Author: Anwar Hakim

  • সবাই একরকম হয়না

    সবাই একরকম হয়না
    যদি এমন হবে তবে ওমন হবে কে?
    ছোট্ট যে সংসার সেখানেও সবাই
    একমত হয়না, দ্বিমত হয়, বহুমুখী হয়, সুরেলা হয়, বেসুরো হয়।
    সংগীদের মধ্যেও সবাই একরকম হয় না।
    কেউ সেলফিস, কেউ জেলি ফিস,
    কেউ বাইম মাছের মত পিছলে যায়,
    কেউ কৈ মাছের মত একটু বৃষ্টি পেলেই উথলে ওঠে।

    ক্লাসে কেউ ফার্স্ট হয়,
    কেউ ফেল করে হার্ট হয়
    কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়
    আবার কেউ সুযোগ বুঝে পালায়
    কেউ সহমর্মী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে
    তাই সবাই একরকম হয় না
    কেউ কেউ অন্য রকমও হয়।

    কেউ কেউ প্রেম করে আবার
    কেউ কেউ প্রেম ভাংগে
    কেউ কেউ প্রেম করে বিয়ে করে আবার
    কেউ কেউ বিয়ে করে পরকীয়া করে
    কেউ সৎ উপদেশ দেয় আবার কেউ কুটবুদ্ধি ঢালে
    কেউ ভালবাসা জানায়
    কেউ হিংসা-দ্বেস ছড়ায়
    তাই সবাই একরকম হয়না, ঐরকমও হয়।

    সংসারে কেউ চাকুরে,
    কেউ বেকার,
    কেউ কিং মেকার।
    সবাই প্রমোশন চায়
    কেউ পায়, কেউ পায় না।
    যে পায় সে আর পিছু ফিরে তাকায় না
    যে পড়ে থাকে সে আর উপরের আকাশ দেখতে পারেনা।

    কারো প্রাচুর্য আছে আবার কারো আছে গরীবীয়ানা
    ধনীর আছে দারিদ্রবিলাস আর
    গরীবের কখনো কখনো সুখবিলাস।
    অতএব, সবাই একরকম হয়না, অন্যরকমও হয়।

    তবে সবাই দু’টি বিষয়ে একরকম: স্বার্থ আর স্বপ্ন।
    সবাই স্বার্থের হায়ার ম্যাথ ভাল জানে
    ধনী বোঝে উপেনের দু’বিঘা জমি তার বড় বেশী প্রয়োজন
    আর গরীব বোঝে ঐ দু’ বিঘা জমি বেচে ত্রয়োদশী মেয়েটার
    বিয়ে না দিলে পাড়ার শকুনেরা ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে।

    ধনী স্বপ্ন দেখে
    হেথা নয় হোথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোন খানে তার যথার্থ ঠিকানা
    আর গরীব স্বপ্ন দেখে
    যাকাতের টাকাটা পেলেই আগামী দু’মাস সে নিরাপদ।

    তাই কিভাবে সবাই একরকম হবে
    যেরকম হওয়ার কথা আমরা কেউ কেউ ভাবি!

  • মন এক ইচ্ছে ঘুড়ি

    মন এক ইচ্ছে ঘুড়ি
    আনোয়ার হাকিম

    (১)
    শুরুটা হয়েছিলো ‘আজকে আমার মন ভালো নেই’ দিয়ে। এরপর এলো ‘মন আমার কেমন কেমন করে’। আর এখন চলছে ‘আজকে কেউ নেই বলে’। এর সবই হতাশা থেকে উদ্ভুত বিলাপ। হাসি-ঠাট্টার ছলে এই কৌতুক নক্সাগুলো ইদানীং পাবলিকের মুখে মুখে ঘুরছে আর ব্যাপক বিনোদনের খোরাক জোগাচ্ছে। ভার্সিটি পড়ুয়া এক ছাত্র তার মনের অভিব্যক্তি পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নোত্তরের পরিবর্তে ‘আজকে মন ভালো নেই’ বলে ব্যক্ত করে বেশ বিপদেই পড়েছে। চর্বিত-চর্বনে পরিস্থিতি এতটাই দুষ্ট হয়ে পড়েছে যে, ভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে বিবৃতি পর্যন্ত দিতে হয়েছে। সে যা-ই হোক। ‘আমার মন ভালো নেই’ জাতীয় অভিব্যক্তিও আজ হাস্যকর হয়ে উঠেছে। অতি সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে ‘মন আমার কেমন কেমন করে’। সত্যিকার অর্থে আমাদের সমাজ জীবনের ঘটমান বাস্তবতার নিরীখে আমাদের মনও যেন অহরহ কেমন কেমন করে? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই। মন ভালো না থাকা আর মন কেমন কেমন করে জাতীয় অনুভূতির মিশ্রণে তৈরি হওয়া ‘আজকে কেউ নেই বলে’ জাতীয় এক ধরণের হতাশা বোধ পেয়ে বসেছে সবাইকে। সত্যিই তো আজকে আমাদের অনেক কিছুই হচ্ছেনা শুধু ‘কেউ নেই বলে’।
    চাকরিটা মিলছে না, কন্ট্রাক্টটা পাওয়া যাচ্ছে না, পদ-পদবী, প্রমোশনটাও দিচ্ছে না, হওয়া জিনিসটাও হচ্ছেনা। শুধু ঐ ‘কেউ নেই বলে’। ঘুষ ছাড়া হক জিনিসও পাওয়া যাচ্ছে না। শালিসে বিচার মিলছে না। কাগজপত্র সব ঠিকঠাক থাকা সত্বেও শত আবেদন-নিবেদন গতি পাচ্ছে না। নথীও হয়ে যাচ্ছে বেমালুম গায়েব। কেউ নেই বলে।
    ‘কেউ নেই বলে’ই ‘আজকে আমার মন ভালো নেই’। আমার মন ভালো নেই বলেই ‘মন আমার কেমন কেমন করে’। এই তিন বুলির ঐকতানে চলছে আমাদের আটপৌরে জীবনের পথ চলা।

    (২)
    মন বড়ই আজব। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শাসন করা যায় না। করতে চাইলেও শাসন মানে না। দুম করেই বেজার হয়। মনের ঘরে তালা দিয়ে বসে থাকে। ইচ্ছে মত অফ হয়, মর্জিমাফিক অন হয়। ইচ্ছে হলে হাসে, ইচ্ছে হলে কাঁদে। মন বড় দুষ্টু, বড়ই চঞ্চল, থাকতে চায়না কোনখানে বেশিক্ষণ।
    অথচ এই মনটাকে হৃষ্টপুষ্ট, শান্তশিষ্ট , লেজ বিশিষ্ট, তুষ্ট রাখতে প্রতিনিয়ত আমাদের কতই না প্রয়াস! মনের আবার খায়েস বেশ। একলা থাকলে দোকলা খুঁজে। স্বপ্নে সুখের নহর দেখে। শান্তির তালাশে ডুব মারে। তারও আবার অসুখ হয়। দুঃখ এসে ভর করে। মনের ভেতর কু ডাকে। মানস পটে আঁধার নামে। নিজেকে খুব অনাথ লাগে। পীড়ন স্পৃহা জেগে উঠে। ঈর্ষা এসে ভর করে। সুখে থাকলে প্রেম ভাব জাগে। একান্তে পেতে মন ছোটে। না পেলে জেদ চাপে। উপেক্ষা পেলে হনন ইচ্ছা জাগে। সব কিছু তখন তিতা তিতা লাগে। মন যে এক ইচ্ছে ঘুড়ি।

