আমিও মুক্তি যুদ্ধের স্বাক্ষী

Photo of author

By Fatema Hossain

উনসত্তর এর গন আন্দোলনের সময় আমি দুগ্ধপোষ্য ছিলাম। আমার পরিবার সদ্য অভিভাবক হারিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েছে।সবার বড়োভাই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবন ও চাকরি নিয়ে সেনাপতিত্বে দাঁড়িয়ে গেছেন!
মাঝের চারজন প্রাইমারি ও হাইস্কুলেরছাত্র ছাত্রী।

আমার বড়ো জন আর আমি একেবারেই নাদান।

যুদ্ধ শুরুর আগে আগেই আমাদের পরিবার বাবার কর্মস্থলের ফাইনাল সেটেলমেন্ট শেষে চট্টগ্রাম থেকে মেহেরপুর এ গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। শুধু বড়ো ভাই রয়ে যান চট্টগ্রামে।

গ্রামের পরিবেশ পড়াশোনা করার জন্য সুবিধা জনক না হওয়ায়, আর আমাদের মা মৃত্যুপথযাত্রী স্বামী কে কথা দেওয়া কথা রাখতে মেহেরপুর সদরে একটি দোতলা (ডুপ্লেক্স বল্লেও ভুল হবেনা) বাড়ি ৪০ টাকা মাসিক ভাড়ায় ভাড়া নিয়ে উঠলেন।

অনেক গাছপালা ওয়ালা ও ভিতর ও বাইরে দুটো বিশাল উঠোনওয়ালা বাড়িটি সত্যিই সুন্দর ছিলো।

প্রতিবেশীরা ছিলেন খাঁটি মানুষ! আমাদের জন্য ফেরেস্তা ! তাদের সাথে অনায়াস যাতায়াত ও অবারিত মেলামেশায় আমরা পিতৃহীন, আত্মীয় পরিজন হীন হয়েও কখনো অসহায় বোধ করিনি।

৭০ সালের শেষ দিকে।৭১ এর প্রথমেই ভাইবোনেরা যার যার ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেছে। এমন সময় বংগবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর সারাদেশে থমথমে অবস্থা য় বড়ো ভাই চট্টগ্রামে একা! তিনি তখন টগবগে তরুণ!রক্ত নেচে উঠছে! দিনে চাকরি সন্ধ্যায় পড়া রাতে পোস্টার লেখা ও দেয়ালে মারা করে চলেছেন তাঁকে ঠ্যাকাই কে।

যুদ্ধ শুরু হলে, মা এর একটা স্বর্নের হার নিউমার্কেটে স্বর্ণের দোকানে রিপিয়ার করতে দেয়া ছিলো, সেটা বিক্রি করে টাকা নিয়ে সেমুতাং এ মামার কাছে চলে যান।মামা পেট্রোবাংলায় চাকরি করতেন। মামি তখন গর্ভবতী। নানু অসুস্থ। উনাদের সাথে করে অনেক কস্টে দেশে ফিরে গেলেন।মামা সেমুতাং এ রয়ে গেলেন।

তিনি মেহেরপুরে এসে তার বয়সী ও বড়ো ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে একদিন মা এর অনুমতি নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে বেরিয়ে পড়লেন।

আমাদের বাড়িটা ছিল শহরের মাঝখানে রাস্তার উপরেই।যুদ্ধ লেগে গেলে আমাদের একমাত্র আত্মীয় (যাদের ভরসায় ওখানে যাওয়া) ছোটো খালাম্মার একান্নবর্তী পরিবার আমাদের ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল!

প্রতিবেশিরাও চলে গেছেন।আম্মার তখন ৩৫/৩৬ বছর বয়স।তিনি বরাবর ই ছিলেন প্রচন্ড সাহসী! উনি আল্লাহ ভরসা করে আমাদের নিয়ে থেকে যান।

সদ্য পরিচিত প্রতিবেশি জনাব আব্দুল জলিল আমিন খালু ও তার ছোটো ভাই স্কুল মাস্টার জনাব আব্দুল রুহুল আমিন খালু ঝাউবাড়িয়া গ্রামে আত্মীয় বাড়ি পৌঁছে পরিবার রেখে আমাদের কথা স্মরণ করলেন। এবং জানের মায়া ত্যাগ করে আমাদের নিয়ে যেতে আসলেন।মা প্রথমে নিষেধ করলেও উনারা আমার ভাই এর যুদ্ধে যাবার কথা স্মরণ করিয়ে সামনে ভয়াবহ বিপদের আশংকা করে মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে একপ্রকার জোরকরে নিয়ে চললেন।

কাঁচা রাস্তায় হাঁটা পথে কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে আমরা সেখানে পৌঁছেছিলাম।যাবার পথে বড়ো ভাই-বোন দের মাথায় ট্রাংকে, ব্যাগে পোটলায় করে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে যাওয়া হয়।আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড়ো ভাই দুজন কে পালাক্রমে হাটিয়ে ও কোলে করে নেয়া হয়েছিল। আমাদের নখ ভেংগে পা কেটে রক্ত ঝরছি।,অনেকে র মায়া হওয়ায় পথচারী রা ও কোলে করে এগিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের প্রায় নখ ই আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। ওখানে কিছুদিন থাকার পর শহর থেকে আসা লোকজন বেড়ে যাওয়ায় আমরা গাংনীর কাছে মহেশপুরে আমার বড়ো খালাম্মার বাড়ি চলে যাই।যুদ্ধের বাকি সময় আমাদের পরিবার সেখানেই ছিল।

