না। বললাম, “এখন যেতে হবে”। “দূর ছাই, কেন যে সময় এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়”? আমি বললাম,“নেক্সট টাইম এলে এখানে এক রাত থেকো। সান রাইজ আর সান সেট নাকি অপূর্ব দেখায়”। “আপনি থাকলে আবার আসবো” শৈলীর উত্তর। এবারের দেখায় শৈলীকে প্যারাগন বিউটি বলে মনে হলো। এমনিতেই সে চোখে পড়ার মত সুন্দরী। বললাম, “আন্টি তোমাকে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকেন”।
    — কেন? শৈলীর কৌতুহল।
    — তুমি খুব সুন্দর, তাই
    — সত্যি বলছেন?
    — আমার বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখানকার সব ছেলেই তোমাকে হা করে দেখছে
    — আপনিও দেখেন?
    — কি বলছো? তোমার সাথে কি আমার সে সম্পর্ক?
    — তাহলে কি সম্পর্ক?
    — জানিনা।
    — এই তো ভাববাচ্যে চলে গেলেন। আমি কিন্তু আপনাকে আর স্যার টার বলতে পারবো না।
    — কে বলেছে বলতে?
    — তাহলে কি বলবো?
    — আমি কি জানি?
    — তাহলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করবো কি বলবো? আর বলবো আপনি স্যার বলতে মানা করেছেন। এই বলে সে চক্ষু কুঞ্চিত করে দুষ্টু হাসিতে আরো অপূর্বা হয়ে উঠলো। লজ্জায় আমি লা জবাব। টিন এজ বালিকাদের একটু গুরুত্ব দিলেই হয়েছে। কি থেকে কি করবে, কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কেউ জানেনা।

    শৈলীকে পেয়ে জেমিকে ভুলে যাই নি। তবে প্রচন্ড জেদ জমে আছে জেমির উপর। এটা কোনক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না যে প্রযুক্তির এ যুগে একটিবারের জন্যও যোগাযোগ করা যায়না। ভাবনাতে ছেদ ঘটিয়ে শৈলী আচমকা প্রশ্ন করে, “একটা প্রশ্ন করবো? একান্ত ব্যাক্তিগত”।
    — করো
    — ডু ইউ হেভ এনি ফেসিনেশন টু এনি ওয়ান?
    — মানে?
    — মানে মানে করবেন না। আপনি ঠিকই বুঝেছেন হোয়াট আই ওয়ানা নো
    — ডু ইউ হেভ এনি? আমার পাল্টা প্রশ্ন।
    — ইয়েস আই ডু। বাট হু কেয়ারস?
    — লিভ ইট
    দেখলাম শৈলীর মুখাবয়ব জুড়ে হতাশার কালো মেঘ নেমে এলো। ম্যুড অফ হয়ে গেলো। আমরা খাগড়াছড়ির পথে অগ্রসর হলাম।

    রাতের ডিনার রেস্ট হাউসেই হলো। খাওয়ার পর শৈলী হাঁটবে। আংকেল-আন্টি খানিকটা সঙ্গ দিলেন। শৈলী ‘ওয়াকিং ফর ডায়েটিং’ এর মত দ্রুত লয়ে হাঁটছে। সাথে আমি। নীচে কালচে পাহাড়ের খাদ। সাথে এক দঙ্গল গাছপালা। দূরে খাগড়াছড়ি শহর। লাল-নীল বাতির ঝিলিক। রাতের পাখীদের ডাক শোনা যাচ্ছে। তক্ষকের ডাক ভীতি ধরালো। শৈলী পারলে আমাকে জাপটে ধরে। আমি বললাম, “সো ফার সো গুড। লেটস টেক এ ইউ টার্ন”। তাদেরকে উপরে উঠিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে মোবাইলে নিউজ ফিড দেখছিলাম। শৈলীর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। সাথে ফোন, “কাল আমরা আলুটিলা কেভ দেখতে যাবো”
    — আংকেল-আন্টিও যাবেন?
    — উনারা না গেলে আপনার সুবিধে হয়?
    — না, তা কেন হবে? ওখানে যেতে হলে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে উঠতে হবে।
    — আপনি নামতে পারবেন কিনা তাই বলেন
    –পারবোনা কেন?
    — আপনি যে ভীতুর ডিম। এজন্যই আপনার কিছু নেই
    — কিভাবে বুঝলা?
    — মেয়েরা সব বুঝে।
    — তাই?
    — হুম্ম।
    — আচ্ছা থাকো তুমি তোমার বুঝাবুঝি নিয়ে। আমি এখন ঘুমাবো
    — জ্বী না। আজ রাতে আর ঘুমুতে দিচ্ছিনা আপনাকে।