  • উত্তরা টু আজিমপুর – নীতুর জন্য ভালোবাসা

    উত্তরা টু আজিমপুর – নীতুর জন্য ভালোবাসা

    উত্তরা টু আজিমপুর
    নীতুর জন্য ভালোবাসা।
    আনোয়ার হাকিম।

    নীতু বরাবরই ভাল স্টুডেন্ট। আমি মাঝারি মানের। এ নিয়ে নীতুর কোন এলার্জি নেই। আমারও। আমরা একই স্কুলে ও একই কলেজে পড়েছি। আমাদের বাসাও মফস্বল শহরের একই এলাকায় পাশাপাশি ফ্ল্যাটে। নীতুর বাবা সরকারি অফিসার। আর আমার আব্বা ডাক্তার। মূলতঃ কোচিং একাডেমী থেকেই আম্মার সাথে আন্টির পরিচয়। সময়ের সাথে সাথে সেই পরিচয় পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা পেয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে গলায় গলায় খাতির থাকলেও আমাকে নিয়ে আব্বা-আম্মার রাজ্যের ক্ষোভ। আব্বা ডাক্তার আর আম্মা ভার্সিটির উচ্চ শিক্ষিত। তাদের ছেলে মিডিওকার হবে এটা মেনে নিতে তাদের যার পরনাই কষ্ট। নীতুর আব্বা সরকারি অফিসার হলেও নীতুর মা’র শিক্ষা কলেজ অবধি। অথচ তাদের মেয়ে ব্রিলিয়ান্ট। এই সুক্ষ্ম খোঁচা তাদের অন্তরকে অনবরত খোঁচাতে থাকে। আমি তাদের একমাত্র সাবজেক্ট। আব্বা-আম্মার ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হবে। আমারও ইচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারিনা। কারণ ট্র্যাক রেকর্ড ভালো না। মনে আছে ক্লাস টেনে পড়ার সময় নীতুর সাথে বই আর নোট বিনিময় হত। সেটা পরিবারের গোচরেই। মেয়েদের বই-খাতা বেশ পরিপাটি আর সুগন্ধযুক্ত হয়। নীতুরও তাই। অন্যদিকে আমারটা যাচ্ছেতাই গোছের। আমার কথা হলো বই-খাতা ব্যবহারের জন্য, সুগন্ধি মাখিয়ে ইস্ত্রী করে পরিপাটি করে রাখার জন্য না।
    এই নিয়ে নীতুর সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয়। ঝগড়াটা আমার তরফ থেকে না। নীতু অনেকটা ইচ্ছে করেই করে। বলে, “ ছেলেরা সবাই কি এমন ছন্নছাড়া হয় নাকি”? আমি বুঝি নীতু ঝগড়া শুরু করার পাঁয়তারা করছে। আমি উত্তর দেই না। নীতু ছাদে ঘুরঘুর করছে আর এগাছ-ওগাছ নিরীক্ষণ করছে। উত্তর দিচ্ছি না দেখে প্রসঙ্গ ঘুরালো। বললো, “আমার টব কে ভেঙ্গেছে”? আমি কোন উত্তর দেই না দেখে বললো, “ নিশ্চয় তুমি”? আমি এবার আর কথা না বলে থাকতে পারলাম না। বললাম, “দেখো গায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করবা না। আমার এগুলো ভালো লাগেনা”। নীতু হাসে। বলে, “আরে গাধা গায়ে পাড়া না, ওটা হবে পায়ে পাড়া”। আমি তার দিকে কট্মট্ করে তাকালাম। দেখলাম তার চোখে মুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক। বুঝতে কষ্ট হয়না সে আমাকে উত্যক্ত করে মজা পাচ্ছে। আমি ছাদ দেওয়ালের কাছে গিয়ে বললাম, “ মজা নিচ্ছো? আমিও মজা নিতে জানি। তখন টের পাবা”। নীতু হাসিতে গড়াগড়ি যায় আরকি। বললো, “যে আমার বীরপুরুষ। তুমি মজা করতে জানো নাকি”? এরকম উত্তরের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
    আমার প্রতি নীতুর দুর্বলতা আমি প্রথম টের পাই ক্লাস টেনে টেস্ট পরীক্ষার পর। টেস্টে বরাবরের মত নীতু ফার্স্ট। আর আমার পজিশন মাঝামাঝি। সব ভালো ছাত্রেরই কমবেশি আলাদা একটা গরিমা থাকে। নীতুরও আছে। আমি নীতুকে এড়িয়ে চলি দুই কারণে। এক, সে আমার চেয়ে ভালো ছাত্রী, আর আমাদের প্রতিবেশী। আর দুই নম্বর কারণ হলো, তাকে নিয়েই আমার পৌরুষে যত আঘাত। আব্বা-আম্মা সারাক্ষণ খোঁটা দেয়। নীতুর কথা পাড়ে। তার মত রেজাল্ট করতে বলে। তাকে দেখে শিখতে বলে। এস এস সি তে নীতু গোল্ডেন এ প্লাস। আমি জিপিএ ফাইভ। যা হবার তাই হলো। রেজাল্ট বেরোবার বেশ কয়েক মাস আব্বা-আম্মার শোক চলতেই থাকলো। উভয় পরিবারের যাতায়াতে, গেট টুগেদারে এই যাতনার মাত্রা আরো বাড়ে। নীতু আহ্লাদি করে আসর সরগরম করে রাখে। সবাই তাকে তোলা দিয়ে কথা বলে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আব্বা-আম্মাও নীতুর তারিফ করতে থাকে। প্রথম প্রথম আমল না দিলেও পরে বিষয়টা ব্যক্তিত্বের কোথায় যেন খচ্ খচ্ করে। যতই এভয়েড করে চলি নীতুকে সে ততই ঘন ঘন সশরীরে বাসায় এসে নানা প্রসঙ্গ পাড়ে। আব্বা-আম্মা তাকে খুব পছন্দ করে। আর আমি তাকে এড়িয়ে চলি। নীতু বাসায় এলে আমি কাজের অজুহাতে বেরিয়ে যাই। নীতু বুঝতে পারে। বলে, “আজকাল আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো মনে হচ্ছে”? আমি কোন উত্তর করিনা। দুর্বলের শক্তিই হলো নিরব থাকা। এতে অন্যরা মনে করে ভারি কলসি বাজে কম। অথবা নিভৃতচারী এবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর গোছের হবে। নীতু কি ভাবে জানিনা। তবে এই দুয়ের একটাও যে ভাবে না সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারি।
    একদিন কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল খাতার ভেতর একটা চিরকুট মিললো। তাতে লেখা “বেশি বেশি ভাব। মাকাল ফল”। আমি হতভম্ব। মানে কি? আমিও কম যাই না। খাতা ফেরত দেওয়ার সময় আমিও চিরকুটে লিখলাম, “মাকাল ফল থেকে দূরে থাকুন। উজ্জ্বল ভবিষ্যতে গড়ুন”। ব্যস! শুরু হয়ে গেলো আমাদের চিরকুট বিনিময় খেলা। আমাদের মধ্যে এত দেখা-সাক্ষাত, ঘনিষ্ঠতা সত্বেও মোবাইল নম্বর বিনিময় হয়নি। আমার সাহস হয়নি নানা কারণে। এমনিতেই মেয়েদের মোবাইল নম্বর চাওয়া অভদ্রতা। আর চাওয়ার পরে যদি না দেয়? তাহলে আত্মসম্মানে লাগবে। মুখ দেখাবো কি করে? অবশ্য নীতুও কোনদিন চায় নি। কেন চায় নি জানিনা। একদিন নোটের কোণায় একটা মোবাইল নম্বর আবিষ্কার করলাম। কার? নীতুর? এক নোট চোদ্দ হাত ঘুরে। কার কে জানে? তবু টুকে রাখলাম।
    রিং দেবো কি দেবো না ভাবতে ভাবতেই তিনদিন কেটে গেলো। নোট ফেরত দেওয়ার সময় মোবাইল নম্বরের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিলাম। ভাবলাম সাক্ষাতে নীতু এ প্রসঙ্গটা উঠাতে পারে। তখন বুঝা যাবে এটা কার আর কি উদ্দেশ্যে নোটের গায়ে লেখা? নীতুর এ ব্যাপারে কোন সাড়া নেই। একদিন ছাদে দেখা হতেই গায়ে পড়ে বললাম, “নোটে দেখলাম মোবাইল নম্বর লিখে রেখেছো। কেন? মেয়েদের নম্বর কি কেউ এভাবে লিখে রাখে? বিশেষত যে নোট চোদ্দ হাত ঘুড়ে”? নীতু চমকে উঠলো। বললো, “ তুমি কি রিং দিয়েছো নাকি”? বললাম, “ কেন? কার নম্বর? তোমার না”? নীতু হেসেই মরে যাচ্ছে। বললো, “আরে না না। তুমি একটা হাঁদারাম। ওটা তো আমাদের নতুন বুয়ার নম্বর। আম্মা জরুরি টুকে রাখতে বলায় টুকে রেখেছিলাম। কাটতে ভুলে গেছি। তুমি সত্যিই রিং দিয়েছিলে নাকি”? নিজেকে সামলে নিয়ে ভাব নিয়ে বললাম, “ না। মেয়েদের সাথে আমি ফোনে কথা বলিনা”। নীতু মৃদু হাসলো। বললো, “ বাব্বা! হেবি পাট নিচ্ছো দেখছি। আমি তো ভাবলাম আবেগের ঠ্যালায় ফোন করে বস্ছো”। আমি তাৎক্ষণিক অবজ্ঞা ভরে বললাম, “আমার আর খেয়ে দেয়ে কাম নেই। আবেগের ঠ্যালায় তোমারে ফোন দিমু”। নীতু কিছুটা বিচলিত হলো মনে হলো। মেয়ে মানুষের জেদ বেশি। হয় তর্ক করবে নাহয় পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেবে। দিলোও তাই, “দেখা যাবে। সময়ই সব বলে দেবে”। আমি চমকে উঠলাম। আমি তো মনে মনে চাই নীতুর নম্বর। ফোনে ফোনে কথা বলতে। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে সাহস করে বলেই ফেললাম, “ অত ভং চং না করে নম্বরটা দিলেই তো হয়”। নীতু চাঙ্গা হলো বলে মনে হলো। বললো, “এতই সহজ। খুব তো ভাব নিয়ে থাকেন সারাক্ষণ। বাসায় গেলেন বেরিয়ে যান। আপনার আবেগ নাকি উথলে উঠেনা”?
    এভাবে নীতুর সাথে একান্তে আর গোচরে দেখা-সাক্ষাত আর কথা-বার্তা হতে থাকলো। এইচ এস সি তে অপ্রত্যাশিত রেজাল্ট হলো। দু’জনেই গোল্ডেন। আব্বা-আম্মা খুশিতে দশখান। নীতু উচ্ছ্বসিত। আর আমি টেনশনে। আমি জানি আমার মেডিকেলে চান্স হবেনা। কিন্তু আব্বা-আম্মা যেন এতদিনে আশার আলো দেখতে পেয়েছে। তাদের ছেলে ডাক্তার হবে। আর আমার এক কথা আমি মেডিকেলে পড়বো না। বাসায় এ নিয়ে চরম অশান্তি। তারা ডাক্তারি ছাড়া অন্য কিছু মেনে নেবে না। আমিও মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হবো না। এ কথা নীতুর কানে গেলো। ততদিনে আমাদের ডায়ালগ প্যাটার্ন তুমি থেকে তুই-এ প্রমোশন পেয়েছে। একদিন নীতুর আম্মা বাড়ী এসে কান্নাকাটি করলেন। নীতু নাকি ডাক্তারি পড়বেনা। এ নিয়ে ওদের বাসায় তুমুল বাহাস হচ্ছে। আম্মা বিস্ময়ে হতবাক, আন্টিকে জানালেন আমার কথা। আমি নিজেও হতবাক। নীতু বরাবরই বলে এসেছে সে মেডিকেলেই পড়বে। এবারে না হলে আগামীবার ট্রাই করবে। নীতুকে ছাদে পাওয়া গেল। বললাম, “তুই নাকি পাগলামি করছিস”?
    — তুইও তো করছিস। নীতুর পাল্টা উত্তর।
    — আমার তো ডাক্তারি ‘এইম ইন লাইফে’ ছিলো না। তোর ছিলো। এখন হঠাৎ কি হলো?
    — কিছু হয়নি। মাইন্ড চেইঞ্জ করেছি। তোর কোন সমস্যা?
    — সমস্যা না। তবে কারণটা জানলে ভালো লাগত।
    — জানলে কি করবি?
    — কিছু করতে না পারলেও শুনতে তো পারি।
    — কোন দরকার নাই। নীতুর গলা ভারি। চোখ ছলছল। বললাম, “কি হয়েছে বলবি তো”? নীতু চুপ করে থাকে। আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। পরদিন মেডিকেল কোচিংয়ে গিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাসায় আব্বা-আম্মা মহা খুশি। ছেলের সুমতি হয়েছে। আম্মা খুশির চাপে এই কথা নীতুদের বাসায় গিয়ে ছেড়ে আসলো। একথা শুনে নীতুদের বাসায় তুলকালাম কান্ড ঘটে গেলো। নীতুর জন্য মায়া হলো। নীতুকে মেডিকেল একজামে বসাতে আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে না জানিয়ে মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু এতে তাদের বাসার পরিবেশ যে এত তিক্ত হবে বুঝতে পারিনি। নীতু পড়েছে মহাবিপদে। সে এখন হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই তিন শ’ ষাট ডিগ্রী ঘুরতেও পারছেনা। একদিন ছাদে দেখা হতেই সে জ্বলে উঠলো, “তুই পাইছস কি”? আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, “ মানে কি”?
    — মানে বুঝতাছিস না?
    — না
    — ভন্ড কোথাকার। লায়ার।
    — বুঝলাম না
    — বুঝবি কিভাবে? আমারে তো ডুবাইছস
    — কিভাবে?
    — তোকে রাজী করানোর জন্যই তো আমি এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলাম
    — আমিও তো তোকে ফেরাতে এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছি। এখন তুইও এডমিশন নিয়ে নে।
    — তোর মাথা। এখন রাজী হলে আমার লজিক কি হবে?
    — আংকেল-আন্টিকে আমার কথা বলে বলবি ওই হাঁদারাম যদি মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারে তাহলে আমিও হবো।
    — তোর মাথায় তো ঘিলু নাই, গোবরে ভর্তি।
    আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, “তুই তো চান্স পাবিই। আমার চান্স নাই”। নীতু প্রায় কান্না করে বলে উঠলো, “তুই একটা পাষাণ”। নীতু নেমে গেলো নীচে। মাগরিবের আযান চলছে। ছাদ থেকে ব্যস্ত শহরের নাগরিক ম্যুভমেন্ট দেখছি। সবাই ছোটাছুটি করছে। গাড়ীগুলোও। হঠাৎই মনে ঝিলিক মেরে উঠলো গতিই জীবন। আমার নিজের উপর আস্থা কম। কিন্তু নীতুর উজ্জ্বল ভবিষ্যত মহাসড়ক ফেলে বাইলেন বরাবর ছুটবে তা হয় না। ছোট্ট একটা চিরকুটে লিখলাম, “তুই ঠিকই বলেছিলি আমি মাকাল ফল। আমার জন্য হলেও ডিশিসন চেঞ্জ কর প্লিজ। ট্রুলি লাভ ইউ”। কিন্তু কিভাবে তাকে দেবো ভাবছি। নীতু ইদানীং ছাদে কম আসে। বুক পকেটে চিরকুট নিয়ে ওপেক্ষা করি। কিন্তু নীতুর কাছে পৌছাতে পারিনা।
    একদিন আন্টির ডাক পড়লো তাদের বাসায়। তারা বিপর্যস্ত। অনন্যোপায় হয়ে নীতুকে বুঝাতে আমার স্মরণাপন্ন হয়েছেন। এই নাটকের জন্য আমার উপর নীতুর প্রচন্ড রাগ। সামনাসামনি হতেই বললাম, “পাগলামি করো না। তুমি তো ঢাকা মেডিকেলেই চান্স পেয়ে যাবা। আমার তো হবে না আমি জানি”। আন্টিকে বললাম, “ভর্তির টাকা আর ওর ডকুমেন্টগুলো আমাকে দিয়েন। আমি কাল মেডিকেল কোচিংয়ের ফর্ম নিয়ে আসবো”। এই বলে নীতুকে চিরকুটটা হাতে গুঁজে দিয়ে আমি চলে আসলাম। আন্টি খুশি।
    মেডিকেল ভর্তি ফর্ম নিয়ে এসে নীতুকে দিলাম। নীতু একটা বায়োলজী রেফারেন্স বুক ধরিয়ে দিলো। আমার এতে ইন্টারেস্ট কম। সাধারণ বই পড়তেই ইচ্ছে করেনা। আবার রেফারেন্স বুক! তবু বাসায় এনে উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। হঠাৎই একটা চিরকুট নীচে পড়ে গেলো। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম তাতে একটা ফোন নম্বর। নীচে লেখা, লাভ ইউ টু বাবু।

