সারাদিনের মধ্যে সকাল বেলাটা আমার অতিপ্রিয় একটা সময়। সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমি যতরাত করেই ঘুমুতে যাইনা কেন,সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা আমার অভ্যাস।
ভোর হবে সূর্য মামা গাছের আড়াল থেকে ঝিলিক দিয়ে উঁকি দিবে এই দৃশ্য দেখা আমার অতি প্রিয় একটা বিষয়! আর উঠোনের উপরেই ডালিম গাছে টুনটুনি,আর বুলবুলি পাখির কিচিরমিচির করে লাফিয়ে বেড়ানো দেখা এক আনন্দদায়ক ব্যাপার।কখনো তা মিস করতে চাইতাম না।
অনেক ছোটো বেলায় আমরা যখন মেহেরপুরে ছিলাম তখন সবার আগে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে পারতাম না বলে একটা জানালার শিক ঘুরিয়ে বের হয়ে আসতাম। ওটা ঢিলা ছিল।আমরা ছোটো তিনভাইবোন ই ইউজ করতাম। বড়ো রা যখন তালা দিয়ে রেখে বাইরে যেতেন।আমরা নিজেরাই ঐপথ আবিষ্কার করেছিলাম!
বাড়িতে দুটো উঠোন ছিল।একটা ভিতর বাড়িতে অন্যটা বাহির বাড়িতে। তো আমার কাজ ছিল পৈঠার উপর রাখা ওজুর জন্য কাঁসার বদনা টায় পানি ভরে কেঁচোয় উঠানো মাটি দেখে দেখে সেই গর্তে পানি ঢালা।সে এক মজার খেলা।এখন কার শহুরে বাচ্চারা জানবেও না।গর্তে পানি ঢালতে থাকলে এক সময় ভেতরে লুকিয়ে থাকা ঘুগরো পোকা বেরিয়ে আসতো।তখন একটু ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে সরে যেতাম।
তারপর হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতাম।উচ্চঃস্বরে পড়তাম যাতে সবার ঘুম ভেংগে যায়।তখন বড়ো রা এক এক করে উঠে পড়তো।একবার বারান্দায় পাটি পেড়ে অ -তে ঐ অজগর আসছে তেড়ে এইভাবে পড়ছি!
তখন দেখি একটা সাগর কলা এসে আমার গায়ে পড়লো। আমি ভয় পেয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ট -তে টুনি পাখির বাসায় ডিম, ঠ -তে ঠান্ডা পানি বেজায় হিম পর্যন্ত পড়তেই আরেক টা কলা তারপর একপিস পাওরুটি এসে গায়ে পড়লো! আমি মোটেও ভয় পেলাম না। বুঝে গেলাম কার কাজ!চিৎকার দিয়ে মাকে ডেকে উঠলাম মা ওমা মিয়া এসেছে ওঠ দেখে যাও।উনি আর মামা চট্টগ্রাম থেকে যাবার সময় এই গুলি আর আনারস নিয়ে যেতেন।আমার ডাক শুনে সবাই হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে আসলে মিয়া ভাই ও দেয়ালের আড়াল থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসলেন। বল্লেন কিরে, তোর ভয় করে না?
আমিও মাথা ঝাকিয়ে বললাম না।
আজকের সকাল টাও ঠিক যেন সেরকম একটা সকাল। স্মৃতিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
সময় টা ২০০০ এর আগস্টের শেষ সপ্তাহ। ২৮শে আগস্ট আমি এডমিট হলাম চট্টগ্রাম হলিক্রিসেন্ট হসপিটালে। পরেরদিন দুপুরে অপারেশন এর মাধ্যমে ছোটু জন্ম নিল।ডাঃ তাহের খানের তত্বাবধানে। কয়েক দিন ওখানে ছিলাম। এক সপ্তাহ।
আমার কেবিন টা ছিল পিছনে। সর্দার নগর ঝাউতলা দেখা যেত।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসার ট্রেন এদিক দিয়ে আসা যাওয়া করতো।রেললাইন ঘেসে একটা কাচা রাস্তা। সেই রাস্তার পাশে খেজুরগাছ ছিল।যেন গ্রাম্য মেঠো পথ।রাতে আমার বড়ো ভাবি থাকতেন।যদিও সার্বক্ষণিক আয়া ছিলো, তবুও তিনি রাতে প্রচন্ড বৃস্টির মধ্যে কোনো রকম যানবাহন না পেয়ে প্রায় দিন ই হেঁটে হেঁটে আসতেন।এখন ভাবলে ও কস্ট হয়।
বাচ্চাদের রেখে আসতেন। (যদিও তারা মোটামুটি বড়োই হয়ে গিয়েছিল)। তাই ভোর হতে না হতেই নামাজ শেষে বেরিয়ে যেতেন। উনি হেটেই যেতেন। উনাকে যতক্ষন দেখা যেত ততক্ষণ আমি চেয়ে থাকতাম। আর আমার বন্দী মন ছুঁটে যেত ঐপথে।শুধু মনে হত আহা! এই ভোরবেলায় আমিও যদি এই পথটা ধরে হেঁটে যেতে পারতাম!
আজকাল আবারও এমন হয়। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে ভোরে হাঁটা হয়না। আর অট্টালিকায় ভরা এই শহুরে ভোরে আলাদা কোনো রোমাঞ্চনেই। কখন রাত কখন দিন সবসময় কোলাহল লেগেই থাকে। গাড়ির শব্দে দিনরাতের পার্থক্য খুঁজে পাওয়াই দায়।
এখানে নিরবতা নির্বাসনে গেছে!
এখানে আঁধার কে হটিয়ে দেয়া হয়েছে
স্ট্রিট লাইট আর নিরাপত্তা লাইটের
অথবা গায়েহলুদ, বিয়ে বাড়ি,বিশেষ দিনের
আলোক সজ্জায় নকল আলোর টুনিবাতি জ্বেলে!
এখানে ভোর হয় আজও প্রকৃতিতে,
সময় হয়না তা দেখার রাতজাগা মানুষগুলোর
সাধ করা ঘুমের ঘোরে।
ফাতেমা_হোসেন
১৯/১/২২.
সকাল সাড়ে আটটা।