    শৈলীর সাথে এ কথা সে কথায় অনেক রাত হয়ে গেছে। সকালে উঠতে তাই দেরি হয়ে গেল। আলুটিলার কাহিনী অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগেরবার এলেও আমি কেভ দেখতে নামিনি। সেখানে যেতে হলে কিছু প্রস্তুতি লাগে। আমাদের সেগুলো ছিলো না। হাতে সময়ও ছিলো না। এবার অন্তত পায়ে কেডস আর পড়নে ট্র্যাক স্যুট আছে। শৈলীরও। এ সাজে তাকে দেখবো ভাবিনি। আসলে কিছু মেয়ে আছে যাদেরকে আটপৌরে কাপড়েও মেনকা লাগে। শৈলীও তাই। মশাল হাতে কেভ এর ভেতর অগ্রসর হচ্ছি অন্যদেরকে অনুসরণ করে। শৈলী এক হাতে আমার এক হাত ধরে রেখেছে। নীচে ছড়ার পানি। তার নীচে বিভিন্ন সাইজের পাথর। হঠাৎই স্লিপ কেটে ভারসাম্যহীন হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি অপ্রস্তুত। বললাম, “আমি না ধরলে তো চিৎপটাং খেতা”। “ জ্বী না। এত বাহাদুরী নিয়েন না। আমি তো ইচ্ছে করেই ওটা করেছি। আপনি বুদ্ধু। বুঝতে পারেন নি” বলে সে কি হাসি শৈলীর! আমি আরেকবার লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেলাম।

    শৈলীদেরকে বিদায় দিতে সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কারণ কি? অনেক চিন্তা করেছি। কিছু উত্তরও দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু যুতসই হয়ে উঠেনি কোনটাই। তবে কি শৈলীর ‘স্মৃতি ছাপ’ হৃদয়ের প্যান্ডুলামে দোলা দিয়ে গেলো?

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১২)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১২)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১২)
    জামান ভাইয়ের এখন রমরমা অবস্থা। হেড অফিসে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এরিমধ্যে বিদেশেও ঘুরে এসেছেন। আরেকটি প্রকল্পের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাক্তির দায়িত্বও পেতে যাচ্ছেন। বললাম, “ভাই বিয়ে করে ফেলেন এখন”। তিনি হাসলেন। বললেন, “দেখা যাক”। তার এই ‘দেখা যাক’ শব্দটা কানে বাজলো। বিয়ের বিষয়টি যিনি তার ডিকশনারী থেকে বাদ দিয়ে ফেলেছিলেন তিনি এখন তা যুক্ত করতে চাচ্ছেন বলে মনে হলো। বললাম, “ভাই, পুরোনো বিষয়ে নতুন কোন ডেভেলপমেন্ট আছে কি”? হাসলেন। বললেন, “ওয়েট এন্ড সি”। আমি আগামাথা কিছু না বুঝেই তাকে অগ্রীম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। ঢাকায় যাওয়ার পর জীবন যাত্রায় কি-রুপ পরিবর্তন হয়েছে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, “গতি বেড়েছে। পলিউশন ডাইজেস্ট করতে হচ্ছে। আর কি যেন নেই বোধ হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে এরকম ছিলো না। একধরনের নির্জনতা ছিল। তবে ‘নেই নেই’ ক্ষেদ ছিলো না। যা ছিলো তা একান্ত ব্যক্তিগত শূন্যতা”।

    তার পর্যবেক্ষণ যথার্থ। নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত আমাদের কাছে পাহাড়, নদী, বন শ্বাস ফেলার উপযুক্ত জায়গা। চারিদিকের এই নিসর্গ আর এই পিন্ পতন নিরবতার মাঝেও পাখপাখালি আর ঝর্ণাধারার চাঞ্চল্য কাউকে বিরক্ত না করে মনোহারী রুপ নিয়ে বসে আছে। ভাল লাগে চুপ করে শুয়ে, বসে সময় কাটাতে, দৃষ্টি প্রসারিত করে চক্ষু শীতল করতে। হাঁটু জলে নেমেও ঝর্ণাধারায় অবগাহনে অশেষ তৃপ্তি বোধ হয়। চারিদিকের সুনির্মল বায়ু পাহাড়ের চূড়ায় ধাক্কা খেয়ে কোথা থেকে যেন একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে। তাতে প্রাণ জুড়ায়। মন হারায়। আবার কাউকে বিষন্নতা গ্রাস করে। পাহাড়ে, সমুদ্রে, বনে একাকী জীবনযাপনে, পরিভ্রমণে তুষ্টি মেলেনা। কেবলই মনে হয় ‘কি যেন নেই’, ‘কি যেন নেই’? জেমি নেই। নির্জনতার এই প্রহর তাই আর কাটেনা। প্রতিদিন একঘেয়েমিতে পেয়ে বসেছে। আর রাত হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

    রাতে যথারীতি শৈলীর ফোন, “স্যার, কি করছেন”?
    — কিছুনা। শুয়ে আছি
    — শুয়ে কি করছেন
    — আকাশের তারা দেখছি
    — তারার মধ্যে এত কি আছে দেখার?
    — কেন? অসুবিধে কি?
    — অসুবিধে কিছু নাই। তবে লক্ষ্মণ ভাল মনে হচ্ছেনা
    — কেন?
    — জিনিয়াস আর পাগলরাই তারা দেখে, গুনে, নিরীক্ষা করে
    — আমি পাগল না
    — তাই বলে জিনিয়াসও না
    — কথা প্যাচাচ্ছো। আসল কথা বলো। কেন ফোন দিয়েছো? কি যেন সারপ্রাইজ দিবে বলেছিলা
    — আমরা পরশু ভোরে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো
    — হঠাৎ? তাও আবার খাগড়াছড়ি?
    — বারে। আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে না। এরপর তো ভর্তি যুদ্ধ।
    — কোন হোটেলে বুকিং দিয়েছো?
    — হোটেল না। রেস্ট হাউস। আব্বুর এক পরিচিত উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। তাদের রেস্ট হাউসে।
    — ভাল
    — আপনি হবেন আমাদের গাইড
    — আমার অফিস আছে। তাছাড়া তোমার আম্মার সামনে আমি ইজি না
    — সেগুলো ফাইনাল হয়ে গেছে। সাজেক যাবো। আর কোথায় যাওয়া যায় আপনি ঠিক করে রাখবেন। আব্বুকে
    বলেছি। আব্বু রাজী।
    — আচ্ছা দেখা যাবে।
    — জ্বী, এবার আমার পাওনা আদায় করে ছাড়বো
    — মানে কি?
    — এলেই টের পাবেন
    — বাড়াবাড়ি দেখলে আমি থাকবোই না। ছুটি নিয়ে ঢাকা চলে যাবো
    — ভয় পেলেন? ভীতুর ডিম।