  • আজিমপুর টু উত্তরা – মেঘে মেঘে অনেক বেলা

    আজিমপুর টু উত্তরা – মেঘে মেঘে অনেক বেলা

    আজিমপুর টু উত্তরা
    মেঘে মেঘে অনেক বেলা।
    আনোয়ার হাকিম।

    আমি যখন অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌছলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইউস-বাংলা কাউন্টারে হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে যেই বলেছি আমি এই ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার অমনি ওখানকার দুই তিন জন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। একজন বললো, “স্যার, উই আর এংসাসলি ওয়্যটিং ফর ইউ”। আরেকজন বললো, “পারহেপস ইটস টু লেট”। আরেকজন ওয়াকি টকিতে কি যেন বলছে। আমার সাথে হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া কিছু নেই। ওরা আমাকে পারলে পাঁজাকোলা করে প্যাসেঞ্জার’স গেইটের সামনে দাঁড়ানো কারে তুলে দিল। আমি সাতপ্যাচ ঘুরে অবশেষে গমনোদ্যত সেই ক্রাফটে গিয়ে উঠলাম। এয়ার হোস্টেসের মুখে শুষ্ক অভ্যর্থনা। বুঝলাম তারাও অসন্তুষ্ট। আমাকে সীট দেখিয়ে দিলেন। আমার সীট জানালার পাশে। মন পুলকিত হলো। দেখতে দেখতে চিটাগাং যাওয়া যাবে। উপর থেকে নীচের মাটির জনপদকে দেখার মজাই আলাদা। আর মেঘেদের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়াও রোমাঞ্চকর। জানালার পাশের সীটে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। তিনি ধরেই নিয়েছেন এই সীট ফাঁকা যাচ্ছে। আমার দিকে চোখ মেলে তাকালেন। ভদ্রমহিলা অসম্ভব সুন্দরী। ভদ্রতা করে সীট ছেড়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন। আমিও মওকা পেয়ে সৌজন্যতার পরাকাষ্ঠা দেখালাম। তিনি বিগলিত হয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ জানালেন। আমি সীট বেল্ট বেঁধে বসলাম। ক্রাফ্ট টারমাক বরাবর চলা শুরু করে দিয়েছে। টেক অফ করা পর্যন্ত আমি দোয়া দরুদ যত জানি তা-ই আওড়াতে থাকলাম। জীবন কা সাওয়াল, তাই। এত কিছুর মধ্যে মোবাইল সুইচড অফ করতে ভুলে গিয়েছি। এয়ার হোস্টেস মিহি গলায় সতর্ক করে গেলো। টেক অফ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন উপরে স্ট্যাবল হলো। পেপার পড়ছি। ভদ্রমহিলা কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বুঁজে কি যেন শুনছে। তাতে আমার কি? তবে আমার একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। তার পারফিউমের তেজী গন্ধে আমার মাথা স্টাক হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্টই হচ্ছে। বিমান আকাশে ভাসছে। ঢাকা-চিটাগাং ফ্লাইট টাইম পঞ্চাশ মিনিট। দেখতে দেখতে কেটে যায়। যাচ্ছি একটা সেমিনার এটেন্ড করতে। এনভায়রনমেন্ট এর উপর। দুইদিনের সেমিনার। আমি সরকারের মানে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। মূলত এটি একটি বিদেশি এনজিও কর্তৃক আয়োজিত দেশি-বিদেশি এনজিও ও সরকারি পার্টনার অর্গানাইজেশন নিয়ে অনুষ্ঠিতব্য সেমিনার। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলে। এর আগে ওটাতে থাকা হয়নি। তবে পাশের সার্কিট হাউজে থেকেছি অনেকবার। এই অবসরে ওদের দেওয়া ফাইল ফোল্ডার খুলে স্কেজিওল দেখছিলাম। “এক্সকিউজ মি” বলে পাশের সুন্দরী কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললেন, “আপনিও কি আমাদের সেমিনার এটেন্ড করতে যাচ্ছেন”? আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে বললাম, “কোন সেমিনার, ম্যাডাম”? সুন্দরী ফাইল ফোল্ডারের দিকে তার দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো। আমি সহজ হয়ে বললাম, “আপনিও”?
    — জ্বী। তার উত্তর।
    — কোথায় আছেন আপনি? আমার কৌতুহল।
    — এই তো আপনার পাশে ।
    — না মানে, মিনিস্ট্রির কেউ?
    — কেন মিনিস্ট্রি ছাড়া আর কেউ থাকতে পারেনা?
    — স্যরি, আই ডোন্ট মিন লাইক দেট।
    — আমি একটি বিদেশি এনজিওতে আছি। সুন্দরী সহজ হলো।
    — সো নাইস টু মিট ইউ
    — মি টু। আজই ব্যাক করবেন?
    — উহু কাল লাস্ট ফ্লাইটে। আপনি?
    — আমিও
    — গুড। আমি জোশের ঠ্যালায় বলে ফেললাম।
    — গুড কেন?
    — বাহরে দেখা হলো, গন্তব্য এক, উদ্দেশ্য এক, ফেরত যাত্রাও এক। সবই তো এক।
    — সব বলতে
    — এই তো। এগুলোই। রেডিসনেই থাকবেন তো?
    — হ্যা। আপনিও?
    — জ্বী। এখন দেখলেন তো সব এক
    — আর কি কি এক?
    — আপাতত এটুকুই। রেস্ট ইজ ইয়েট টু নো।
    কথা চালাচালি এটুকুই। সুন্দরী পানি খেলো। সেই খাওয়াতেও যেন আর্ট আছে। খাতির জমানোর জন্য বললাম, “দিস ইজ মাই কার্ড। মে আই হেভ ইওরস”? “সিওর, হোয়াই নট। ইটস মাই প্লেজার।”? তার উত্তর। ভিজিটিং কার্ডটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। ডঃ তনু শবনম। সিনিয়র কনসালটেন্ট (কনজারভেশন)। চমৎকার নাম। একেবারে ষোল আনা বাঙ্গালী নাম। সুন্দরীও আমার কার্ডটা নেড়েচেড়ে দেখলো। মুচকি হেসে বললো, “এখন বুঝেছি কেন মিনিস্ট্রির লোক ভেবেছিলেন আমাকে”? “আমরা লীড মিনিস্ট্রি, তাই পার্টনার মিনিস্ট্রির অনেকেরই আসার কথা, তাই ওরকমই ভেবেছিলাম”। আমার সরল স্বীকারোক্তি। “হয়ত আছে। আপনি তো আরেকটু হলে ফ্লাইটই মিস করছিলেন”। সুন্দরীর কথায় খানিকটা লজ্জাই পেলাম। সুন্দরী এবার আলাপ জমানোর ভঙ্গীতে বললো, “থাকেন কোথায়”? “উত্তরা” আমার জবাব শুনে অবাক হয়ে পরক্ষণেই মৃদু হেসে বললো, “কথায় বলেনা, মক্কার মানুষ হজ্জ্ব পায়না”। আমি কোন এক্সকিউজ দিলাম না। বললাম, “হুম্ম। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই”। এরিমধ্যে পাইলটের ঘোষণা এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা চিটাগাং হযরত শাহ আমানত বিমানবন্দরে নামতে যাচ্ছি। গ্রাউন্ড টেম্পারেচার গুড। ওয়েদার সানি। আমাদের সেমিনার রেজিস্ট্রেশন সাড়ে দশটায়। ইনাগোরেশন এগারোটায়। এখন প্রায় সাড়ে আটটা। পতেঙ্গা থেকে রেডিসন অনেক দূর। তবে এরমধ্যেই পৌছানো সম্ভব। মন্ত্রী মহোদয় উদ্বোধন করবেন। বিমানবন্দরে আমাদের অধিদপ্তরের লোকজন ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সৌজন্যতা করে বললাম, “গাড়ী আছে। আমার সাথে যেতে পারবেন”। “নো থ্যাংক্স। আই হেভ ট্রান্সপোর্ট রাইট ওভার দেয়ার”। শবনমের উত্তর। আমি অভ্যর্থিত হয়ে ভি আই পি লাউঞ্জের দিকে অগ্রসর হলাম। একবার মনে হলো, সৌজন্যতা করে হলেও বলি তাকে লাউঞ্জ দিয়ে বেরোতে। কিন্তু একেক জনের পার্সোনালিটি একেক রকম হয়। হয়ত অন্যভাবে নেবে। তাই চুপ থাকলাম। তবে উত্তেজনা মনের মধ্যে কিলবিল করছে। অন্তত সে তো দেখে গেছে, বুঝেও গেছে যে, আমি ভি আই পি। আমার জন্য এয়ারপোর্টে লোকজন ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করে। আর আমার যাতায়াত পথ ভি আইপি লাউঞ্জ দিয়ে।
    যথারীতি রেজিষ্ট্রেশন ইত্যাদি সেরে নির্ধারিত আসনে বসেছি। শবনমের সাথে দেখা। সেই হাসি। সেই হাই, হ্যালো। সোনালী চুল দুলিয়ে কাছে এসে বললো, “স্ন্যাক্স নিয়েছেন? ওইদিকে কর্ণারের টেবিলে আছে”। “মন্দ বলেন নি। চলেন কফি খাই”। স্ন্যাক্স খেতে খেতে আলাপ। পরিচিত অনেকের সাথে দেখা। ঢাকায় থাকলেও অনেকের সাথে দেখা হয়না অনেকদিন। পার্টিসিপেন্টদের বেশিরভাগই মহিলা। আজকাল মহিলাদের সরব উপস্থিতি সর্বত্র। একদিন একথা সহকর্মী লুবনাকে বলেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গ বারুদ জ্বলার মত জ্বলে উঠে, “জ্বলে নাকি”? আমি হাসতে হাসতে বললাম, “জ্বলে তো। খুব জ্বলে। হৃদয়ে ক্ষরণ হয়”। এই উত্তরে লুবনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “সে কি রকম? অনেকের জ্বলে। মেয়েদের এগিয়ে আসা মেনে নিতে পারেনা। তাদের জ্বলতেই পারে। কিন্তু হৃদয়ে ক্ষরণ হয় কেন”? ভাবছি কি উত্তর দেওয়া যায়? সিরিয়াস হলে জেন্ডার এলার্জির তকমা গায়ে লেগে যেতে পারে। তাই কথার মোড় ঘুড়িয়ে দিয়ে বললাম, “ম্যাডাম, সর্বত্র এত এত ডানা কাটা পরী দেখলে চোখ ঝলসে যায়, মন পোড়ে, আর কোনটা রেখে কোনটা ধরির দ্যোতনায় পরে যাই”। লুবনা সিরিয়াস হতে গিয়েও হেসে উঠলো, বললো, “বেশির ভাগ পুরুষের চোখ খারাপ। মন কুশ্রী। আর মানসিকতা অতি নিম্ন মানের”। কথা দোষের না। ঠিকই আছে। তবে পুরুষ জাত নিয়ে কথা বলায় লাগলো। বললাম, “ম্যাডাম, এত সেজে গুজে চোখের সামনে ডানা কাটা পরী হয়ে ঘুরলে পুরুষের চোখের ওয়াইপার কতক্ষণ বন্ধ রাখা যায় বলুন তো। আর চোখের সাথে মনের ইন্দ্রিয়গত ইনবিল্ট বন্ডেজ আছে। এতে পুরুষেরই ক্ষতি। গুনাহর পাহাড় সুউচ্চ হয়”। লুবনা খুব মন দিয়ে নিরীক্ষণ করলো। বললো, “কি যে আমার সুফী পুরুষ এক একজন? দেখা আছে। আপনি কথা বলেন কাটাকাটা। তবে মধুর প্রলেপ দিয়ে। যে কেউ ইনক্লাইন্ড হতে বাধ্য”। এভাবেই লুবনার সাথে ঘনিষ্ঠতা। এক সাথে চাকরি। সেমিনার চেয়ারে বসে এসব কিসব আজেবাজে ভাবছি। উদ্বোধনী পর্বের বক্তৃতা চলছে। মন্ত্রী মহোদয় প্রধান অতিথি। সেমিনারের সাবজেক্ট এনভায়রনমেন্ট হলেও মন্ত্রীর তোষামোদিতে সবাই যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি এনজিওরাও কম যায় না। বাণিজ্যে লক্ষীর বসতি। সবই গিভ এন্ড টেক এর খেলা।
    প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ। সন্ধ্যায় পতেঙ্গায় বিমান বন্দরের কাছে বোট ক্লাবে স্ন্যাক্স ও ডিনার। সাথে সান্ধ্য ও রাত্রিকালীন সৈকত ভিউ ফ্রি। সবাই দল বেধে গেলাম। শবনমকে দেখলাম মহিলা মহলে। বার কয়েক চোখাচোখি হলো। তার ভাবসাব নির্লিপ্ত। মনটা খানিকটা আহত হলো। পরক্ষণেই লজ্জা পেলাম। কোথাকার কোন মেয়ে আজই প্রথম ফ্লাইটে পরিচয়। তার সংগ চাহিদা কি সংগত? অন্য কলিগ ও পরিচিতজনদের সাথে কথা বলছি আর চোখ রাখছি শবনমের ম্যুভমেন্টে। কালো ড্রেসে তাকে আরো গর্জিয়াস লাগছে। হঠাৎ তাকে আবিষ্কার করলাম একগাদা ইয়াং ডেলিগেটের সাথে। কিছু নেভী অফিসারকেও দেখলাম সেখানে। হাসির হল্লাতে শবনমকে দেখলাম স্যাটেলাইটের মত আলো ছড়াচ্ছে। বুকের খুব ভেতরে পৌরুষ হিংসা থেকে থেকে ফালি ফালি করে দিচ্ছে। লুবনার কথা মনে পড়লো। লুবনাকে নিয়েও এমন হয়েছিলো। কোন পুরুষ তার সাথে কথা বললে লাগত, বস ডেকে পাঠালে মেজাজ বিগড়ে যেত। দেরি হলে গোস্যা হত। এর ছাপ পড়ত তার সাথে আচরণে। একদিন খুলেই বললাম, “আজকাল অফিসে দেখছি তোমার অনেক ফ্যান-ফলোয়ার হয়েছে”।
    — যেমন? লুবনার কৌতুহল।
    — এই যে সবাই তোলা দিয়ে তোমার সাথে মাখো মাখো হয়ে কথা বলে।
    — তো
    — কাজ ফেলে প্রায় সময়েই নানা ছুঁতোয় আলাপের আয়োজন করে
    — তো
    — বসও দেখছি আজকাল ঘন ঘন ডাকে
    — তো
    — এই তো এসব দেখছি আরকি।
    — জ্বলে?
    — জ্বলে তো
    — কেন?
    — জানিনা
    — এত কিছু নিয়ে ভাবো?
    — না, শুধু তোমাকে নিয়েই ভাবি
    — ভাবা বন্ধ করে দাও। দেখবে সব স্বাভাবিক লাগছে।
    — পারছিনা তো
    — ডাক্তার দেখাও। নইলে হার্ট উইক হয়ে যাবে।
    সেমিনারে টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা চলছে। বেশিরভাগ লোকই ঘুমুচ্ছে। আজ ফেরার দিন। তাই, সব কিছুই কিছুটা ঢিলেঢালা। আমারও ঝিমুনি ভাব এসেছিলো। লুবনা আর শবনমকে নিয়ে ভাবাভাবিতে সে ভাব অনেকটাই কেটে গেছে। শবনমকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। ওয়াশরুমে যাবার উছিলা করে দেখে এলাম চারপাশ। কোথাও নেই। আশ্চর্য।
    সেমিনার শেষ। যে যার স্কেজিউল মত ফ্লাইট ধরতে চলে যাচ্ছে। আমার ফ্লাইট রাত সাড়ে সাতটায়। পাঁচটা নাগাদ রওনা হয়ে গেলাম। সাথে স্থানীয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আছে। প্রটোকলের দায়িত্বে। ফ্লাইট আধাঘন্টা ডিলে। ভি আই পি লাউঞ্জে বসে আছি। টিভি মনিটরে ফ্লাইট অপারেশন স্কেজিউল দেখাচ্ছে। শবনমের কথা মনে হলো। তারও এই ফ্লাইটে যাওয়ার কথা। হয়ত এই এয়ারপোর্টেই আছে কোথাও। ক্রাফটে দেখা হলো। এবার আর একসাথে সীট পড়েনি। আমি তার অন্যপ্রান্তে। শবনমের পাশে একজনকে দেখলাম। সেমিনারে তাকে দেখেছি বলে মনে হলো না। আরো দেখলাম তারা বেশ হাস্যোজ্জ্বল ম্যুডে আছে। আমার সেই প্রাচীন ব্যামো পেয়ে বসলো। জীবনানন্দীয় উপলব্ধি মাথায় ভর করলো। কি এমন কথা তার সাথে? ভেবে পাচ্ছিনা। পরক্ষণেই মনে হলো কিসের মধ্যে কি! এতসব আবোল তাবোল ভাবছি কেন? লুবনার কথা মনে পড়লো। একদিন বলেছিলাম, “এত ভাল, ভালো না”।
    — কি?
    — বললাম সবার কাছে ভালো থাকার চেষ্টা ভালো না
    — মানে কি? লুবনার বিস্ফোরণ
    — এই যে সবাই তোমার সঙ্গ পেতে মেতে উঠেছে
    — আশ্চর্য! এতে তোমার কি?
    — কিছু না। ইটস লুক ওড
    — দিস ইজ টু মাচ। কান্ট বিয়ার। ইউ নীড আ পার্মানেন্ট সায়াক্রিয়াট্রিস্ট। শেষের কথা দিয়ে সে কিসের ইঙ্গিত করলো বুঝলাম না।
    ফ্লাইট মাঝ আকাশে। এখনো সেই ছেলে আর শবনম ননস্টপ হাস্যালাপ করে যাচ্ছে। এত হাসির কারণ কি? মাঝেমধ্যে চোখাচোখি হয়েছে। থতমত খেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। সামনে পেপার মেলে ধরা। চোখ সেখানে নিবদ্ধ। কিন্তু মন পড়ে আছে শবনমে।
    চিটাগাং-ঢাকা ফ্লাইট যেন এই উঠা আর এই নামা। নামার সময় দেখা হলো। সেই ছেলে শবনমের বডি গার্ডের দায়িত্ব পালন করছে। কাছে গিয়ে বললাম, “সি ইউ সুন। টিল দেন বেস্ট অফ লাক”। সেই কথার প্রেক্ষিতেই শবনম সেই বডিগার্ডকে পরিচয় করিয়ে দিলো, “মিট মাই বেস্ট ফ্রেন্ড কামার জামান। নেভাল অফিসার”। ভদ্রতাসূচক হাই-হ্যালো হলো। গা জ্বলে যাচ্ছে। মন পুড়ে ছাড়খাড়। নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। বুঝলাম লুবনার কথাই ঠিক। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। আমার এখন লুবনার মত একজনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা জরুরী হয়ে পড়েছে।

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (শেষ পর্ব-৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (শেষ পর্ব-৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা।
    লজিং মাস্টার
    (শেষ পর্ব)
    আনোয়ার হাকিম।

