গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত শীত ও বসন্ত। প্রতিটা ঋতু আমাদের মনে এক ভালো লাগার অনুভূতি জাগায়। আবার সেই ঋতুই আবার পরিবর্তনের সময় আমাদের সর্দি কাশি জ্বর নানা রকমের অসুখেও ফেলে। সীমারও এর ব্যতিক্রম হলো না। গ্রীষ্মের পর এলো বর্ষা। সীমার মনেও এলো এক অনুভূতি। বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা হাতে নিয়ে অন্যরকম ভালো লাগা অনুভব করে। বৃষ্টিতে ভিজে সে এক অজানা স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়।
বিকেল থেকে সীমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়। তারপর গা গরম হতে শুরু করে। রাত যত বাড়তে থাকে সীমার জ্বরও বাড়তে থাকে। এতো রাতে কোন ডাক্তার নেই। সীমা বেহুশ হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে জ্ঞান ফেরে। সে দেখতে পায় সীমার মা মাথা পানি ঢালছে, কাঁদছে আর আল্লাহকে ডাকছে। সকাল হওয়ার সাথে সাথে সীমার আব্বা মাইক্রো ভাড়া করলেন। মাকে বললেন, শহরের ভালো কোন ডাক্তার দেখাতে। সেদিন ছিল হরতাল। গাড়ির মলিক ভয়ে ভয়ে পাঠালেন।
রাস্তা ফাঁকা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু সীমার আজ সেই বৃষ্টি ভালো লাগছে না। তার শীত লাগছে। সীমার এক ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় তারা উঠলো। সীমার ভাই বললেন রাস্তায় কোন সমস্যা হয়নি তো। সীমার মা বললেন, না সমস্যা হয়নি। ডাক্তাররা সাধারণত তিনটা চারটার দিকে চেম্বারে বসেন। সীমার ভাই শহরের সেই নামি-দামি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। গায়ে চাদর জড়িয়ে সীমা মায়ের হাত ধরে কাপতে কাপতে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকছে। ঢুকতেই সীমার চোখ পড়লো ডাক্তারের দিকে। মনে হচ্ছিল এটা ওর আঁকানো ছবি। সীমা কাছে গিয়ে বসলো। ডাক্তার সবকিছু শোনার পর সীমার কপালে হাত দিয়ে জ্বরের অবস্থা নিশ্চিত করলেন। সীমার তখন রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের সেই উক্তি মনে হলো,
“আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম। কাহাকে পাইলাম।”
সীমার জ্বর সেরে গেল। কিছু সীমার আর ভালো লাগে না। বৃষ্টিতে একা ভিজতে আর ভালো লাগে না। সেই একটাই ছবি একটাই সুর ভেসে আসে। এখন কেমন লাগছে? সীমা তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। সীমার সামান্য সর্দি কাশি হলেই সে ছুটে যেত ডাক্তারের কাছে। অনেক দূরের রাস্তা হওয়ায় বেশি একটা সে আসতে পারতো না। তারপর আবার টাকা পয়সার ঝামেলা আছে। সত্যি সত্যিই সীমার একদিন প্রচুর পেট ব্যাথা শুরু হলো। সীমা ওর সেই পছন্দের ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার সীমার পেট দেখতে দেখতে তিনিও কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেলেন। সীমার যেন সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছ। হঠাৎ সীমা ভীতু হয়ে গেল। সীমা এতোটা ভাবে নি। সীমা বাধা দিল। সেইও থামে গেল। পরিস্থিতি তেমন খারাপ হয়নি। সীমা বাসায় চলে যায়। কিন্তু সীমার চিন্তা বেড়ে গেল। সে রাতে আর ঘুমোতে পারে না। পড়ার টেবিলে মন বসে না। প্রেসক্রিপসনে ডাক্তারের নম্বর দেখে ফোন দেয়। ডাক্তার বললেন কে? সীমা,আমি সীমা। ডাক্তার আর কথা না বলে ফোন রিসিভ করে রেখে দেয়। মিনিটে সাত টাকা বিল উঠছে আবার কথাও বলছে না। সীমা ফোন কেটে দেয়। আর কোন দিনও ফোন দেয় নি। কিন্তু সীমা তাকে ভোলেনি।
সীমা যখন বিএ পড়ে তখন সীমার পরিবার সীমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। সীমা ভাগ্যকে মেনে নেয় খুব সহজেই। সীমার একট সন্তানও হয়। সীমা আবার অসুস্থ হয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। সীমা যে ওয়াডে ভর্তি হয় সেখানে ডাক্তারের রাউন্ড দেওয়া হয়ে গেছে। অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে সীমাকে ডাক্তার দেখানো হয়। পরদিন সীমা চাদর টেনে শুয়ে আছে। এমন সময় কে যেন বলল ডাক্তার আসছে। সীমা কোন সাড়া দিলো না। আবার একজন বলে উঠল দেখি চাদরটা সরান তো। সীমার বুক কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি করে সীমা চাদর সরিয়ে মুখ বের করে উঁকি দেয়। সীমার চোখ আটকে গেল। দুজন দুজনের দিকে কিছু সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সীমা পুরো চাদরটা সরিয়ে ফেললো। তারপর সীমা বলল,কেমন আছেন? ডাক্তার বললেন তু..তুমি কি আমার কাছে গেছিলা? সীমা মাথা নেড়ে উত্তর দেয়। ডাক্তার আবার বললেন, কবে? সীমা উত্তর দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলে। তার গলা দিয়ে আর কথা বের হলো না।
ডাক্তার শান্ত করার চেষ্টায় ব্যথ হলে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে যায়। কিছু দিন চিকিৎসার পর সীমা সুস্থ হয়ে যায়। ডাক্তার সীমার গালে আদরের ভঙ্গিতে দুইটা থাপ্পড় মারে। তারপর আবার সীমার গালে হাত রেখে চোখ দেখে। সীমা তখনো স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ডাক্তার যখন আবার গালে হাত রেখে চোখ দেখলেন ততক্ষণে সীমা নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে যায়।
সেই যে সীমা ঘুমিয়ে গেছে আজও সেই ঘুম ভাঙেনি। আজও সে স্বপ্ন দেখে।
©মুন্নী