    এই একই কথা জেমিও বলতো। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ফোন রেখে দিলাম। আচ্ছা বিপদেই পরা গেল দেখছি।
    ঢাকা বাসার অবস্থা নরমাল। কারফিউট তুলে নেওয়া হয়েছে। সেলিম এখন ড্রয়িং আর ডাইনিং রুম অবধি বিচরণ করে। আম্মার সাথে বেশ কথাবার্তাও বলে। কফি বানিয়ে খাওয়ায়। মাঝে মধ্যে তার স্পেশাল রেসিপিও ট্রাই করে। আম্মার মতে ওর নাকি অনেক গুণ। আমি হাসি আর শংকিত হই এই ভেবে যে, আবার না গায়েব হয়ে যায়। বড় মামার উদ্যোগে স্থানীয় থানার সহায়তায় টাকা পয়সা দেনা-পাওনার বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। সাভারের দোকানের সালামী বাবদ দেওয়া টাকার সিংহ ভাগ ফেরত পাওয়া গেছে। বাকীটা আর পাওয়া যাবে না। থানার মামলায় দু’পক্ষের আপোষরফা হয়েছে। তবে আদালতের এখতিয়ার বিধায় সময় লাগছে এই যা। টাকা আদায়ে আমার চাচাত ভাইয়েরা পলিটিক্যালি দারুন ভূমিকা রেখেছে। আজকাল এই তরিকা খুব কার্যকর। সব শুনে খুব খুশি খুশি লাগছে। আম্মার চিন্তা তবু যায় না।

    সবার সবকিছুই গোছগাছ হয়ে যাচ্ছে। আমারই সব অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। জেমিকে খুব ফিল করছি। ফোন বন্ধ। একমাত্র উপায় ইলমা। আমার এই ছাত্রীটি কেন যে এত বৈরি হয়ে গেলো আজো বুঝে উঠতে পারিনি। একদিন রিক্সায় করে ঘুরতে নিয়ে যায়নি বলেই এত বৈরিতা? এত ছোট মেয়ে কখন যে ভেতরে ভেতরে এত ম্যাচিওরড হয়ে উঠেছে বুঝতে পারিনি। যা থাকে কপালে বলে ফোন দিলাম। রিং হলো। ইলমাই ধরলো, “কেমন আছেন”? প্রথমেই ‘স্যার’ শব্দটা উচ্চারিত না হওয়ায় মনটায় খট্কা বাধলো। বললাম, “কেমন আছো”?
    — যেমন রেখেছেন। ইলমার নৈর্ব্যক্তিক উত্তর।
    — বাসার সবাই ভাল?
    — স্পেসিফিক কার সম্মন্ধে জানতে চাচ্ছেন
    — এই ধরো সবাই। তোমার আব্বা-আম্মা
    — উনারা ভাল নেই
    — কেন?
    — তা আপনিই ভাল জানেন
    — মানে?
    — আম্মু আপনাকে ফোন দিতে নিষেধ করেছে না?
    — সে তো জেমিকে করতে নিষেধ করেছেন
    — বলেন কি জানতে চান?
    — তুমি ভাল আছো?
    — জ্বী। যদিও জানি সেটা আপনার উদ্দেশ্য না ।
    — তা না হলে ফোন দিলাম কেন?
    — আপুকে পাচ্ছেন না তাই। পেলে করতেন না
    — তাই?
    — অবশ্যই। আপু অসুস্থ। আন্ডার ট্রিটমেন্ট
    — কেন কি হয়েছে?
    — তাও আপনি ভাল জানেন। আর হ্যা, আপনাকে বলতে ভুলেই গেছি দুলাভাই দেশে এসেছেন। একটু সুস্থ হলেই
    আপুকে কানাডা নিয়ে যাবেন।
    — আচ্ছা।
    — আর ফোন না দিলেই খুশি হবো। আম্মু জানলে আমাকে ছাড়বেনা।

    মনটাকে আর কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছিনা। বুকের ঠিক মাঝখানে কাঁটা বিধার মত অনবরত খচ্ খচ্ করছে। জেমির উপর খুব রাগ হচ্ছে। একটি বারের জন্যও কি ফোন দেওয়া যায়না? অথবা ম্যাসেজ টেক্সট করা যায় না? নাকি কানাডার বাতাস তাকে দুলিয়ে দিয়েছে? জানিনা। এরকম ভাবতেও কষ্ট হয়। স্বস্তির কোন জায়গা নেই যেখানে গিয়ে হাল্কা হওয়া যায়।