    দেখতে দেখতে বিসিএস প্রিলি রেজাল্ট বের হলো। পাস করে আমি যতটা উল্লসিত তার চেয়ে বেশি উল্লসিত বাবা-মা। তাদের উল্লসিত হওয়ার কারণ যৌক্তিক। কিন্তু কেয়া আর ছায়ার উচ্ছ্বাস দৃষ্টি কটু। আমি হাসি। ভাবছি বাবাকে বলে অন্যত্র শিফট হবো। একটা কিছু যুক্তি দেখিয়ে দিলেই হবে। দুরন্ত বিপ্লব আর ছায়ার রেজাল্ট তাদের ক্যালিবারের তুলনায় যথেষ্ট ভালো হলো। আমার কদর আরো বাড়লো। ওদিকে কেয়া মুখ অমবস্যা করে রাখে। আগের সেই উচ্ছ্বলতা আর নেই। কথা বললে দশ কথায় এক উত্তর মিলে। আগে খোঁচা দিত। এখন আর দেয় না। মেয়েরা যখন ভালোবাসার রেসে হেরে যায় বা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করে তখন মুষড়ে পড়ে বা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমি কি বালিকাদের মাইন্ড রিডার হয়ে যাচ্ছি? অথচ এই কয় বছর আগেও মেয়েদের নিয়ে এত গবেষণা বা অতি আগ্রহের জায়গাটা এত প্রকট ছিলো না। কেয়ার জন্য ভালো ভালো সম্পর্ক আসে। কিন্তু সে কোনটাতেই রাজী হয় না। তার বাবা-মা হতাশ। আন্টি একদিন ডেকে নিয়ে এগুলোই বললেন। আমার আইকিউ যদি কিছুটা থেকে থাকে তাহলে সঠিক আঁচ করতে পেরেছি আন্টি কেয়ার রোগের কারণ ধরতে পেরেছেন। মেয়েরাই মেয়েদের ভালো পরীক্ষক। তিনি ধরেই নিয়েছেন কেয়া আমার প্রতি ইনক্লাইন্ড। আসলে তিনি আমার মনোভাব জানতে চাচ্ছেন। আমার অন্তরাত্মা ভেতর থেকে গুন গুনিয়ে বলে উঠলো, ‘পালা। এখনো সময় আছে। বাঁচতে চাইলে পালা”। আমি পালাবার পথ খুঁজছি। ছায়ার আম্মাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম। বললাম আমাকে রিটেন এক্সামের জন্য গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে পড়তে হবে। তাই চার বন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। সেখানেই উঠবো আগামী মাস থেকে। আন্টিও পাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, “তিন তলার ফ্ল্যাট আগামী মাস থেকে খালি হচ্ছে তোমরা এখানে এসে উঠো”। আমার প্ল্যান ভেস্তে যেতে বসলো। হাল ছেড়ে এখানেই চিলে কোঠায় পেয়িং গেস্ট বা লজিং মাস্টারের তকমা নিয়ে থাকলাম। আর কেয়া-ছায়ার খেলা দেখতে থাকলাম। আপদ সরাতে দু’জনকেই বললাম, “আমার অন্যত্র কমিটমেন্ট আছে। বিসিএস হয়ে গেলেই উই উইল টাই আপ টুগেদার”। মনে করেছিলাম আমার এই চায়নাম্যান গুগলিতে পরপর দুই বলে দুই উইকেটের পতন হবে। হাফ ছেড়ে বাঁচবো। কিন্তু হলো আরো বিপদ। উভয়েই মরিয়া হয়ে মাটি কামড়ে ক্রিজে পড়ে থাকার প্রানান্তকর প্রয়াস চালাতে থাকলো। কেয়ার স্ট্রেংথ সে আমার ক্লাসমেট, আর সরকারি কর্মকর্তা বাবার একমাত্র মেয়ে। আর ছায়ার স্ট্রেংথ হলো আমার উইকনেস। আমি লজিং মাস্টার, বাবার বন্ধুর ছেলে। তার ছোট ভাইয়ের প্রাইভেট টিউটর। এতদিন জানতাম ছেলেরা মেয়েদেরকে ইভ টিজিং করে। আর এখন দেখছি ছায়া, কেয়া উভয়েই আমাকে বিভিন্ন ভাবে সময় সুযোগ পেলেই টিজ করে। কেয়ারটা মেনে নেওয়া যায়, সে আমার ক্লাসমেট। কিন্তু ছায়া? সে তো অনেক জুনিয়র। দুরন্ত বিপ্লব এখন ফার্স্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার ম্যুডে। তার সময় কম। আর ছায়া মেডিক্যাল ভর্তির জন্য যুদ্ধ করছে। তাকে এখন প্রায় সময়ই ছেদে দেখি। একদিন দেখা মাত্র বললাম, “সারাক্ষণ ছাদে ঘুরঘুর করো কেন”?
    — “কেন আপনার ডিস্টার্ব হচ্ছে? হবেই তো”। ছায়ার খোঁচা। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে মেয়েদের মত এত নিপুণ শিল্পী আর হয়না। বললাম, “তোমার না সামনে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা”? কথা বলে শেষ করতে পারিনি ততক্ষণে ছায়ার পাল্টা হামলা, “আপনারও তো বিসিএস পরীক্ষা। সারাক্ষণ ছাদের দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে বসে থাকেন। কখন উনি আসবেন সেই অপেক্ষায়”। বুঝলাম আমার মান-সম্মানে টান পড়েছে। আর এও বুঝলাম বালিকাদের নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা ঠিক না। এতে লাভ নেই, অহেতুক বিড়ম্বনা বাড়ে । বললাম, “আর কিছু বলবা”?
    — বলতে তো চাই
    — বলে ফেলো
    — লাইন ক্লিয়ার পাচ্ছি না তো
    — ব্যস্ত সংসারে লাইন ক্লিয়ার পাওয়া খুব কঠিন। দেখো না মোবাইলে বাজে “দা নাম্বার ইউ ডায়ালড ইজ বিজি নাও প্লিজ ট্রাই আফটার সাম টাইম”।
    — কারো মন ডিএক্টিভ থাকলে ঢুকবো কি করে?

    এই কথার পর আর কথা চলে না। বালিকাদের সাথে তর্ক করা মানে নিজের আহাম্মকি প্রকাশ করা। কেন জানি বললাম, “তুমি তো আমার অনেক জুনিয়র। কথাতে তো মা শা আল্লাহ পাকা”। এ কথায় বোমা বিস্ফোরণের মত হলো। এক ঝটকানি দিয়ে মুখের কাছে মুখ এনে ঝামটা মেরে বললো, “থাকেন আপনি ঐ বুড়িরে নিয়ে”। আমি হতভম্ব। ছায়া বিকট আওয়াজ করে ছাদের দরোজার উপর রাগ দেখিয়ে শব্দ করে চলে গেলো। সেই শব্দের উৎস সন্ধানে কেয়া তদন্তে এলো। তদন্ত একটা বাহানা মাত্র। বললো, “কে এসেছিলো? আর দরোজায় এত শব্দই বা হলো কেন”? আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। এখানে থাকলে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো। কথা কমাতে, ঝামেলা এড়াতে বললাম, “কই কেউ না তো। হয়ত বাতাসে শব্দ হয়েছে”। বালিকারা গোয়েন্দাগিরিতে দক্ষ। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিকই বের করে ফেলেছে ছায়া এসেছিলো। মেয়েলী পারফিউমের গন্ধ নাকি পাওয়া যাচ্ছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক। হে ধরণী দ্বিখন্ডিত হও, আমি প্রবেশ করি। আমার লেখাপড়া রসাতলে যাওয়ার পথে। যাওয়ার পথে কি? অলরেডি চলে গেছে। নিজেকে এ মুহুর্তে খুব অসহায় লাগছে। কেয়া এসে বললো, “ল্যান্ড লর্ডের মেয়ে এত ঘন ঘন কেন আসে তোমার কাছে? কি চায় সে”? কেয়ার কথা আমি ক্লাসমেট বিবেচনায় রসিকতা হিসেবে নেই। আজ তার কথা মর্মে গিয়ে লাগলো। রক্ত গরম করে দিলো। বিশেষত তার শব্দ চয়ন অত্যন্ত নিম্নমানের আর আপত্তিকর ঠেকলো। ‘ল্যান্ড লর্ড’ শব্দ উল্লেখ করে প্রকারান্তরে সে আমাকে চূড়ান্ত হেয় করেছে। বললাম, “তুমি কেন আসো? কি চাও আমার কাছে”?
    — আমি তোমার ক্লাসমেট
    — তো
    — আমাদের কথাবার্তা থাকতেই পারে
    — তো
    –ওই অল্প বয়সী মেয়ের চেয়ে আমি কম কিসে?
    — তো
    — কত ভালো ভালো প্রপোজাল এসেছিল। না করে দিয়াছি
    — কেন?
    — তোমার মাথা খাবো বলে। এই বলে একই রুপ আওয়াজ তুলে ছাদের দরোজায় প্রচন্ড ধাক্কা মেরে কেয়া চলে গেলো।

    অবশেষে আমার বোধোদয় চূড়ান্ত হলো। এনাফ ইজ এনাফ। হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোন খানে আমার গন্তব্য গাড়তে হবে। অতএব ব্যাক টু স্কয়ার। সেই আগের আইডিয়াতেই ফিরে যেতে হলো। চার বন্ধু মিলে তড়িঘড়ি করে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। বাবাকে বললাম গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে বাকি ক’মাস না পড়লে হবে না। বাক্স পেটরা নিয়ে যাবার সময় নাটক হলো। কেউ কিছু বুঝলো না। আমি বুঝলাম। খবরটা জানার পর থেকে আন্টির সে কি দশা!

    এদিকে বাবার শারিরীক অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকলো। বড় বোনের বিয়ের সম্মন্ধ আসতে থাকলো। বয়স বেশি হয়ে গেলে মেয়েদের সম্পর্ক আগের মত আর আসেনা। আসলেও কেন বিয়ে হয়নি সে প্রশ্ন দারুণ প্রশ্নবোধক হয়ে ঘুরপাক খায়। কনে পক্ষ হিসেবে অস্বস্তি বোধ করি। বড় আপা তো বটেই। শেষমেশ বড় আপার বিয়ে হয়ে গেলো। হাসবেন্ড ভার্সিটির কেমিস্ট্রির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।

    সেই ছায়া মেডিক্যালে চান্স পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। আমার উপর তার ভীষণ অভিমান আর ক্ষোভ। তার মনে হয়েছে আমি তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেইনি। জুনিয়র বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ভাবটা এমন যে, এবার তার দেখাবার পালা। আন্টি বাসায় ডেকে পাঠালেন। সবাই খুব খুশি। স্বল্প দিন হলেও ছায়া আমার ছাত্রী ছিলো। তাই আমারও খুশী লাগছে। দেখা হতেই বললাম, “কংগ্রেচুলেশন”। ফোঁড়ন কেটে বললো, “থাক লাগবেনা”। বললাম, “খবরটা শোনার পর থেকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে”।
    — কেন?
    — বাহরে। এত ভাল করেছো। মেডিক্যালে চান্স পায় কয়জন?
    — কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছেন?
    — কখনো কি এমন বলেছি?
    — নিতেই পারেন। আফটার অল টিচার ছিলেন তো
    — খোঁটা দিচ্ছো?
    — মোটেই না। আমি বরং আপনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ
    — কেন?
    — আপনার অবজ্ঞা আমাকে জেদি করেছে। আমি নিজেকে সেভাবেই প্রিপেয়ার্ড করেছি। লিভ ইট। আপনার সেই
    কেয়া না ফেয়ার খবর কি?
    — যোগাযোগ নেই
    — আহারে। সো স্যাড। পাখী অন্য ডালে বসেছে বোধহয়।
    — প্লিজ স্টপ ইট।
    — খুব লাগলো বুঝি?

    ছায়াদের বাসা থেকে ফিরে ভাবছিলাম এলোমেলো অনেক কিছু। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রেক্ষাপটই আলাদা। এখানে শিক্ষার আলো থাকে, নীতিবোধ পরিষ্কার থাকে, মান-অপমানবোধ টন্টনে থাকে। সীমাবদ্ধতা যেমন থাকে তেমনি স্ব-আরোপিত বিধি-নিষেধও থাকে। আর্থিক টানাপোড়েন থাকে কিন্তু সন্তুষ্টিও থাকে। এডজাস্টমেন্ট এদের জীবনে সহজাত। আর দশজনের মত তাদেরও সাধ-আহ্লাদ থাকে। আবেগ অনুভূতিও টইটম্বুর থাকে। এদের জীবনেও প্রেম আসে। কখনও গোপনে, কখনও সিনেমেটিক ধাক্কা মেরে।

    এর মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা পর্যায়ক্রমিক ঘটে গেছে। আমার বিসিএস এর নিয়োগপত্র এসেছে। স্বপ্ন পূরণের আনন্দে বাবার চোখে অশ্রু দেখেছি। মা জড়িয়ে ধরে ছোটবেলার মত মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়েছে। গ্রাম জুড়ে আনন্দোৎসব। বাড়ী ভর্তি লোকজনের সমাগম। ছায়া রংপুর মেডিক্যালে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। খুশিতে ঘন ঘন ফোন দেয়। লম্বা সময় ধরে কথা বলে। ইদানীং তার কথাবার্তায় ওজন বেড়েছে। সেই সাথে প্রভাব বিস্তারের মনোভাবও। আর কেয়া হুট করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শুনেছি কানাডা প্রবাসীকে বিয়ে করে কানাডায় চলে গেছে। ভালোই করেছে। এরিমধ্যে বোনের ছেলে হয়েছে। আব্বার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতিও হয়েছে।
    কাকতালীয়ভাবে আমার পোস্টিং হয়েছে রংপুর ডিসি অফিসে। বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মা খেতে দিয়ে পাশে বসে বললো,“ছায়াকে কেমন লাগে”? আমি কিছু না বুঝেই উত্তর দিলাম,“কোন ছায়া”? পরক্ষণেই বুঝতে পেরে বললাম,“কেন, কি হয়েছে”? মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,“তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিলো। তাই”। বুঝলাম বাবার পছন্দ। পরে আরো শুনলাম উভয় পরিবার এরিমধ্যে গোল টেবিল বৈঠকে বসে প্রাথমিক আলাপ সেরেও রেখেছে। ছায়াও জানে। সে রাজী। হঠাৎই মনে পড়ে গেলো কয়েকদিন আগের কথা। ফোনালাপের এক পর্যায়ে ছায়া আচমকা বলে বসলো,“অবশেষে সব পাখী ঘরে ফিরে”। আমি কিছু না ভেবেই জাস্ট মজা নেওয়ার জন্য বলেছিলাম,“পাখী এখন মগডালে”। ছায়াও কম যায় না। বললো,“ডানা কেটে দিলে ঠিকানা এই হাসপাতালে”।