ছোটোবেলায় শান্তাহারে এবং বিয়ের পর চট্টগ্রামে রেলওয়ে কলোনি তে বিহারিদের সাথে থাকায় মা বেশ ভালো উর্দু জানতেন।তাই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মা প্রয়োজনে শহরে যেতেন।অবশ্য প্রায়ই গহনা বিক্রি করে বাজার করা আর বড়ো ভাই এর খোঁজ খবর নিতেই যেতেন।

একমাত্র আর্নিং মেম্বার যুদ্ধে, তাই জীবন চালাতে মা আর বড়ো বোনের বিয়ের জন্য গড়িয়ে রাখা গহনাগুলো বিক্রি করা ছাড়া উপায় ছিলো না।তাতে অবশ্য চলেও চলছিল না।তাই ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া কিশোর মেঝভাই গ্রামের লোকজন এর সাথে গামছা আর লুংগী বিক্রি করতে সাইকেল চালিয়ে হাঁটে হাঁটে যেতেন। এভাবেই চলছিল দ্বৈত লড়াই।

আমাদের মেহেরপুরের বাড়িতে সিঁড়িঘরে দেয়ালে বইপত্র রাখার জন্য একটা বড় আলমারি সাইজের তাক ছিলো। সেখানে অস্ত্র রেখে সিমেন্ট করা থাকতো।তার উপর পাকিস্তানি পতাকা এঁকে দেয়া ছিলো। সন্দেহ মুক্ত থাকতে। মুক্তি যোদ্ধারা প্রায়ই আসা যাওয়া করতো।মেঝভাই যেয়ে খবর আনা-নেয়া করতো।কিশোর হওয়ায় কেউ সন্দেহ করেনি।

একবার খবর এল,চুয়াডাংগায় অপারেশন চালাতে গিয়ে পাক আর্মির ব্রাশফায়ার এ আমার মিয়াভাই মারা গেছেন। সংবাদ পৌছালে আমার শক্ত কঠিন মা খুব কাঁদলেন।আবার অবিশ্বাস ও করলেন। আল্লাহ মেহেরবান তাঁকে এতো বড়ো কস্ট দিবেন এটা তিনি মন থেকে বিশ্বাস করতে পারেন নি।

অনেক দিন পর গ্রাম থেকে ওপারে কাজে যাওয়া কৃষক রা আমার ভাইয়ের বেঁচে থাকার খবর নিয়ে আসলেন। তাঁরা মাকে বল্লেন তাঁরা নাকি মিয়াভাই কে দেখেছেন তার সাথে কথাও বলেছেন।

সংবাদ শুনে মা নফল নামাজ আদায় করলেন।অনেক দিন পর আমরা সবাই ঈদের আনন্দ পেলাম।যারা খবর এনেছিলেন তাঁদের কাছে মিয়াভাই কে নিয়ে আসার বায়না ধরলেন মা।যুদ্ধ কবে শেষ হবে কেউ জানে না তাই একটিবার আরাধ্য (আমার প্রথম বোন আতুড়ে মারা গিয়েছিলেন আর তিনি নানার বংশে প্রথম ছেলে নাতি) ধনের মুখটা তিনি দেখতে চান।

মা এর কথামতো তাঁরা মিয়াভাই কে চাষা ভুষা র সাজে সাজিয়ে মাথায় মাথাল দিয়ে,খালি গা, খালি পা উঁচু করে লুংগী পরা মাথার ঝুড়িতে সবজি সদাই দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে আসলেন।ঝুড়ির ভিতর নিচের দিকে অস্ত্র আর আমার জন্য দুটো ফ্রক ছিল। খুব সুন্দর। অনেক দিন পর্যন্ত ছিলো সাথে।পরে পুতুল কে পরাতাম।

সেরাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মা খুব কাঁদলেন। তারপর রাতভর গল্প চলেছিল। শোনালেন কিভাবে ব্রাশ ফায়ারে আহত হয়ে ক্রল করে করে ঝোঁপ জংগলের মধ্য দিয়ে বর্ডার ক্রস করে ভারতে ফিরে গিয়ে বেঁচেছিলেন।দিল্লিতে ছিলেন। ওখানে পক্স হয়েছিল। সুস্থ হয়ে আবার ও অপারেশন এ অংশ নিচ্ছিলেন। এদিকে অপারেশন চালিয়ে আবার ভারতে চলে যেতেন।

সারাদিন ছিলেন। গ্রামের টিকটিকিরা জেনে যাওয়ায় সন্ধ্যার পর পরই আবার চলে গিয়েছিলেন। একেবারে দেশ স্বাধীন হলে আমরা মেহেরপুরের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর উনিও ফিরে এসেছিলেন।

এভাবেই আমি যুদ্ধ দেখেছি। আমি আমার পরিবারের সাথে যুদ্ধের অংশ ও স্বাক্ষী হতে পেরে গর্বিত।

সকল যুদ্ধস্বাক্ষী পরিবার, মুক্তি যোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তি যোদ্ধা, বীরশহীদ দের প্রতি স্ব-শ্রদ্ধ সালাম ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই!

ফাতেমা_হোসেন
৪/১২/২১