    এশার নামায জামাতে আদায় শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসলাম। অপরাপর মুসুল্লীরাও গোল হয়ে বসেছে। স্বল্প বয়ান হবে। আজকের বয়ান আত্মহত্যা ও পরকীয়া নিয়ে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আবার শোনার আগ্রহও হচ্ছে। এক চিত্রনায়কের শ্বশুরের লাইভে এসে আত্মহত্যা প্রসঙ্গে বয়ান চলছে। হতাশা, অস্থিরতা, আস্থাহীনতা এবং ধর্ম ও ভাল মানুষের সহবতহীনতা থেকেই মানুষজন এ ধরণের চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ভদ্রলোকের কলেমার জ্ঞান ছিলো, আত্মহত্যা যে কবীরা গুনাহ তার জ্ঞানও ছিলো কিন্তু পরিণতি কত মর্মান্তিক। আখেরের ফয়সালা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। আত্মহত্যার আরেকটি কারণ হলো প্রেম, নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশা, ব্যাভিচার ও পরকীয়া। ইমাম সাহেব কোরআন, হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। সবই জানা কথা। তবু মানুষ ভুল করে। ভুল পথে আকৃষ্ট হয়। বয়ান শেষে হুজুরের কথা, “যুবক ভাই যারা আছেন, তাদেরকে বলি। কাউকে ভাল লাগলে শরিয়াহ্ মতে বিয়ে করে ফেলুন। শয়তানের ওয়াস্ ওয়াসায় পড়বেন না”। কথাগুলো শোনার সময় হুজুরের চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলাম। বয়ান শেষে সবাই সালাম বিনিময় আর মুসাফাহা করে যে যার মত চলে যাচ্ছে। আমিও এগিয়ে গিয়ে করলাম। হাত তালুবন্দী রেখে বললেন, “বাবাজী, এখন কেমন আছেন”? বললাম, “আলহাম্দুলিল্লাহ”। তিনি হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আর বলছেন, “আসেন। আল্লাহ্ কিসমতে যা রেখেছেন তা দিয়ে একসাথে খানা খেয়ে নেই”। বসবো না বসবোনা করেও বসতে হলো।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১১)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১১)
    সেলিম স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করায় দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব হলেও খাগড়াছড়িতে তার আবির্ভাবে খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছিনা। প্রথমত বোনের হাসবেন্ড হিসেবে রুমমেটরা হাই-হ্যালো, খায়-খাতির ইত্যাদিতে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে। তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু কখন কি বেফাঁস বলে বসে তারও ভরসা নাই। দ্বিতীয়ত তার সাথে কাজের কথা বলতে পারছিনা। সারাদিন থাকি অফিসে। সন্ধ্যার পর বাসায়। সেখানে অন্য রুমমেটরাও থাকে। থাকে বাবুর্চিও। ক্রান্তিকালীন সাংসারিক আলাপ আলোচনা , বিশেষত সার্কাস টাইপের সম্ভাব্য হাই ভোল্টেজ ডায়ালগ করার মত পরিবেশও পাচ্ছিনা। বাইরে ঘুরার নাম করে রাতে রেস্তোরাঁয় বসেও বিশেষ সুবিধে হচ্ছেনা। প্রশ্ন করলে মিনিট দুই পর এক শব্দে দ্ব্যর্থবোধক উত্তর আসে। স্পষ্ট করতে সম্পূরক প্রশ্ন করতে হয় তিনটা। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরে পাশ কেটে যায় বা নিরুত্তর থাকে। মেজাজ ধরে রাখা কঠিন।তার আসল মোটিভ কি তাও জানতে পারছিনা।
    সারাদিন বাসায় থেকে লম্বা লম্বা ঘুম দিচ্ছে। ভাবছি বলে কয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেই। যদিও এতে অবস্থার আরো অবনতি হবে। সেও যেতে রাজী না। আম্মাও ঢাকা বাসায় তার এন্ট্রিতে রাজী না। মলি বাসায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে দিয়েছে। বড় মামা পিস্তল শানাচ্ছেন। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।মান-সম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। সমস্যা হয়েছে, সেলিম কোনভাবেই তাদের বাড়ীতে যাবেনা। তার কোন আত্মীয়ের বাসাতেও না। ফোনে মলিকে পাওয়া যায় না। আম্মাকে বলে দিয়েছে আমাদের দু’জনের কারো সাথে কথা বলবে না। তার মেজাজ গরম,কেন আমি সেলিমকে জামাই আদর করে জায়গা দিয়েছি? সেলিমকে বললাম ফোন দিতে। কান ধরে এমন ভাব করলো যেন এর চেয়ে ডাইরেক্ট কনডেম সেলে কারাবাসে যাওয়াও তার জন্য সহজ। বললাম, “তোমার মোবাইল কই”? উত্তর শুনে আমি হাসবো না কান্না করবো নাকি ঠাস করে দু’গালে দু চড় মারবো বুঝতে পারছিনা। মোবাইল নেই। নেই মানে নেই। এই এক উত্তর। তাহলে গেল কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর বের করা সম্ভব হয়নি। ধরে নিয়েছি, হয় ছিনতাই হয়েছে, নয়ত বিক্রী করে পুঁজির ক্রাইসিস মিটাচ্ছে। আম্মাকে আর ছোট মামাকে অনেক বলে কয়ে ম্যানেজ করলাম। আমার চাকরি ও মান-ইজ্জতের খাতিরে হলেও তাকে এখান থেকে অন্যত্র শিফট করা দরকার। হাজার পাঁচেক টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে নাইট কোচে তুলে দিলাম। সাময়িক সমাধান হলো বলে কিছুটা স্বস্তি পেলেও হঠাৎ মনে হলো সে যদি বাসায় না গিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে আবার ঘাপটি মারে? এতক্ষণ মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছিলো আর এখন প্রচন্ড ব্যাথা করা শুরু করে দিয়েছে। কোন ফ্যামিলিতে এরকম এক পিস থাকলেই যথেষ্ট। এক জেনারেশনে আর শান্তির মুখ দেখা লাগবেনা। ওকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় এসেই মনে হলো ছোট মামাকে বলি ভোরে তাকে যেন রাসেল স্কোয়ারের কাউন্টার থেকে এসকর্ট করে নিয়ে বাসায় হাওলা করে দেয়। ছোট মামা শুনে হাসলেন। বললেন, “বড্ড বিপদেই পড়া গেল দেখছি তাকে নিয়ে”।বড় মামা হলে ফোনেই শাউটিং করা শুরু করে দিতেন।