    তার এই কথার শানে নুযুল এখন বুঝতে পারছি।

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    লজিং মাস্টার
    আনোয়ার হাকিম

    পর্ব-২
    আরেকটা বিপদ আচমকা যুক্ত হলো। এই চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ীর একটিতে যে আমার সহপাঠী কেয়ারা ভাড়া থাকে তা আমার জানা ছিলো না। আমি মেয়েদের এড়িয়ে চলি। তবে সব সময় পারিও না। ভাল ছাত্রের তকমা থাকায় সহপাঠীরা পাঠোদ্ধারের জন্য আসত। তাদের মধ্যে মেয়েরাই একটু বেশি। এদের বিভিন্ন ছল, বিভিন্ন আবদার। সবই বুঝি কিন্তু মেধাবীর স্বীকৃতির ঘ্রাণ সুমিষ্ট বোধ হওয়ায় এড়িয়ে যেতেও মন সায় দেয় না।

    একদিন শীতের বিকেলে দুরন্ত বিপ্লবকে বশে আনবার প্রয়াসে ব্যাট বল খেলছিলাম। প্রশস্ত ছাদের এক কোণায় শুকনো কাপড় নেওয়ার নাম করে ছায়ার ছায়া ঘুরঘুর করছে। এমন সময় অকস্মাৎ কেয়া এসে হাজির। আমাকে দেখে সে সশব্দে এমন আবেগ প্রকাশ করলো যেন পারলে সিনেমার নায়িকার মত দু’হাত প্রশস্ত করে বাহুলগ্না হয়। সেই আবহসংগীতসহ দৃশ্য ছায়া’র নজরে এলো। শীতের বিকেল টুপ করে ছাদে সন্ধ্যার আগমনী ছায়া ফেললো। একটু পরেই মাগরিবের আযান দেবে। এরপর রুটিন মোতাবেক দুরন্তকে ঘন্টাখানেক সাইজ করার দায়িত্ব। দুরন্ত বিপ্লবকে বিদায় করলাম। ছায়া বিস্ময়ের ঘোর অমানিশা নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। বাকি থাকলাম আমি আর কেয়া। কেয়ার সে কি আনন্দ! সন্ধ্যায় আমাকে কেয়াদের বাসায় যেতেই হবে এই তার বায়না। কোন কথাই সে শুনবে না। মান-সম্মানের বিষয়টি বরাবরই আমার প্রায়োরিটি লিস্টের শীর্ষে থাকে। শীতের এই কাল সন্ধ্যায় সহপাঠী কেয়ার সাথে কেউ এভাবে দেখলে কি থেকে কি ভেবে বসে থাকবে কে জানে? আর তার সাথে কি এমন কথা থাকতে পারে যে অধিককাল চলতে পারে? বলে রাখা ভালো কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে তো বটেই পুরো কলেজেই হাতেগোনা নীলাঞ্জনা টাইপের মধ্যে সে অন্যতমা। কেয়া ভালো আবৃত্তি করে, ভাল গান গায়। কলেজের প্রতিযোগিতায় এ দুই বিভাগে সে চ্যাম্পিয়ন।
    এরুপ বিব্রতকর ও ইতস্ততবিক্ষিপ্ত অবস্থায় লক্ষ্য করলাম ছায়া দুরন্ত বিপ্লবকে নিয়ে ছাদে কি খুঁজতে যেন ফিরে এলো। বুঝলাম কেয়ার উপস্থিতি চাক্ষুষ করতেই তার এই অনাবশ্যক আগমন। মাগরিবের আযান চলছে। আমি কেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সন্ধ্যার পর তাদের বাসায় যাবো এই ওয়াদা কবুল করতে বাধ্য হলাম। কেয়া নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পর ছায়ার আর থাকার আবশ্যকতা নেই। দেখলাম আমার এ ভাবনা যথার্থ। হাসিও পেলো। বাবার মুখটা ভেসে উঠলো। বিসিএস আর ম্যাজিস্ট্রেট ভিন্ন আমার আর কোন এজেন্ডা নেই। থাকতে পারেনা। থাকা উচিত না। সন্ধ্যার পর কেয়াদের বাসায় গেলাম। কেয়ার আম্মা অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। রাশভারি। তাই বাসায় থাকলেও তাঁর দর্শন মিলেনি। কেয়া তাদের একমাত্র সন্তান। কেয়াকে এতই উচ্ছ্বল লাগলো যা আগে কোনদিন দেখিনি। বুঝলাম তার মনে প্রচুর আনন্দ খেলা করছে। আর মননে কি খেলছে তা জানার সাধ্য নাই। এদিকে ঘটেছে আরেক বিপত্তি। কেয়াদের বাসায় অপরিকল্পিত এই সৌজন্য সাক্ষাতে যাওয়ার খবর দুরন্ত বিপ্লবকে জানাতে ভুলে গেছি। এই নিয়ে কারো অনুযোগ নেই। কিন্তু বিষয়টি যে ছায়ার মনঃপূত হয়নি তা বুঝতে বাকি থাকলো না।

    বিসিএস এর প্রিপারেশন জোরেশোরে চলছে। আমার কাছে মাস্টার্সের চেয়ে এটাই এখন টপ প্রায়োরিটি। কলেজ বন্ধ। ঘন ঘন বাড়ী না গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বাবার তাগাদা অব্যাহত। এরকম একদিনে বসে বসে ভাবছিলাম অনেক কিছু। জীবনের রঙ কিরুপ? উদ্ভট এ জিজ্ঞাসা মননে মগজে কেন এলো বুঝে উঠতে পারলাম না। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় মনে হলো জীবনের রঙ স্বচ্ছ প্রিজম কাঁচে আলোর প্রতিসরণের মত। যেভাবে আলো ফেলবেন ঠিক সে বরাবর অগ্রসর হবে না। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।

    দুরন্ত বিপ্লবকে বশীভূত করার প্ল্যান প্রাথমিক ভাবে ক্লিক করেছে। আমি তার সার্বক্ষণিক খেলা বিষয়ক সাথী। বিশেষত ক্রিকেটের। এভাবে সে হয়ে উঠেছে আমার অনুরক্ত ভক্ত। আমার চূড়ান্ত প্ল্যানও কাজ করেছে এক শর্তে। বিকেলে ক্রিকেট, নো ইন্টারফেরেন্স। আর বাকী সময় পড়ালেখা, নো ছলচাতুরী। এক্ষেত্রে আমাকে প্রায়ই নানা উপলক্ষ্য তৈরি করে প্রাইজ হিসেবে কিছু ইনভেস্ট করতে হয়। মানুষের সামনে টার্গেট না থাকলে জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে মৃগী রুগীর মত ভীমড়ি খেতে থাকে। ইংরেজী আর অংকে সে কাঁচা। ভালো করলেই পুরষ্কার মিলবে এমন ঘোষণায় কাজ হলো চমৎকার। আন্টি ডেকে পাঠালেন। বাসায় ঢুকতেই পোলাও পোলাও গন্ধ। বুঝলাম আজ রীচ ফুড হবে। কলিং বেল টিপতে দেরি কিন্তু দরোজা খুলতে সময় লাগলো না। ছায়া দাঁড়িয়ে। ছায়ার সাথে আমার কথা হয়না তেমন। সেও বলেনা। কিন্তু মুখটা দুখু দুখু করে রাখে। যাদের মুখশ্রী সুশ্রী তাদের এরকম দুখু দুখু মুখ আলাদা বিভা ছড়ায়। বললাম, “ভালো আছো”? সোজা উত্তর না দিয়ে বললো, “আসেন। ভেতরে এসে বসেন”। আন্টি এলেন। তারিফ করলেন। ছায়া যে দরোজার আশপাশ দিয়ে অযথা যাতায়াত করছে টের পাচ্ছি। দুরন্ত বিপ্লব এলো। আন্টি উঠে গেলেন। বললাম, “এবার অংকটাকে কুপোকাত করতে হবে”। বিপ্লব মাথা নাড়লো। আচমকা বলে ফেললো, “আপু অংকে আমার চেয়েও কাঁচা”। আমি বললাম, “কে বললো? তুমি বুঝলা কেমনে”? ছায়া দরোজার পাশেই ছিলো। বললো, “বিপ্লব এদিকে আয়”। বিপ্লব গেলো না। মুচকি হেসে বললো, “ধরা খেয়ে আপু লজ্জা পেয়েছে”। যাহোক, একদিন ছাদে ছায়াকে পেলাম। সাজুগুজু করে এ সময় ছাদে আসার কোন অর্থ নেই। বললাম, “তোমাকে তো ছাদে এখন কম দেখি”।
    — ঠিকই আসি। আপনিই দেখেন না। ছায়ার ত্বরিত উত্তর।
    — সে কি রকম? আমি তো ছাদেই বাস করি।
    — কেয়া আপু আছে না?
    রোগের লক্ষ্মণ ধরা পড়েছিলো আগেই। আজ এর কারণ জানা গেল। বললাম, “কেয়ার সাথে তোমার কি? সে তোমার সিনিয়র আর আমার ক্লাসমেট”। ছায়া নিরুত্তর থাকলো। বললাম, “পড়াশোনা কেমন চলছে”?
    — পড়াশোনা ভালো লাগেনা
    — তাহলে কি ভালো লাগে?
    — জানিনা।
    — বাহ। কিছুই ভালো লাগেনা?
    — লাগে
    — সেটা কি?
    — বলা যাবে না।
    সিঁড়িতে কেয়ার কথা শুনে বলে উঠলো, “ওই যে আপনার প্রিয় বান্ধবী আসছে”। বলেই নেমে গেল। কেয়া এলো। ছায়া নেমে গেলো। ছাদ থেকে কাপড় নিতে নিতে কেয়া বললো, “লজিং মাস্টার ভালো আছেন”? আঁতে ঘা লাগলেও নিছক দুষ্টুমী ভেবে পাল্টা মিসাইল ছুঁড়ে দিলাম, “কেন জ্বলছে নাকি”?
    — হুম্ম। খুব জ্বলে। জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছি। কি করছো?
    — বিসিএস প্রিপারেশন
    — প্রিপারেশন না ছাই। ওই মেয়ে সারাক্ষণ তোমার চতুর্দিকে ঘুরঘুর করে কেন? যখনই ছাদে আসি তখনই দেখি
    — এ তোমার ভারি অন্যায়
    — বাহ। খুব দরদ দেখছি তার জন্য
    — লিভ ইট। তোমার খবর কি?
    — খবর ভালো না
    — কেন? কি হয়েছে?
    — বিয়ের কথা হচ্ছে
    — ভালো তো। পাত্র কি করে?
    — বিসিএস ক্যাডার
    — বাহ। ঝুলে পড়ো
    — অত সহজ না। না করে দিয়েছি
    — কেন? চয়েস আছে নাকি?
    — আছে তো।
    — তাহলে তাকেই করে ফেলো
    — সমস্যা আছে
    — কি সমস্যা?
    — সে তো কেলাস টাইপের। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে। আর ইদানীং বালিকা নিয়ে।

    তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমি আহত হলাম। বললাম, “এ তোমার ভুল ধারণা”। “পুরুষ মানুষদের চেনা আছে” বলে কেয়া চলে গেলো। কি চেনা আছে বুঝলাম না। বাবা-মা’র কথা মনে হলো। আমি কি টার্গেট থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি? দুরন্ত বিপ্লবের রেজাল্টের অভাবিত উন্নতি হলো। এই দেখে আন্টির আবদার ছায়াকে শুধু ম্যাথটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে। বিসিএস প্রিপারেশনের দোহাই পেড়েও কিছু হলো না। রোজ এক ঘন্টা করে ফ্ল্যাটে গিয়ে ম্যাথ বুঝাতে হলো। এতে আমি মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ। ছায়া উৎফুল্ল। আমি যত সিরিয়াস। ছায়া তত অমনোযোগী। সিলেবাসের বাইরেই তার মনযোগ বেশি। আমাকে ঘিড়ে তার প্রচুর কিওরিসিটি। খালি গল্প করতে আর কথা বলতে চায়। আমার শংকা বাড়তে থাকলো। অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে পাগলামী স্বভাব প্রকট হয়। যাকে কাছে পায় তাকেই পছন্দ হয়। ভালো লাগে। ক্ষণিকের মোহ আরকি। বাবার বন্ধুর মেয়ে। একটু সন্দেহ বা কোন ঘটনা ঘটলে আমার জীবন যতটুকু না চৌচির হবে তার চেয়ে বেশি হবে বাবা-মা’র। যেদিন থেকে এই পার্ট টাইম ডিউটি খাটছি সেদিন থেকে কেয়ার ম্যুড অফ। আমার কোনই ভূমিকা নেই কোন কিছুতে। অথচ উভর পক্ষের মামলায় আমি একমাত্র আসামী।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    লজিং মাস্টার
    আনোয়ার হাকিম

    পর্ব-১
    আমার বিপদ অবর্ণনীয়। অসহনীয়ও বটে। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি গ্রামদেশে জায়গীর মাস্টারের শেষ পরিণতি হয় ঘর জামাই হিসেবে। প্রাইভেট টিউটরের সাথে ছাত্রীর প্রেম অবশ্যম্ভাবী। আর সহপাঠীর সাথে প্রেম কাহিনী সর্বজন বিদিত। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একেক জনের কপালে একেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে থাকে। আর তার পরিণতিও একেক রকম হয়ে থাকে। কিন্তু একসাথে এই ত্রিশংকু অবস্থা কারো জীবনে নাযিল হয়েছে বলে শুনিনি। আমার হয়েছে সেই দশা।

    ছোটবেলা থেকেই ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় বাবার বিশেষ দৃষ্টিতে পড়লাম। সাথে অসীম ছাড়। আম্মা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন। কারো কুনজরে যেন বিদ্ধ না হই সেজন্য মাঝে মধ্যেই আচমকা জড়িয়ে ধরে দোয়া-দরুদ পড়ে বিশাল বিশাল ফু দিতেন। ছোট ছিলাম। পরীক্ষা বা টেনশনের কিছু হলে আমিও আম্মার কাছে গিয়ে ফু দাবী করতাম। জুনিয়র স্কলারশীপেও গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পেলাম। বাবার প্রত্যাশা বাড়তে থাকলো। মুখে সুখের হাসিও ঝিলিক দিতে থাকলো। পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন আর সহপাঠীদের কাছে বলা যায় হিরো বনে গেলাম। বাবা উপজেলা সদরের ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। রোজ রোজ সাইকেলে প্যাডেল চেপে আসা-যাওয়া করতাম। মাধ্যমিকেও ভালো রেজাল্ট হলো। পাল্লা দিয়ে অপত্য স্নেহও বাড়তে থাকলো।

