আমি উৎকোচ---আমার ডাক নাম ঘুষ

কবি কাব্য করিয়া উচ্চারণ করিয়াছেন, মেঘের অনেক রং।

আমি কবি নহি।

তবু, কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলাইয়া বলিতে হইতেছে, আমার অনেক নাম।

আমার চলাফেরা, আমার অস্তিত্ব সারা পৃথিবী জুড়িয়া।

আমি মনুষ্য জাতি কর্তৃক কৃত নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি কর্ম।

আরো পরিষ্কার করিয়া বলিলে বলিতে হয়, আমি মনুষ্যজাতি দ্বারা সম্পাদিত আনন্দ,সুখ,শান্তি প্রদানকারী একটি কর্ম মাত্র।

আমার সংস্পর্শে একবার যে আসিয়াছে, কেবল সেই-ই জানে, আমার সান্নিধ্য কত মধুর, কত আনন্দময়। তবু, একদল মানুষ আমাকে সহ্য করিতে পারে না।

তাহারা আয়োজন করিয়া যাহা নহে তাহাই বলিয়া আমাকে গালমন্দ করিয়া থাকে। এমনকি, যাহাদের সুখের জন্য আমি আমার সমস্ত অমিয় সুধা দান করিয়া একা সমস্ত কলঙ্কের বোঝা নিজ স্কন্ধে লইয়া নীলকণ্ঠ হইয়াছি, তাহারাও আমার নিন্দায় মুখর হইয়া থাকে।

বাঙলাদেশের মতো দেশগুলিতে যে কোনো, বিশেষ করিয়া সরকারী কাজ সুসম্পন্ন করিবার জন্য আমি অত্যাবশ্যকীয়। যে কোনো অফিস হইতে যে কোনো বৈধতার জন্য আমাকে অবৈধভাবে ব্যবহার করা হইতেছে।

ভূমি অফিসের কোনো দলিল বা সনদপত্র প্রয়োজন, আমাকে ব্যবহার করুন, চব্বিশ হইতে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে হাতে চলিয়া আসিবে। গ্যাস, বিদুৎ বা জলের সংযোগ দ্রুত দরকার, আমাকে ব্যবহার করুন, মনে হইবে আলাদিনের চেরাগ হইতে স্বয়ং জ্বীন নির্গত হইয়া কাজটি সম্পাদন করিয়াছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য হইতে শুরু করিয়া সর্বত্র আমার সচ্ছন্দ বিচরণ। তবু, এক শ্রেণীর তথাকথিত সুশীল সমাজের মানুষ আমার বিরুদ্ধে সর্বদাই খড়্গহস্ত।

আমার দুঃখ রাখিবার কোন স্থান নাই। আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন হইতে যে গভীর বেদনা সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছি, অদ্য তাহাই প্রকাশ করিবার প্রয়াসী হইয়াছি।

পূর্বেই বলিয়াছি, আমার নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নাই।

মানুষের কর্মেই আমার প্রকাশ, আমার অস্তিত্ব।

সারা পৃথিবী জুড়িয়া মানুষ বিভিন্ন জাতি ও ভাষায় বিভক্ত। আমাকেও বিভিন্ন জাতের মানুষ তাহাদের নিজস্ব ভাষায় আমাকে আহ্বান করিয়া থাকে।

বাংলা ভাষায় আমার একটি ডাকনাম আছে, আরেকটি ভালো অর্থাৎ পোশাকী নাম আছে।

আমার ডাকনাম হইলো ‘ঘুষ’। এই নামে আমাকে বাংলাভাষী শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ ভেদে সকলেই ডাকিয়া থাকে। ইহা অনেকটা বাঙালির ‘খোকা’ ‘পটলা’ ‘বাবু’ প্রভৃতি নামের মতোই বড়ই আদরের।

তবে, যথেচ্ছাচার ব্যবহারে ইহার যে সৌন্দর্য, মাধুর্য তাহা অনেকটাই বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। তবুও, মাতা যখন তাঁহার আদরের সন্তানকে ‘খোকা’ বলিয়া ডাকিয়া উঠেন, তাহা যেমন স্নেহরসে উথলাইয়া উঠে, ক্ষমতার উচ্চশিখরে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের ডাকেও সেই তুলনাহীন মাধুর্য এখনও সরবে এবং সগৌরবে উপস্থিত আছে। তাহার মিষ্টতা দুষ্টু লোকেরা নষ্ট করিতে পারে নাই।

এই বিষয়ে যে কথাটি না বলিলে বাঙালি জাতির প্রতি অন্যায় করা হইবে, তাহা এই যে, ‘ঘুষ’ শব্দটি আদৌ বাংলা শব্দ নহে। ইহা হিন্দি শব্দ।