    খুব ভোরে উঠে মনে হলো সেলিম যদি অন্য কোন মতলবে বাসায় না যাবার জন্য আরামবাগ স্টপেজে নেমে পড়ে? ছোট মামাকে বললাম। কথা সত্য। তাকে আরামবাগ কাউন্টারে ব্যাগ হাতে নামতে দেখা গেল। “এখানে কেন” জিজ্ঞেস করতেই তার উত্তর “এখানে এক বন্ধুর বাসায় দেখা করে পরে যেতাম। কিছু টাকা পাই ওর কাছে”। মামা তাকে কোন সুযোগ না দিয়েই গাড়ীতে উঠিয়ে সোজা বাসায় আম্মার হাওলা করে দিয়েছেন। এর পরের কাহিনী নাটকীয়। নারকীয়ও। প্রথমত মলি ঘুমে ছিলো। রুমের দরোজা লকড। দ্বিতীয়ত কারফিউ ব্রেক করে সে হাজির হয়েছে। তাই ঘুম থেকে তুলে ফেরারী আসামীকে তার সামনে হাজির করালে সাংঘাতিক বিপদ ঘটতে পারে। তার আপাতত ঠিকানা আমার রুম। এভাবেই আম্মা ব্যবস্থা করে তার জন্য নাস্তা তৈরি করতে কিচেনে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ পর তুমুল হট্টগোলে আম্মা কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সেলিম আমার রুমে নেই। মলির রুম লকড। রুমের ভেতর মলির গলা চড়ানো বাংলা সিনেমার হাইভোল্টেজ নন স্টপ মনোলগ বর্ষণ চলছে। আর কোন কন্ঠ শোনা যাচ্ছে না। আম্মা চুলা নিভিয়ে বুয়াকে বিদায় দিয়ে বিছানায়। আমি অসহায়।

    ঘন্টাখানেক পর বাসার খবর নিতে ফোন দিলাম। বললাম, “বাসার পরিবেশ এখন কেমন”?আম্মা এমন একটা ভাব করলো যেন “অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট”। আমি বললাম, “কেমনে কি হলো”? আম্মা হেসে বললো, “দুটোই তো পাগল। এই ফাটাফাটি, এই মাখামাখি। দেখলাম মলি নিজে নাস্তা বানিয়ে রুমে বসে দু’জনে মিলে খেলো”। বিস্ময়ে আমি হতবাক। পরক্ষণেই ভাবলাম, এরই নাম প্রেম। মানুষের ভুল হতে পারে, দোষ থাকতেই পারে, বিচ্যুতিও হতে পারে। কিন্তু সাচ্চা প্রেম সব কিছু মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলে।

    হঠাৎই শৈলীর ফোন, “স্যার,দারুণ সারপ্রাইজ আছে। রাতে ফোন দেবো। ধইরেন”। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে ফোন রেখে দিলো। কিসের সারপ্রাইজ? আর এখনই বা বলা গেল না কেন? টিন এজ বালিকাদের বুঝা খুব কঠিন। এদের মনের ব্যারোমিটারের ভেতর পারদ থাকেনা। থাকে ঈথার। সেই ঈথারে উল্টো পাল্টা ঢেউ লাগলেই মনের নাচন শুরু হয়ে যায়। তখন কাউকে ভালবেসে দিল ফানাফানা, নয়ত তুই-তুকারি থেকে যাচ্ছেতাই। কিন্তু আমাদের তো সে সম্পর্ক না। মাথা ঝিম ঝিম করছে। মানুষকে আল্লাহ যে কত শক্তপোক্ত করে সৃষ্টি করেছেন তা বহুর্মুখী অবস্থায় পড়ে এখন বুঝছি।

    একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। পড়াবার এক ফাঁকে শৈলিকে বেশ আনমোনা দেখে বলেছিলাম, “কি ব্যাপার? পড়ায় মনে নেই যে। কী ভাবছো”? বল পয়েন্ট কামড়াতে কামড়াতে দুষ্টুমাখা হাসিতে বললো, “শুনবেন”? মাথা নাড়লাম। বললো, “না থাক। আপনি লজ্জা পাবেন”।