    শহরের ভালো কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো বিচিত্র। পড়াশোনার বাইরে আমার অন্য ধান্ধা নাই। সহপাঠীদের সমীহ যেমন পাই তেমনি মশকরাও সহ্য করতে হয়। কলেজের কো-এডুকেশনে খাপ খাইয়ে নিতে তাই অনেক কোশেশ করতে হয়েছে। এখনো পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারিনি। কলেজ জুড়ে মেধাবীর তকমা পেলাম বটে কিন্তু ইনোসেন্ট আর হাবাগোবার মিশ্রণজাত এক ধরণের খোঁচাও খেতে হত প্রায়ই। বাবার বড় আশা আমি বিসিএস দেবো। ম্যাজিস্ট্রেট হবো। ডিসি হবো। গ্রামের বেসরকারি স্কুলের মাস্টার হিসেবে এটাই তাঁর সর্বোচ্চ আশা।

    আমাদের আর্থিক অবস্থা কখনোই স্বচ্ছল ছিলো না। এর যাতনা আমি যতটা টের পেতাম, বাবা-মা ভোগ করতেন ততোধিক। আমরা এক ভাই এক বোন। বোনটি বড়। রুপে ও গুণে সে অদ্বিতীয়া। একদিন তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলো। বাবা নিমরাজী হলেও মা গোঁ ধরলো। তাঁর বক্তব্য মেয়ে মানুষের জন্য ইন্টার পাশই যথেষ্ট। ছেলে সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। সম্পর্কীয় এক মামা এই প্রস্তাব এনেছেন। বলাচলে একরকম জোর করেই বিয়ের কথা প্রায় পাকা হয় হয়। শুভস্য শীঘ্রম বলে একটা কথা আছে। এটা আর কিছুর ক্ষেত্রে না হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গ্রামদেশে এটাই সর্বজন মানিত। এমন অবস্থায় আমার বুক ঠেলে কেন জানি থেকে থেকে কান্না আসতে থাকলো। বোনের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। একবার একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে রাজী কিনা। ছোট ভাইয়ের কাছে এতদসম্পর্কীয় কথা বলতে লজ্জা হলেও এক পর্যায়ে কাছে এসে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “রাফি, আমি এখনই বিয়ে করতে চাইনা”। তার এ কথাটা বুকে যেন শাবল মারলো। কিছু একটা করা জরুরি জ্ঞান করে বাবাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম, “বাবা, আপু এখন বিয়েতে রাজী না। আপনি শক্ত থাকেন। আম্মাকে আমি ম্যানেজ করবো”। বাবা বিস্মিত চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কথা তো প্রায় পাকা হওয়ার পথে”। ছোট চাচা চালাক চতুর টাইপের। নিঃসন্তান। আমাদের দু’জনকে সন্তানবৎ আদর করেন। তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। তিনিই মজলিশে চমৎকার বোমা ফাটালেন, “মেয়ে ডিগ্রী কমপ্লিট করতে চায়। লেখাপড়ায় মা শা আল্লাহ ভালো। তাই আমরা পরে পারিবারিক ভাবে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাদেরকে জানাবো”। তাঁর এ বক্তব্যে আলোকোজ্জ্বল প্যান্ডেল যেন সহসাই নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। অতিথিরা লা জবাব হয়ে ফিরে গেলো। আম্মা আমার উপর, তারচেয়েও বেশি ছোট চাচার উপর নাখোশ হলেন। তাঁর মুখ ভার দেখে আমি গলায় জড়িয়ে ধরে বললাম, “আম্মা, আমি কি কোনদিন তোমাদের অবাধ্য হয়েছি”? আম্মা চোখ তুলে আমাকে জড়ায়ে ধরে বললো, “বাবারে, মেয়ে হওয়ার কষ্ট তুই কি বুঝবি”? সত্যিই আমি অতশত বুঝি না। আমার প্রতি বাবা-মা’র অগাধ আস্থা। তাদের ধারণা আমি জ্ঞানে-গরীমায় তাদের চেয়ে ঢের ভালো বুঝি। এজন্য এ যাত্রা বোন পরিত্রাণ পেলো। তাঁর খুশি খুশি ভাব দেখে আমার নিজেকে সফল বলে মনে হলো। এরপরের কাহিনী আরো করুণ। স্কুল থেকে সাইকেল চেপে বাড়ী ফেরার পথে বাবা পিচ্ছিল রাস্তায় অন্যমনস্কতার কারণে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাত পেলেন। তাঁর চিকিৎসা ইত্যাদিতে বিস্তর টাকা খরচ হলো। জমি যা ছিলো তার প্রায় অর্ধেক বিক্রি করতে হলো। আর বাকি অর্ধেক বন্ধক রাখা হলো।

    সংসারের এরুপ আর্থিক অবস্থার মধ্যে আমি জেলা শহরের কলেজে অনার্সেই ভর্তি হয়ে গেলাম। বাবা খুব মর্মাহত হলেন। তাঁর পক্ষে এর চেয়ে ভালো কিছু করা যে সম্ভব না তা তিনিও ভালো জানেন। যদিও তাঁর সাধ ছিলো ভিন্ন। ভালো মান নিয়ে অনার্স পাস করলাম। বাবা একদিন কাছে ডেকে বললেন, “বাবা, মাস্টার্স করো অসুবিধা নাই। তবে বিসিএস এর প্রিপারেশনও চালিয়ে যাও”। আমি বিস্ময়ে এই প্রথম তাঁর কাছে জানতে চাইলাম বিসিএস করলে বিশেষ কি হবে? বাবা বললেন, “ম্যাজিস্ট্রেট হবা”। ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির সাথে পাবলিক পরীক্ষার সময় পরীক্ষা হলে বার কয়েক পরিচয় হয়েছে। তাকে নিয়ে হেড স্যার থেকে প্রিন্সিপালসহ সবাই তটস্থ থাকত। তোষামোদে ব্যস্ত থাকত। এর বেশি কিছু উত্তাপ অনুভব করতাম না।

    ছোটবেলা হতে কোনদিনই বাবা-মা’র কথার অবাধ্য হইনি। মূলত তাদের কাছে আমার কোন বেয়ারা বা বাড়তি আবদারও ছিলো না। বিনিময়ে সংসারের ভারি ভারি সিদ্ধান্তের সময় আমার শলা-পরামর্শ বিশেষ মর্যাদা পেতে থাকলো। সে যাহোক, বোনের বিয়ের সে পাত্র সম্মন্ধে একদিন খবর এলো যে আগে সে গোপনে বিয়ে করেছিলো। ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে। সে ঘরে তার সন্তানও আছে। এ খবর শুনা মাত্র বাবা-মা আমাকে সংসারের সকল ভালো-মন্দের জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্বভার অর্পণ করলেন। আমার কাঁধ ভারি হলো। বয়স আন্দাজে আমার চলাফেরায় ভারিক্কি চাল ভর করলো। তবে বাবার ওই এক কথা বিসিএস দিতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে। শক্ত হৃদয় বলে কোন কালেই আমার খ্যাতি ছিলো না। এই ফেরে পড়ে এখন তা আরো কোমল হলো।

    একদিন জেলা সদর থেকে ফিরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাবা বললেন, “সব ফাইনাল করে এলাম। এখন থেকে শুধু পড়াশোনা করবা। টাকার কথা চিন্তা করবা না। প্রয়োজনে আরো এক কানি ক্ষেত বিক্রি করবো”। আমার কান্না পেলো। পুরুষ মানুষের কান্না করতে নেই। চেপে বুক ভারি করাই রেওয়াজ। তাই করলাম। আর মনে মনে পণ করলাম বাবার খায়েস পূরণই আমার একমাত্র কাজ। আমার জন্য বাবা তাঁর বন্ধুর বাসার চিলে কোঠায় অব্যবহৃত এক রুম যৎসামান্য মাসোয়ারার বিনিময়ে রফা করলেন। বাক্সপেটরা সমেত একদিন আমাকে নিয়ে তার দ্বারোদঘাটনও করলেন। বাবার সে বন্ধুর সাথে, তার পরিবারের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন। আন্টির প্রতিটি কথাতেই যেন মায়ার প্রলেপ মাখা। প্রারম্ভিক পর্যায়েই স্বস্তি বোধ হলো। তাদের এক ছেলে। ছোট। নাম বিপ্লব। ক্লাস টেনে উঠেছে। অবসম্ভব চঞ্চল। ছাত্র ভালো তবে পড়াশোনা বাদে আর সব কিছুতেই পজিটিভ। আমি তাকে দুরন্ত বিপ্লব বলে ডাকি। তাদের আরেক মেয়ে। বড়। নাম ছায়া। পারিবারিক প্রথম পরিচয় পর্বে পাশের রুমের দরোজার কাছে কারো ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিকে নজর পরায় সেই ছায়াকে চকিতে মিলিয়ে যেতেও দেখলাম। বুঝে নিতে কষ্ট হলো না যে সেই ছায়া ছায়া’র ছিলো। ছায়া এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বাবার সেই বন্ধু প্রাইভেট কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। অত্যন্ত সজ্জন, অমায়িক। বাবার সাথে তাঁর জেন্টেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট হলো, তাঁর দুরন্ত বিপ্লব-কে পড়াশোনার ক্রিজে ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাট-বল হাতে ক্রিকেট ক্রিজে সে ইতোমধ্যেই অলরাউন্ডার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুরন্ত বিপ্লবের সূত্রেই আমার প্রাইভেট পড়ানোর ইনিংসের সূচনা হলো। অন্যদিকে তিন বেলা আহারের ব্যবস্থাও তাদের বাসা থেকে গ্যারান্টেড সাব্যস্ত হলো। আর এর মাধ্যমে আমার লজিং মাস্টারের যাত্রাও শুরু হলো। ভাগ্য ভালো যে ছায়ার পড়াশোনার দায়িত্ব স্কন্ধে চাপেনি।

    চলবে…

  • রঙ্গীলা বায়স্কোপ

    রঙ্গীলা বায়স্কোপ

    ছোটবেলায় বায়স্কোপ বলিয়া একটি শব্দ ও বিনোদনের উপকরণ বড়ই কৌতুহল উদ্দীপক ও মজাদার ছিলো। সিনেমা বা বায়স্কোপ যাহাই বলি না কেন ইহা যে নাচে-গানে, হর্ষে-বিষাদে, রঙ্গ-রসে ভরপুর হইবে ইহা বিলক্ষণ বুঝিতাম। কৈশোরে সিনেমাহলে গিয়া সিনেমা দেখা সাবালকত্বের লক্ষ্মণ বলিয়া অতি শাসনের কবলে পড়িত। শিশুতোষ সিনেমা হইলে ভিন্নকথা। তবে কিশোরদের সিনেমা দর্শন মোটা দাগে শুধু অপছন্দনীয়ই নয় গুরুতর অপরাধ বলিয়া গন্য হইত। ইহার বিকল্প হিসাবে বায়স্কোপ নামধারী একটি বাক্স রঙ্গীলা বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম হইয়া উঠিলো। ইহার বাহক এই বাক্স লইয়া গ্রাম-গ্রামান্তরে, শহরের অলিতে-গলিতে, বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে, হাটে-ঘাটে, খেলার মাঠে-মেলার মাঠে ঘাঁটি গাড়িত। সকল বয়সী মানবের ইহাতে সমান কৌতুহল ও আগ্রহ ছিলো। সেই বাক্সে বড় বড় ফোকড় থাকিত। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেই ফোকড়ে চোখ মেলিয়া ভিতরে চলমান বাদ্য সহবতে রঙ্গীন বিনোদন চিত্রে বুঁদ হইত।

    আজকাল ইহাদের আর দেখা যায় না বলিলেই চলে। বোধকরি মোবাইলের সর্বগ্রাসী ভূমিকায় এখনকার কিশোররাও ইহাতে আর আকুল-ব্যাকুল হইবেনা। আরো সত্যি করিয়া বলিলে ইহারা এই বায়স্কোপ বাক্সটিকে যাদুর বাক্স বলিয়াই ভ্রম করিবে। আর বয়ষ্করা মোবাইলে ইহার চাইতে ঢের বেশি রকমারি লাইভ শো দেখা যায় বলিয়া মোটেই আগ্রহী হইবেনা। তাই আগেকার সেই বায়স্কোপ বাক্স এখন আর মোটেই সহজলভ্য নয়।

    সিনেমার অবস্থাও তদ্রুপ। অরুচি, কুরুচি, বস্তাপচা কাহিনী নির্ভর এবং গলা ছিলা মোরগের মত ভাঁড় টাইপের ভাঁড়ামিতে ভরপুর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের শব্দ ও চিত্র প্রক্ষেপন যন্ত্রের অত্যাচারে আক্রান্ত হইতে এখন আর কেহ হলমুখী হয়না। একদার এই রঙ্গীলা দুনিয়ায় ধ্বস নামিয়াছে। কিন্তু ইহাদের অবর্তমানে বিনোদন প্রিয় পাবলিকের কিন্তু কোনই ক্ষতি হয়নাই। বরং গাঁটের ট্যাকা খরচ করিয়া অখাদ্য গলাধঃকরণের যন্ত্রণা হইতে মুক্তি পাইয়াছে। বিনিময়ে দেশময় ওপেন স্কয়ারে পয়সা ছাড়াই নিত্য নতুন লাইভ রঙ্গ দেখিয়া বেশুমার আনন্দ পাইতেছে। বায়স্কোপ বাক্সের সূত্রাধারের বলার ঢংয়েই বলি। দেখুন তো রঙ্গীলা চিত্রগুলো স্পষ্ট দেখা যাইতেছে কি-না?