আবার, আমার যে পোশাকী ভালো ভদ্রজনোচিত নামটি রহিয়াছে, তাহা হইলো ‘উৎকোচ’। আমার এই নামটি সাধারণতঃ বুদ্ধিজীবী মহলে, কোন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পঞ্চ তারকা বিশিষ্ট পান্থশালায় যখন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, তখন এই নাম উচ্চারণ করিয়া আমার বিরুদ্ধে যারপরনাই বিষোদগারের স্রোত বহাইয়া দেওয়া হইয়া থাকে।

অবশ্য ইহাতে অদ্যাবধি আমার কোন ক্ষতি হয় নাই। তবে, আমি যেহেতু সহজ সরল, তাই মনে অনেক ব্যথা অনুভব করি।

তাই তো অদ্য আমার প্রাণের ভিতরে সঞ্চিত ব্যথা বেদনার কথা প্রকাশ করিতে উদ্যোগী হইয়াছি।

আমি আবারও জোরালো কন্ঠে বলিতেছি, ঘুষের মতো আমার পোশাকী নাম এই ‘উৎকোচ’ শব্দটিও বাংলা নহে। ইহা সংস্কৃত ভাষা হইতে উদগত হইয়াছে।

আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাইতে গিয়া অহেতুক বাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপর যে কলঙ্ক কালিমা লেপনের চেষ্টা চলিতেছে, তাহা নিতান্তই দুঃখজনক।

আমি, উৎকোচ ওরফে ঘুষ, এই ফেসবুকের মাধ্যমে ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি। এই প্রতিবাদ না করায়, কিছু তথাকথিত ‘উন্নত’ দেশে আমাকে বিভিন্ন ভাবে বিকশিত হইতে না দিয়া পঙ্গু করিয়া রাখা হইয়াছে। অনেক দেশে আমাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইয়াছে। অনেক দেশে আমি বিলুপ্তির পথে। তবে, বাঙলাদেশের মতো অনেক দেশেই আমি সগৌরবে বিরাজমান। তৃতীয় বিশ্বের মহান বিপ্লবী ও সংগ্রামী মানুষেরাই আমাকে অদ্যাবধি সযত্নে লালন পালন করিয়া আসিতেছে। আমি তাহাদের উপর যারপরনাই কৃতজ্ঞ।

আমাকে ঘুষ অথবা উৎকোচ, যে নামেই ডাকা হউক না কেন, আমার সমস্ত শরীর মধুময়।

আমার শরীরে চর্ম, মাংস, হাড় বলিয়া কিছুই নাই। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে মধুর ন্যায় এক প্রকার ঘন অর্ধ তরল বস্তুর মধ্যে অসীম জীবনী শক্তি দিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন।

বিজ্ঞানীরা অনুমান করিয়া থাকেন, সূর্যের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা ৫,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু, আমাকে কতো ডিগ্রি তাপমাত্রায় নিক্ষেপ করিলে আমি বিনাশ হইবো, তাহা অনুমান করিবার মতো বুদ্ধি তাহাদের অদ্যাবধি হয় নাই। ইহার জন্য আমি আমার স্রষ্টার কাছে সব সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া আসিতেছি।

সারা দুনিয়া জুড়িয়া যার যার নিজস্ব ভাষায় আমার নামকরণ করিয়া আমাকে সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করিয়া আসিতেছি।

আমার বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ বিভিন্ন ভাষায় আমার বিভিন্ন নাম আপনাদের সদয় অবগতির জন্য পেশ করিতেছিঃ

ইংরেজিঃ ব্রাইব,

ফ্রেঞ্চঃ পোঁত দ্য ভিন,

ইতালিয়ানঃ কোরোমপেরে,

জার্মানঃ বেশটেখুং,

স্প্যানিশঃ সোবোরনো,

আরবীঃ রাশুয়া,

উর্দুঃ রিশোয়াত।

এতো কথা বলিলাম এই জন্য যে, এই পলি বিধৌত উর্বর বঙ্গভুমি হইতে আমাকে উৎখাত করিবার জন্য একদল সজ্জন ব্যক্তি নিরন্তর চেষ্টা করিয়া যাইতেছেন। তাঁহাদের নিকট আমার সনির্বন্ধ নিবেদন, তাঁহারা যেন এ প্রচেষ্টা হইতে নিজেদের নিবৃত্ত রাখেন।

কারণ, সারা পৃথিবী জুড়িয়াই আমার অস্তিত্ব বিরাজমান। এই দেশের মানুষ সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ।

বাংলা ভাষায় আমার নাম পর্যন্ত নাই।

সুতরাং, আমার জন্য এই সমস্ত বঙ্গ সন্তানদের দায়ী করা মোটেই সমীচীন নহে।

পরিশেষে, আমার বিনীত নিবেদন এই যে, মহান সৃষ্টিকর্তা আপনাদিগকে আরও অনেক কাজ করিবার অভিপ্রায়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে আনয়ন করিয়াছেন। আপনারা সেই সমস্ত কাজে মনোনিবেশ করুন। অহেতুক আমাকে গালিগালাজ করিয়া আপনাদের সুনাম নষ্ট করিবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!