    — কেন? লজ্জা পাবো কেন? আমার প্রশ্ন।
    — কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি
    — আর এখন পড়ালেখা বাদ দিয়ে বসে বসে সেটাই ভাবছো?
    — হুম্ম
    — বেশ তো। পাগল আর কাকে বলে
    — পাগলই তো
    — কে?
    — কে আর? আমি। তবে আপনিও
    — আমি কিভাবে?
    — পাগলদের পরিপূর্ণ সেন্স থাকেনা
    — তোমার আছে?
    — না। তাই তো ঝামেলা
    — তা কি স্বপ্ন দেখলা?
    — দেখলাম, আমি আর আপনি কোথায় যেন গেছি। সমুদ্রও আছে। আবার পাহাড়, জঙ্গলও আছে।
    — তারপর?
    — জঙ্গল পেড়িয়ে ছড়া পাড় হতে গিয়ে পড়েছি সমস্যায়
    — কি সমস্যা?
    — ছোট্ট ডিঙ্গীতে করে পেরোতে হবে
    — এতে সমস্যা কি?
    — সেখানেই তো সমস্যা। আপনি সেই ডিঙ্গীতে কিছুতেই উঠতে চাচ্ছেন না।
    — তারপর?
    — তারপর আর কি? আপনি ধমক দিয়ে বললেন, কই, লিখছোনা কেন? অমনি স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।

    শৈলীর এই স্বপ্নের অর্থ কি আমি বুঝি। কিন্তু আসকারা পেয়ে যাবে ভেবে বললাম, “স্বপ্নে তোমার সাথে ওটা আমি না অন্য কেউ ছিল। আজেবাজে চিন্তা বাদ দাও। এভাবে আনমোনা হলে আমি চলে যাবো কিন্তু”। শৈলী এতে মর্মাহত হলো। রাতে শৈলী আবার ফোন দিলো। সাধারণত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ফোন দেয় না। তবে পরীক্ষার আগে কোন কিছু ক্লিয়ার করার জন্য রাতে এর আগেও কয়েকবার ফোন দিয়েছে। ধরলাম, “বলো,কি বলবা”?

    — স্যরি
    — কেন?
    — দু’কারণে
    — যেমন
    — আপনাকে আজ পাগল বলেছি।
    — লিভ ইট। আর কোন কারণ?
    — আমার স্বপ্নটা মাথা থেকে সরাতে পারছিনা
    — কেন?
    — জানিনা
    — আজেবাজে স্বপ্নের কোন মানে হয়না। খেয়ে ঘুমিয়ে পরো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
    — আপনি স্বপ্নটাকে তো পাত্তাই দিলেন না।
    — এনাফ ইজ এনাফ। জাস্ট স্টপ ইট।
    কথাগুলো শৈলীর মোটেই মনপুত হলোনা। বললো, “স্বপ্নটা মোটেই আজেবাজে ছিলো না। আপনিই আজেবাজে ভাবছেন”।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১০)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১০)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১০)
    শেষ পর্যন্ত জামান ভাইয়ের ঢাকায় বদলীর আদেশ হয়েছে। হেড অফিসে। এতে আমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। কারণ দুটি। এক, বদলী হয়ে ঢাকাতেই যাচ্ছেন তিনি। তাই দেখা সাক্ষাতের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। দুই, চান্স পেলেই তিনি আমাকে টান দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। একদিকে সাময়িক বিচ্ছেদ। অন্যদিকে মিলনের সম্ভাবনা।

    জামান ভাই নিয়ে আমার কৌতুহলের এখনো সমাপ্তি হয়নি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি যে তার এই বিরহ যাতনার মূলে আছে ওয়ান সাইডেড লাভ। আর এটুকুও আঁচ করতে পেরেছি যে সেই ভদ্রমহিলা এখনো অকৃতদার। বিত্ত বৈভবে উচ্চ আর চিত্ত বিলাসে মত্ত সেই ভদ্র মহিলার পারিবারিক অবস্থা নাকি হাই ফাই। জামান ভাইদের ফ্যামিলির সাথে নাকি যায় না। যতই বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে ততই একাকীত্বের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ক্রাশ প্রোগ্রামের মত করে এরিমধ্যে ঘুরে এসেছি সাজেকসহ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। এই প্রথম চাক্ষুষ করলাম, বলাচলে, উপলব্ধি করলাম, নিঃসর্গের কোন অস্থিরতা নেই, কোন উচ্চবাচ্য নেই। সর্বত্র সবুজের সমারোহ, পাখ-পাখালীর পদচারণা, কল-কুঞ্জন। ঝর্ণা আর ছড়ার কুলকুল রব ও নিরবধি বয়ে চলা। আর রয়েছে উপত্যকার বন্ধুরতার সাথে মানুষের প্রাকৃতিক মিতালী। জামান ভাইকে আমরা সহকর্মীরা রাতের কোচে তুলে দিলাম। বিদায়ী হাত তুলতে গিয়ে চোখের জল টুপ করে ঝরে পড়লো। ভাগ্যিস রাত। কেউ দেখেনি কারো অশ্রুপাত। বুকের ভেতর অশান্ত মহাসাগর। সেই রাতে আর ঘুম এলো না। জামান ভাইকে যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করছি ততই তা বলগ দিয়ে উপচে পড়ার মত উথলে উঠছে। এভাবেই ফজরের আযান হলো। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। ঘুম হতে নামায উত্তম।