    এই যে দেখুন কি সুন্দর, নাচিতেছে একদল বান্দর। আজব চেয়ারে আজ শিপুণ তো কাল সায়েদ, চলিতেছে খেলা নিরন্তর। এই যে দেখুন পরীর মত পরী, ভেতরে তার জমাট আঁধার, বাইরে তার রুপের বাহার, বড়ই চমৎকার। রঙ্গে ভরা রঙ্গ দেখিয়া, পাবলিক দেখুন মুখ বাকাইয়া, রসনার চোখ ঠাটায়, বুদ্ধিজীবী মন রাঙ্গায়, সাংবাদিকেরা গন্ধ ছড়ায়।

    কার বৌ কে কব্জা করে, লাইভে এসে কে কান্না করে, কার গর্ভে কার ভ্রুণ, এই তর্কে সাংবাদিকদের হচ্ছেনা ঘুম। আত্মহত্যার হিড়িক বাড়ছে। কথায় কথায় রশি নিচ্ছে, নিজের মাথায় বুলেট ছুড়ছে, লাইভে এসে নাটক করছে, আত্মহত্যার প্রসার হচ্ছে, পত্রিকাগুলো ছবিসহ ক্যাপশন দিচ্ছে।

    করোনাকালে সব অচল, বানিজ্য মেলা কত প্রবল, বই মেলায় সবাই সচল ! সব কিছুই চলছে ভালো, শিক্ষায়তনে নাই আলো। বিয়ে-শাদী, পার্টি-আড্ডা, ক্লাব-পাব রমরমা। এরি মাঝে সাকিব ভেলকি, বিসিবিও কম কি? খেললো কিছুক্ষণ টি-টুয়েন্টি। শেষে এসে হাসিমুখের সন্ধি-চুক্তি।

    এর মাঝে খবর এলো, ঘাপটি মেরে হারিস ছিলো, মাহমুদুর নাম নিয়ে ছিলো, এই নামে এন আই ডিও ছিলো, এগারো বছর দেশেই ছিলো, রাজধানীতেই তার কবর হলো। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সচল ছিলো, সবাই খুব ব্যস্ত ছিলো, নিচ্ছিদ্র সব ব্যবস্থা ছিলো, এখন শুনি অনেকের সেখানে যাতায়াতও ছিলো। কি থেকে যে কি হলো? খবর শুনে সবাই যেন উঠে বসলো।

    এরিমধ্যে ঢেউ এলো, বাজার সেরকম গরম হলো। এই যে দেখেন তেলেসমাতি কায়কারবার, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, তারাই আবার মিটিং বসায়। তত্ত্ব-তালাশে কমিটি বানায়। সেই কমিটি যুক্তি দেখায়। কর্তারা সবাই সাফাই গায়। ক্রয় ক্ষমতার ইনডেক্স দেখায়। তাইনা দেখে শাক-সব্জী দেমাগ দেখায়। সোয়াবিন তেলও চোখ পাকায়। টিসিবির ট্রাক ভীড় বাড়ায়।

    মিটিং বসে উপায় খুঁজতে, সবাই পৌছে ঐক্যমতে, যা হবার হয়ে গেছে, বাড়বেনা দাম আর রমযান মাসে। ব্যবসা যা হবার হয়ে গেছে, যুক্তি তো একটা সামনেই আছে। দেখছেন না রাশিয়া ফাল পাড়ছে? ইউক্রেন কেমন চিপায় পড়েছে, বাইডেন এখন ইউটার্ন নিয়েছে? দূরে দাঁড়িয়ে শিং পেন কেমন মুচকি হাসছে?
    এবার দেশে সানি এলো, তাবত সাংবাদিক হুমড়ি খেলো, তলে তলে সবাই গেলো, কেউ বললো জাত গেলো, কর্তা বললো কেমনে এলো? ইমিগ্রেশন এলার্ট ছিলো, লায়নি এসে পোস্ট দিলো, তার সাথে অনেকেই ছিলো, দেশের দিঘী-পুকুর সব যোগ দিলো। নাচ হলো, গানও হলো, খানাপিনা, মৌজ-মাস্তি সবই হলো।

    সরকারি ভ্যাট বিযুক্ত হলো। সোয়াবিন স্বস্তি পেলো। সব্জী বাজার উঁচুই রইলো। সব কিছু আড়াল হলো। রঙ্গ ভরা দুনিয়াতে, চলছে সার্কাস অবিরত।

    কথার কথা বাজে কথা, সেই কথাটিও ফুরালো, নটে গাছটিও মুরালো।

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (শেষ পর্ব-২১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (শেষ পর্ব-২১)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    শেষ পর্ব
    দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছে। বদলীর আশা ছেড়ে দিয়েছি। খাগড়াছড়িতে মনঃস্থাপন করার চেষ্টা করছি। ভাবছি পাহাড়ে এক খন্ড জমি কিনতে পারলে মন্দ হত না। সেটা নাকি অফিসিয়ালি সম্ভব না। শৈলী আরেকবার খাগড়াছড়ি , বিশেষ করে সাজেকে আসতে চেয়েছিলো। বলেছিলাম সাজেকে রাত্রিযাপন করলে সান সেটিং আর সান রাইজিং দেখার সুযোগ হবে। বলেছিলো আমি থাকলে সে আসবে। আমাকে ব্লকের মধ্যে ফেলে সে কি জিঘাংসা উপভোগ করছে জানিনা? ইচ্ছে ছিলো জেমিদেরকে এনে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো। সেটাও পরিত্যক্ত প্রকল্পের মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ইদানীং চেনাজানা লোকের আগমন নেই বললেই চলে। সারাক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকি এই বুঝি কেউ ফোন দিলো। হাই-হ্যালো করে বললো, “আসছি”। লালনের মন খারাপ। আর তৌহিদ নানাবিধ কাজে ব্যস্ত।

    আজ ফজরের নামায জামাতে আদায় করলাম। মনে বড় তৃপ্তি। চারিদিকের সব কিছুই খুব সতেজ আর প্রাণবন্ত লাগছে। পাখ-পাখালীর ঘুম জাগানিয়া সুমধুর কলতান যুগপৎ কৌতুহল ও আফসোসের উদ্রেক করছে। একদিকে পাখীদের আলাপের মর্মার্থ জানার কৌতুহল হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের ভাষা বুঝিনা বলে আফসোসও হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারিদিকের নিসর্গ দেখছি আর ভাবছি দেখতে দেখতে কিভাবে ছাব্বিশ বসন্ত পার হয়ে গেলো! জীবনের চিত্র-বিচিত্র কত রুপ দেখলাম। কত মান-অপমানের খেলা দেখলাম। ভালবাসাবাসির এই রোদ, এই বৃষ্টিও দেখলাম অনেক। আপন মনেই হেসে উঠলাম। ভালোই হলো। টু বি ওর নট টু বি’র দোলাচালের পরিসমাপ্তি হয়েছে।

    জেমি নারী। আবেগ তার জন্য সহজাত। প্রেম তার জন্য অলংকার। বাস্তবতা তার জন্য নির্ধারিত নিয়তি। তার কথাই হয়ত সত্য। জীবন থেমে থাকেনা। মাঝে মধ্যে দম নেয় মাত্র। নতুন উদ্যমে দৌড়াবার জন্য। যারা দৌড়াতে পারেনা তারা হারিয়ে যায়। জেমির ভবিতব্য জেমি নিজেও জানেনা। সেটা নির্ভর করছে অনেক সমীকরণের উপর। নিজেকে সে ভেবে নিয়েছে ছিটমহলে আটকে পড়া একজন উদ্বাস্তু হিসেবে। শৈলী রঙ্গীন প্রজাপতির মত হাওয়ায় উড়ছে। বয়সটাই তো এমন। উড়তে উড়তেই একদিন কোন ঠিকানায় থিতু হয়ে যাবে নিশ্চয়। আর সাবরিনা? ক্ষনিকের অতিথি সব সময় দোলা দিয়ে যায়। তার ভূত, ভবিষ্যতের গতিপথ অজানা। বাসা থেকে সাবরিনার কথা ছোট মামাকে বলা হয়েছে। মামা সাবরিনার সাথে আলাপও করেছেন। কি যেন একান্ত কিছু কথা আছে তার। সাবরিনা তা সাক্ষাতে বলতে চায়। ছিটমহলে আটকে পরা উদ্বাস্তুর ইচ্ছে ঘুড়ির নাটাই নিজ হাতে থাকেনা।

    এখন সাহস করে প্রায়ই ফিল্ড ভিজিটে যাই। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি টেবিলের উপর কুরিয়ারের খাম। ঔৎসুক্য নিয়ে খুললাম।

    সুজনেষু,
    কোনদিন চিঠি লিখবো ভাবিনি। অনন্যোপায় হয়েই লিখছি। ধরে নাও কৈফিয়ত দিচ্ছি অথবা নিজের পজিশন ব্যাখ্যা করে দায়মুক্তি নেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছি। তোমার সাথে আমার পরিচয় পর্ব তেমন সুখকর ছিলনা। ইলমার বড় বোন হিসেবে টিউটরকে একটু পরখ করে নেওয়াই উচিত, তাই ইন্টারভিউ স্টাইলে তোমাকে বাজিয়ে নিয়েছিলাম। তোমাকে দেখেই আমি কেন জানি মনে মনে ‘সিলেক্টেড’ মার্ক দিয়ে রেখেছিলাম। কোন রকম ভণিতা না করেই বলি প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিলো। সে ভালোলাগা ছিলো নিছকই ভালোলাগা। কোনক্রমেই ভালোবাসা বা সিরিয়াস কিছু ছিলো না।

    তুমি খুব ভাল। চেহারায়, স্মার্টনেসে আর সরলতায়। ইলমার মুখে তোমার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার মনটাও মোহিত হয়ে গিয়েছিলো। তাই পড়া শেষে তত্ত্বতালাশের বাহানায় তোমার সাথে আলাপের ব্যাকুলতা প্রশমন করতাম। ভাবতাম এভাবে আস্তে আস্তে মোহান্ধতা কেটে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো নেশাক্রান্ত হয়েছি আরো। তাই, নিত্যদিন অপেক্ষায় থাকতাম সেই বিশেষ সময়টুকুর জন্য। আম্মা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। নানাভাবে তার মিশ্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন। একজন মেয়ে হয়ে আমি তা ভালোই বুঝতে পারতাম।

    মোহান্ধতা মানুষকে পাল্টে দেয়। মানুষ নিজেও বুঝতে পারেনা যে সে আবেশের ঘোড়ে রয়েছে। বুঝলেও হয় ইগনোর করে নয়ত এনজয় করে। মানুষের যেটাতে ঘাটতি সে সেটা পেলে সেটাতেই ডুবে থেকে সিক্ত হতে চায়। আমিও না জেনে না বুঝে সেরুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার যে একটা অতীত আছে সেটা তোমাকে বলা হয়ে উঠেনি। আসলে বলার সুযোগও হয়ে উঠেনি। সেটা ছিলো আমার প্রথম ভুল। অল্প বয়সী আবেগে ভেসে এক ছন্নছাড়াকে মনে করেছিলাম ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’র পারফেক্ট শাহরুক। তবে সে মোহ কাটতে বেশি দিন সময় লাগেনি। হঠাৎ একদিন সে উধাও। পাড়ি জমালো বিদেশে। বলতে পারো কারো কথা না শুনেই। সেখান থেকে আরেক দেশে। এরপর আর হদিস নেই। সেই কালো অতীতের উজ্জ্বল প্রমানক যে আমার কিউটি তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো। আমি তাকে নিয়ে অতীতকে ভুলে থাকতে চেয়েছি ভীষণ ভাবে। হয়ত ভেতরের সেই প্রবল চাপ হাল্কা করতে গিয়েই তোমার সাথে আলাপনের সূত্রপাত করেছি যেচে। এটি ছিলো আমার দ্বিতীয় ভুল।

    সে যাহোক। অবাক হয়ে হয়ত ভাবছো তোমার ঠিকানা যোগাড় করলাম কি করে? আমার এক কাজিন ইউ এন ডি পি তে চাকরি করে। তার মাধ্যমেই এই ঠিকানা পেয়েছি। আমার ফোনের সেই সীম আর ব্যবহার করিনা। সামাজিক সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছি নানা কারণে। তবু তোমাকে না জানিয়ে এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাকে আমি মানসিক ভাবে নিতে পারছিলাম না। তাই কুরিয়ারের আশ্রয় নিয়েছি।

    ইদানীং আমি ভীষণ মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এত বছর নিখোঁজ থাকার পর আমার কিউটির জনক বেশ কয়েক মাস যাবত কানাডা থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। এখন সে দেশেই। পুরুষ মানুষ যেমন ঘাড়ে চাপতে সময় নেয়না তেমনি পা ধরে বসে থাকতেও পিছ পা হয়না। আমরা মেয়েরা এখানেই বারবার ভুল করি । সে ভুলের দায় কি একান্তই মেয়েদের? বিতর্ক করার জন্য এটা উৎকৃষ্ট টপিক হতে পারে, কিন্তু লাভ কি? যে পুরুষ দায়িত্ব কি জিনিস বুঝেনা, শৃঙ্খলা কি জানেনা, সভ্যতা-ভব্যতা কি জিনিস তার পরোয়াও করেনা আখেরে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সে-ই আসে স্বামীত্ব ফলাতে। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তার ঔরসের গরিমা। আমি আর ভুলের ট্রেনে চড়তে চাইনা। তাই কিউটিকে নিয়ে টানা হেচড়া চলছে। আম্মাও সেই তথাকথিত সামাজিক অনুশাসনের পক্ষে গা ভাসিয়ে গো ধরে বসে আছে। আত্মীয় স্বজনরাও একাট্টা। জানিনা আমার কি করা উচিত। মাথা আর কাজ করছেনা। আমার পক্ষে দাঁড়াবার মত কেউ নেই। আমি বড় একা।

    তুমি চলে যাবার পর একাকীত্ব পেয়ে বসে আমাকে। মনে হচ্ছিল কোথাও এতটুকু ছায়া নেই। নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। সারাদিন তবু কোন মতে কেটে যায়। কিন্তু রাত যত বাড়ে ঘুম তত পালায়। দুঃশ্চিন্তা আর বিষন্নতা এসে ভর করে। তখনি তুমি আসো। আমি প্রবল ভাবে তাড়াতে চাই তোমাকে মনের পর্দা থেকে। অনুভব করতে পারি ‘কাছের তুমি’র চেয়ে ‘দূরের তুমি’ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে আমাকে আরো গ্রাস করছো। তোমাকে জানাতে লজ্জার কিছু নেই। আমি মানসিক ট্রমার মধ্যে ডাক্তার বান্ধবীর কাউন্সেলিং এ আছি। আমার একমাত্র স্ট্রেংথ আমার কিউটি। আর আমার একমাত্র উইকনেস আমার ‘অতীত’ আর ‘তুমি’। আমি এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই। অতীত নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। পাস্ট ইজ পাস্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘তুমি’কে নিয়েই আমার যত যন্ত্রণা, হতাশা আর সংশয়। এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছি। ইলমা মাকে সব বলে দিয়েছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। গন্তব্যহীন অনিশ্চিত এই পথ চলা দু’দিন আগে হক আর পরে হোক দশ জনের চোখে পড়বেই। কিউটির বাবার পক্ষে সবাই একাট্টা হয়েছে। তারা উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে বেপথ থেকে পথে আনতে। আমার কথা কেউ ভাবেনা। নিজের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছে। জানিনা শেষতক কোথায় আমার গন্তব্য?

    ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও। আমার জন্য ভেবো না। মেয়েদের নিয়ে এত ভাবাভাবির কিছু নেই। যে পাত্রে রাখা হবে সে পাত্রেই সে ধাতস্থ হয়ে যাবে। হয়ে যেতে হয়।

    তোমার পক্ষে যেমন সাজেনা জীবন নিয়ে কোন এক্সপেরিমেন্ট। তেমনি আমার পক্ষেও শোভনীয় নয় চিত্ত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এমন কোন প্রজ্জ্বলন। শেষ করছি জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পুরোনো দিনের গান দিয়ে। কেন জানি ভাবতে ভালো লাগে গানের কথাগুলো যদি সত্যি হত।

    পৃথিবীর যেখানে যত খাঁচার পাখী
    উড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।
    হেলা ভরে ফেলে দেওয়াদের যতন করে কুড়িয়ে নেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।
    কোথাও আলো সূর্য সমান কোথা চির অমানিশা
    কোথা অগুণ্তি ধারা বহমান কোথাও মরুতৃষা
    সে আলো সে জল সমানুপাতে ছড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।

    কোথাও শুধুই চাওয়া চাওয়া কোথাও পাওয়ার ক্রান্তি
    কোথাও হিসাব নিজেই মিলে কোথাও শুধু ভুল ভ্রান্তি
    ভুল হিসেবের ভুল চাওয়াকে ছড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।

    ইতি,
    ছিটমহলে আটকে পরা উদ্বাস্তু, একজন জেমি।

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২০)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২০)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (২০)
    কেবলমাত্র অসুস্থ হলেই সবার জীবনবোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় দুনিয়াবি জীবন খেল তামাশা মাত্র। যে ঔজ্জ্বল্যের মোহে আমরা প্রাণান্তকর দৌড়ঝাঁপ করি দিন শেষে তা অধরাই থেকে যায়। দৌড়ের মাইল পোস্টটা কেবল সামনে সরে যায়। পৃথিবীর সকল সুস্থ মানুষকেই মনে হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান। আর নিজেকে জীবন যুদ্ধে পরাস্ত সৈনিক বলে মনে হয়। ইমাম সাহেবের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। এক বয়ানে তিনি বলেছিলেন সুস্থতা যেমন আল্লাহর নিয়ামত তেমনি অসুস্থতাও। সুস্থতা মহান আল্লাহর নিয়ামত এটা সহজবোধ্য। তাই বলে অসুস্থতাও? তিনি ব্যাখ্যা করলেন। অসুস্থ হলে আমরা সুস্থতার মজা উপলব্ধি করতে পারি। অসুস্থ হলে আমরা সৃষ্টিকর্তাকে যেমন প্রতি পদে পদে স্মরণ করে থাকি তেমনি তাঁর কাছে উপুর্যুপরি মিনতিও করে থাকি। যে যতটুকু পারি এবাদত-বন্দেগীতে, তাওবা-এস্তেগফারে মশগুল হয়ে পড়ি। অথচ সুস্থ থাকলে, এত গভীরভাবে কোনদিনই আমল করা হয়ে উঠেনা। সত্যিই তো! অসুস্থতাও তো একপ্রকার নিয়ামত। আর অসুস্থ হলেই মানুষ নানাবিধ বিষয় নিয়ে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে। চারপাশের অতি আপনজনের ছোট খাটো বিষয়গুলোও তখন প্রকট হয়ে দেখা দেয়।

    ঢাকায় যাওয়া বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। নিউরো ডাক্তারের ফলো আপ ভিজিটের আগেই কাউন্সেলিং করা দরকার। তৌহিদের কল্যাণে তার পরিচিত দুরসম্পর্কীয় আত্মীয় সায়ক্রিয়াট্রিস্টের কাছে বুকিং দেওয়া হয়েছে। মোট ছয় সেশন দিতে হবে। প্রগ্রেস ভালো হলে চারেই শেষ হতে পারে। প্রথম দিন ব্রিফিং এন্ড ইনফরমেশন কালেক্টিং। প্রতিদিন এক দেড় ঘন্টার সেশন। এ ধরণের কাউন্সেলিং এর কথা শুনেছি। কিন্তু নিকটজন কেউ করেছে শুনিনি। না শুনলেও, কেন জানি নেগেটিভ একটা ইমপ্রেশন মননে-মগজে ছায়াপাত করে আছে। এরা নাকি ম্যাসমারিজম জানে। নীলাভ আলোতে বসিয়ে কি-সব বলে কয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। তারপর রুগী আপন মনে তার ভেতরগত ব্যাথার অকথিত কাহিনী গড়গড় করে বলে যায়। সায়ক্রিট্রিস্ট তার নিজের উত্তর পাওয়ার জন্য নিজেও কিছু প্রশ্ন করে সেগুলো বের করে আনে। এগুলো রহস্যোপন্যাস বা গল্প-কাহিনী, সিনেমা ইত্যাদি দেখে-শুনে জেনেছি। প্রথম দিন তৌহিদকে নিয়েই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের চেম্বারে গেলাম। চেম্বারের সামনে কয়েকজন বসা। সবাই চুপচাপ। তবে তাদের চোখের নড়াচড়া পাগল পাগল টাইপের মনে হলো। ভয় ঢুকে গেলো মনে। কাউকে কাউকে পায়চারি করতেও দেখলাম। মনে হয় ভেতরে প্রবল স্যুনামী হচ্ছে। কাউকে দেখলাম আত্মীয় স্বজনরা ঘিড়ে ধরে বসে আছে। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। তৌহিদ সাথে থাকায় কিছুটা ভরসা পাচ্ছি। কতক্ষণ পর আমার ডাক এলো। রুমে ঢুকলাম। সাদা এপ্রোন পড়া একজন এসে আমার চৌদ্দ গুষ্ঠির কুষ্ঠি টুকে নিয়ে গেল। রুমে আমি একা। আলো কম। এসির বাতাস যথেষ্ট বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ পর সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এলেন। ডিটেক্টিভ টাইপের প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমার কাছে তাকেই উদ্ভ্রান্তের মত মনে হলো। মধ্যবয়সী। মুখে হাসির বালাই নেই। চোখ পানসে। কথা বলেন আর হাতের কলম কিছুক্ষণ পর পর নাকে ঠেকান। হয়ত এটা তার বদ অভ্যেস। আমাকে কেন কাউন্সেলিংয়ের জন্য প্রেসক্রাইব করা হয়েছে আমি জানিনা। আমি তো পাগল না। মাথার বিষয়টা আগের চেয়ে অনেক ইমপ্রুভ করেছে। মনে মনে ধরেই নিয়েছি উনি আমার ভেতরের কথা বের করে মাথার ব্যামোর উৎস খুঁজবেন। আমি নার্ভ টান টান করে তার মুখোমুখি বসা। তিনি শুরু করলেন, “কিছু বলুন”।
    — কি বলবো? ডেসপারেট ভঙ্গিতে আমার উত্তর।
    — যা মনে চায়
    — মন জানতে চাচ্ছে, আমাকে এখানে কেন রেফার করা হয়েছে?
    — যিনি রেফার করেছেন উনাকে জিজ্ঞেস করেন নি?
    — প্রফেসররা রোগীর কথা শুনে না
    — গুড। তো বলুন কি জানতে চান?
    — মনোরোগ নিয়ে বলুন।
    — পরিসংখ্যান অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি চারজনের একজন মানুষই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।
    — তাহলে এতে উদ্বেগের কি আছে?
    — কিছু অদ্ভুত, রহস্যময় আর বিরল মানসিক রোগ আছে পৃথিবীতে, যেগুলোর কথা আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা।
    — ভেরি ইন্টারেস্টিং।
    — এই যেমন ধরুন ফিলোফোবিয়া। যারা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বা ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারণার শিকার হয়ে জীবনে আর কখনোই প্রেমের সম্পর্কে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আবার এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা এরকম কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হয়েও কখনোই প্রেম করতে চায় না। প্রেম সংক্রান্ত এই ভীতি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটি একটি রোগ। পৃথিবীতে প্রায় প্রতি দু’শ মানুষে একজন এই রোগে আক্রান্ত।
    — আমি এই ক্যাটাগরিতে পড়িনা। বরং আমার প্রেম রোগ আছে মনে হয়। আমি তার কথার মধ্যেই উত্তর দিলাম।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নিরুত্তাপ ভাব নিয়ে আমাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছেন। আমি এখন পর্যন্ত শক্ত অবস্থানেই আছি। কাগজের টোকা দেখে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি প্রেমিক পুরুষ”? “ঠিক সেরকম না” আমার ঝটপট উত্তর। তিনি হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “কেন আপনার এমন মনে হয়”?
    — জানিনা
    — কি করেন?
    — চাকরি
    — কতদিন হলো?
    — দুই
    — দুই মানে কি?
    — বছর
    — পড়াশোনা?
    — ইঞ্জিনিয়ারিং
    — কোথায়?
    — বুয়েট।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট পানসে চোখ খানিকটা বড় করে তাকালেন। তারপর হাতের কলম আবার নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “ গুড। প্রেম করেছেন”?
    — জানিনা
    — জানেন না কেন?
    — কনফিউজড
    — ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন ফারদার? বিশেষ কাউকে পছন্দ আছে? মুখ ফুটে তাকে বলতে পারছেন না?
    — আছে
    — তিনি কি করেন? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড
    — ম্যারিড।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এবার নড়েচড়ে বসলেন। হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “পরকীয়া”?
    — ডোন্ট নো।
    — বিয়ে করে ফেলুন
    — প্রবলেম আছে
    — যেমন?
    — ডোন্ট হেভ এনি কানেকশন রাইট নাউ
    — কেন?
    — আই থিংক ইটস এ ডেড ইস্যু রাইট নাউ। লিভ ইট।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এখনো বরফ শীতল। কিছু কিছু নোট নিচ্ছেন। আর হাতের কলম নাকের ডগায় ঘন ঘন ঠেকাচ্ছেন। তাকে আরো অনুসন্ধিচ্ছু মনে হলো। বললেন, “লিভ ইট। লেট’স প্রগ্রেস। মানসিক দুরাবস্থার অন্য অবস্থাগুলো হচ্ছে প্যারিস সিনড্রোম, এরোটোম্যানিয়া, ক্লেপটোম্যানিয়া, অ্যাপটেমনোফিলিয়া,পেডোফিলিয়া, নেক্রোফিলিয়া—-

    আমার মাথা আর কাজ করছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। যখন হুঁশ হলো তখন দেখি সেই নিরামিষ সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নেই। সিস্টার টাইপের একজন বললেন, “আপনি এখন আসতে পারেন। আপনার নেক্সট সেশন-ডেট কার্ডে লেখা আছে”। বের হয়ে দেখি তৌহিদ বসা। এগিয়ে এসে বললো, “এতক্ষণ কি করলো”? বললাম, “জানিনা । তবে এখন অনেকটাই হাল্কা বোধ করছি”। এভাবে চারদিন সেই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের মুখোমুখি হলাম। শেষ দিন সেশন শেষে কিছুটা হেসে বললেন, “ইয়াং ম্যান। বিলিভ ইন ইওরসেলফ। সুন্দরীদের ভালো লাগবেই। পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই এটি। নাথিং রঙ ইন ইট। ডু হোয়াটেভার ইউ ওয়ান্ট টু ডু। বাট ইউ পজেস সাম পিকিউলারিটিজ অলসো। ভেরি সিমিলিয়ার টু সো মেনি। বাই দা ওয়ে হু ইজ সাবরিনা”? আমি চমকে উঠলাম। সাবরিনার কথা এলো কিভাবে? বললাম, “হাও কাম ইউ নো হার”? তিনি হাসলেন। সে হাসিতে অনুসন্ধিচ্ছা নেই, নেই উদ্বিগ্নতা। আছে উদ্ঘাটনের আনন্দ। বললেন, “গেট ম্যারিড সুন এন্ড বি হ্যাপী। ডোন্ট বোদার হোয়াট আদার্স উইল সে”।
    মনটা যেন আজ পিওর অক্সিজেনে ওয়াশ করা হয়েছে। মাথা সুন্দর কাজ করছে। শরীরে ক্লান্তি নেই। তৌহিদকে বললাম, “ব্যাটা সায়ক্রিয়াট্রিস্ট খাসা চীজ। চাঙ্গা করে দিয়েছে। ফিলিং ড্যাম বেটার”। তৌহিদ হাসলো। বললো, “বাসায় চলো। খালাম্মার সাথে আলাপ আছে। তোমার বিয়ে জরুরি”। “কাকে? সাবরিনাকে”? মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো। তৌহিদ আশ্চর্য হয়ে বললো, “কাকে মানে? এতদিন জানতাম জেমি আর শৈলী। আর এখন সাবরিনা এলো কোত্থেকে”? আমি চট করে বাধা দিয়ে বললাম, “লিভ ইট। ফিলিং আনইজি নাও”। তৌহিদকে আর বাসা পর্যন্ত নিয়ে এলাম না। কি থেকে কি বলে পরিস্থিতি আরো সংকটাপন্ন করে তুলবে কে জানে?

    খাবার টেবিলে আম্মাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। মলির ইডিডি দিন-দশেক এর মধ্যেই। হয়ত সে কারণেই নানী হওয়ার আনন্দে। হঠাৎই বলে বসলো, “সাবরিনা টা কে”? আমি যেন আকাশ থেকে পড়েছি। পরক্ষণেই বললাম, “কেন, কি হয়েছে”? আম্মা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “বল না”? সেলিম সামনে থেকে সরে গেলো। মলি এসে যোগ দিলো। আমার বুঝতে বাকি নেই যে বাসায় ইত্যবসরে সাবরিনা বিষয়ে গবেষণা হয়ে গেছে। তৌহিদই সেলিমকে বলে দিয়েছে। পরিস্থিতি নরমাল করার জন্য বললাম, “মামার অফিসে চাকরি করে”। বুঝতে পারলাম আম্মার আশার টিউব লাইট জ্বলে উঠেছে। বললো, “কথা হয় ওর সাথে”? উত্তরে বললাম, “হাই- হ্যালো হয়েছে। তাও মামার অফিসেই”। “তোর পছন্দ হয়েছে”? আম্মার স্ট্রেট ড্রাইভ। আমি ব্যাকফুটে গিয়ে বললাম, “যে কারোরই পছন্দ হবে”। আম্মা কি বুঝলো কে জানে? কথা এখানেই শেষ। মলি খুশি। সেলিম দরোজার পাশ থেকে সরে ভেতরে চলে গেলো। জানি আম্মা এখনই ছোট মামাকে ফোন দেবে। আমি রুমে গিয়ে কাপড়চোপড় গুছাতে লাগলাম। কাল ভোরে খাগড়াছড়ি যেতে হবে।

    চলবে…