    মনটাতে বিদ্যুৎ শক দিয়ে গেল। নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হলো। মহান আল্লাহতায়ালা দিনকে করেছেন রাতের অধীন। আর রাতকে রেখেছেন প্রশান্তির জন্য। ঘুম হলো তাঁর তরফ থেকে প্রদত্ত প্রকৃষ্ট নিয়ামত। আবার ঘুম হতে উত্তম হলো এই ফজরের সালাত। এরই আহ্বান এড়িয়ে যেতে সাহস হলো না । কবে কোনদিন ফজরের সালাত সময়মত পড়েছি মনে করতে পারছিনা। জামাতে তো নয়ই। ওযু করে গেইটে তালা মেরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম। আজ এই প্রথম মনে হলো আমি যথার্থই অসহায়। আত্মসমর্পণ ভিন্ন শান্তির বিকল্প পথ আমার জানা নেই। নামায শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসলাম। বললাম, “রাতে ঘুম হচ্ছেনা। ডাক্তারের পরামর্শ মতে ওষুধ খাচ্ছি। কিন্তু কাজ হচ্ছেনা”। ইমাম সাহেব শুনলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন, “পেরেশানি থাকবেই। সবর আর সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। দেখবেন শান্তি পাবেন”। বাসায় ফিরছি। ততক্ষণে চারিদিক আলোকিত হয়ে গেছে। প্রকৃতিও নিদ্রা শেষে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। মনে প্রশান্তির হিমবাহ বইছে।

    শৈলীর ফোন। অপ্রত্যাশিত। ধরলাম। আজ তার এইচ এস সি রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে যথাকাম্য গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। দারুণ খুশি। বললো, “ স্যার, আপনি তো ফোন করে উইশও করলেন না একবার”।
    — আসলে আজই যে রেজাল্ট বেরিয়েছে কাজের চাপে তা খেয়াল করিনি। স্যরি
    — স্যরি বললেই তো হবে না
    — তাহলে
    — ঢাকায় এলে আমাদের বাসায় আসতে হবে
    — আমি তো ঢাকায় কম যাই
    — এখন বেশি বেশি আসবেন
    — কেন?
    — বারে! আমি বুয়েটে ভর্তি হতে চাই যে
    — সে জন্য ভাল করে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করো। সেখানে ভর্তি হও
    — তাতো হবোই। তবু আপনাকে চাই।
    — সে পরে দেখা যাবে
    — সে হবে না। আপনি পরে আর আসবেন না
    — কেন?
    — আপনার বিয়ের দাওয়াতও তো দিলেন না
    — আমি বিয়ে করেছি তোমাকে কে বললো?
    — করেন নি? আল্লাহ বাচাইছে
    — মানে কি?
    — মানে কিচ্ছু না। এত মানে মানে করেন কেন?
    — তুমিই তো কি সব আবোলতাবোল বলছো
    — মোটেই আবোলতাবোল না। তাছাড়া আমার ট্রিট তো পাওনা হয়ে গেছে।
    — কিসের ট্রিট?
    — বাহরে! মনে নাই? ভাল রেজাল্ট করলে ট্রিট দেবেন বলেছিলেন।
    — হুম্ম।
    — ঘাবড়ে গেলেন?
    — না, তা কেন?
    — আচ্ছা রাখি। ভাল থাকবেন। এখন থেকে প্রতিদিন ফোন দেবো। ধরবেন কিন্তু।

    শৈলীর আচরণ আরো ডেসপারেট হয়েছে বলে মনে হলো। আমার এই ছাত্রীটি দেখতে যেমন অসম্ভব সুন্দর তেমনি দারুণ চটপটে। সারাক্ষণ বকরবকর করবে। বিশেষত আমি পড়াতে গেলে তার কথার চোটে আর প্রশ্নের ঠেলায় আমার নাভিশ্বাস উঠে যেত। শৈলী দুষ্টুমী মাখা হাসিতে মজা লুটতো। পরক্ষণেই বলত, “স্যার, মনে কষ্ট পেয়েছেন”?
    — কেন? আমার প্রশ্ন।
    — এই যে আপনাকে এত বিরক্ত করি। পড়া বাদ দিয়ে আপনার সাথে অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করতেই থাকি। অথচ
    জানি আপনি এসব পছন্দ করেন না।
    — তাহলে করো কেন?
    — ভাল লাগে। আপনি রাগ করেন। সেটা দেখতে খুব ভাল লাগে।
    — আর কি ভাল লাগে?
    — আপনার দেওয়া হোম ওয়ার্ক করেও মিথ্যা বলি
    — কেন?
    — আপনার রিয়েকশন দেখতে।
    — কি দেখতে পাও?
    — আপনার রিয়েকশনে মাশাল্লাহ একটা ভাব আছে।
    — তাই নাকি?
    — হুম্ম। আপনাকে তাই আমার খুব খুব ভাল লাগে। লাভ ইউ।
    আমার অন্তরাত্মা শিউরে উঠে। ছোটবেলায় গল্প-কাহিনী, সিনেমা-নাটকে টিউশন মাস্টারের প্রেম কাহিনী এবং পরিণতিতে ঘর জামাইয়ের চিত্র ভেসে উঠলো। ধমকের সুরে বললাম, “ওসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দাও। নইলে কাল থেকে আমি আর আসবো না”। অমনি তার চোখ ছলছল করে উঠলো। অভিমান প্রকাশের জড়তা চোখে মুখে স্পষ্ট। আমার কেমন যেন মায়া হলো। এ বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাময়িক এই ইনফেচুয়েশন ভাব থাকা স্বাভাবিক। আজ শৈলীর এই খুশির খবরে টিউটর হিসেবে নিজেকে খুব গর্বিত ও খুশি খুশি লাগছে। তার বাবা মায়ের ইচ্ছে মেয়ে ডাক্তার হবে। আর শৈলীর ইচ্ছে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাও আবার বুয়েটের। কেন? আমি বুয়েটিয়ান বলে? বালিকাদের কোন আচরণই সিরিয়াসলি নিতে নেই। যদিও তাদের আচরণে একটা অবিনাশী প্লব্যতা থাকে।

    একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। বাসায় কেউ নেই। কাজের বুয়া ছাড়া। আমি বুঝতে পারিনি। শৈলী সেদিন অন্যরকম উচ্ছল। পড়াতে খেয়াল নেই। যত মনোযোগ আমাতে। বললাম, “তুমি যে এমন করো আমার টিউশনি টা তো চলে যাবে”।
    — যাবে না
    — কেন?
    — বাবা আপনাকে পছন্দ করেন
    — কেন?
    — আমার রেজাল্ট ভাল হচ্ছে। আমি বাবাকে আপনার ব্যাপারে সার্টিফাই করেছি
    — আর তোমার আম্মা?
    — আম্মার কথা ছেড়ে দেন। খালি পাহারা দেয়
    — কেন?
    — এই আপনার সাথে যদি ইয়ে হয়ে যায়
    — সেজন্যই তো বলছি, পড়ায় মন দাও
    — দূর, খালি পড়া আর পড়া। ভাল্লাগেনা।
    বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় শৈলীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলেছিলাম যদি রেজাল্ট ভাল হয় তাহলে ট্রিট দেবো। এ কথা শুনে পারলে সে লাফ দেয়। তার মা হন্তদন্ত হয়ে আসে। আমি লজ্জায় হতভম্ব হয়ে পড়ি। শৈলীই সে যাত্রা সামলে নেয়। সেদিনের সেই নেহায়েত উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলা কথার কথা আজ আর ফিরিয়ে নিতে পারলাম না।

    সেলিমের খোঁজ এখনো মেলেনি। মলির মানসিক অবস্থা খুব খারাপ। বাসায় কোন প্রাণ নেই। যা আছে তা গোরস্থানের শুন শান নিরবতা। এখানে থেকে আমার করার কিছু নেই। মামারা খোঁজ খবর করছেন। যে নিজে থেকে নিরুদ্দেশ থাকে তাকে খুঁজে বের করা খুব সহজ না।

    পড়ন্ত বিকেল। অফিসে বসে আছি । ভাবছি অনেক কিছু। এলোমেলো। জীবন বৈচিত্র্যময় জানি। তাই বলে এত বৈচিত্র্যের প্রয়োজন আছে কি? দুঃখ না থাকলে সুখ কি জিনিস তার গুরুত্ব বুঝা যেত না, সেটা ঠিক। তাই বলে অতলান্ত দুঃখের খুব বেশি প্রয়োজন আছে কি? হঠাৎই ভুত দেখার মত চমকে উঠি। টেবিলের সামনে ব্যাগ হাতে উসকোখুসকো চেহারা নিয়ে মাথা নিচু করে সেলিম দাঁড়িয়ে আছে। ভুত দেখছি না তো? সেলিমই ধপাস করে চেয়ারে বসে বিলাপের সুরে নিম্নস্বরে বললো, “ভাইজান, পৃথিবীতে আমার আর যাওয়ার জায়গা নাই। মাটির নীচে ছাড়া”। আমি নিখোঁজ ব্যাক্তির সন্ধান প্রাপ্তির আনন্দে, অবিমৃষ্যকারী এক ব্যাক্তির প্রতি দারুণ ক্রোধে ও ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর একজন সেলিমের স্বীকারোক্তিসহ নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের মায়া মায়া মুখের দিকে চেয়ে নির্বাক থাকলাম কিছুক্ষণ। পৃথিবীর বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবছিলাম অনেক কিছু। এর চূড়ান্ত প্রমাণ আমার সামনে এ মুহুর্তে হাজির। বললাম, “খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিছু”? মাথা নীচু করে নিরুত্তর থাকলো। বুঝলাম হয়নি। বাসায় নিয়ে এলাম। বাবুর্চিকে পাঠালাম খাবার আনতে। বোনকে চমকে দেওয়ার উত্তাপে ফোন দিলাম। আম্মা ধরে বললো, “সকাল থেকে ওর শরীর খারাপ। প্রেসার খুবই লো। শরীর দুর্বল। খাওয়া-দাওয়া নাই। আবোলতাবোল বকছে। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ঘুমুচ্ছে”। আম্মাকে সেলিমের কথা বললাম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেলিমের উপর নতুন করে মায়ার বদলে ক্রোধ বাড়তে লাগলো। বৈচিত্র্যের রঙ বোধহয় ক্ষণে ক্ষণে এভাবেই বদলায়।

    চলবে…