পিস্তলের গুলিতে বুক ঝাঝরা করা যায়, কিন্তু হৃদয় স্পর্শ করা যায়না, কোন একটা নাটকের সংলাপ ছিল এটা নাম মনে নেই। এই কথাগুলোই আজ আমার জীবনে সত্য হয়ে ধরা দিল। এত সাধ্যসাধনা, অন্যায় অপকর্ম করে তার কাগজকলমে বউ হলাম আমি, ধর্মেও বৈধতা পেলাম। শুধু তার সহধর্মিণী হয়ে উঠতে পারলাম না। সে আপুর ভালোবাসা ভুলতে পারেনি আর এতসহজে ভোলা সম্ভব ও না। কিন্তু আপুর উগ্রপন্থী আচরণ আর উচ্চবিলাসী স্বভাবের কারনে আপু এমনটা করতে পারে এ কথা পরিবার নূরেরও কিছুটা বিশ্বাস ছিল। বিয়ের আগেই আপু রীতিমত ঝগড়া করে বিলাস উপাচার আদায় করতো বাবা, ও নূরের থেকে। আমি বরং শান্ত, কর্মঠ, সাজহীন সাদাসিধা ছিলাম। দু’ প্রাণির সংসারে যেন রাজ্যের নীরবতা, যেন কল্পনার নিঝুমপুরি। আমরা যেন ভিন্ন দুই গ্রহের প্রাণি। সে আমার থেকে দূরে দূরে থাকে কথাও সীমিত। দু’ কামরার ঘরে পড়ার ঘরটাই তার শোবার ঘর। আমি যথাসাধ্য তার দরকারের খেয়াল রাখি। খাবার, পোশাক পরিচ্ছদ সব কিছুতেই একটা আন্তরিক যত্নের ছোঁয়া। আসলে আমি তো সত্যই তাকে ভালোবাসি। অন্যায় হয়তো করেছি। তবে ভালোবাসা আর যুদ্ধে সব পথই নাকী সঠিক। তবে আমার কী দোষ? আমি তো আমার ভালোবাসাকে পেতে চেয়েছি মাত্র।
কয়েকদিন পরে আলমারীর চাবিটা দিয়ে বললো তোমার যা দরকার খরচ করো, পোশাক, প্রসাধনী লাগলে কিনো, আমি ঠিক কেনাকাটা করতে পারিনা।
কথাটা ডাহা মিথ্যা সে আগে অনেক কিছুই কেনাকাটা করেছে নীলাপুর জন্য। তবে চুপ রইলাম। সব কথা সব সময় বলা যায় না। একটা ভুল পদক্ষেপ সব চুরমার করে দিতে পারে। নিজের পোশাক নিজেই ধোয় সে, আমি ধুয়ে যত্নকরে গুছিয়ে রাখি।
এত কাজ করার দরকার নেই, আমি একটা কাজের লোক খুঁজছি।
আমার কাজের লোক দরকার নেই।
আর আমি ক্যান্টিনে লাঞ্চ করি, আমার জন্য প্রতিদিন খাবার প্যাক করে দিতে হবেনা।
আমার রান্না কী খাওয়ার অযোগ্য?
না না তুমি ছোট থেকেই অনেক ভালো রান্না করো, আমার জন্য কারো কষ্ট হোক তা তাইনা।
আমার তো ভালো লাগে তোমার সবকিছু গুছিয়ে দিতে।
পাশের শহরে আমার কলেজ বাসে ৪০ মিনিটেই যাওয়া যায়।আর বাসা থেকে বাসস্টান্ড রিকশাই ভরসা। আমি আবার কলেজে যাওয়া শুরু করলাম। সকালে ঘরের কাজ সেরে বের হই। দুজনের কাজে কারো হেল্প লাগেনা আমার। তার আসার আগেই ফেরা হয় আমার। তারজন্য নানা নাস্তা, ফল, শরবত গুছিয়ে রাখি। কেমন একটা অখন্ড নীরবতা ঘিরে রাখে আমাদের। সে যেমন চলে আমি জোর করিনা। কিন্তু মন আকুল হয় তার চোখে চোখ রাখতে, তার স্পর্শের অনুভুতি নিতে।
তার পৌরুষের সুনামীতে যদি আমার কুমারিত্বের বাঁধ না ভাঙলো তবে কিসের আমার নারী জীবন। কিন্তু কাছে যাইনা জোর করলে যদি এটুকুও হারাই। গায়ের রং খুব ফর্সা না হলেও তার অফিস পার্টিতে যথেষ্ট প্রশংসা হয় আমার। আমার পরিবারের কিছু লোক বাদে কেউ আমাকে অসুন্দর বলেনি কখনো। আর বাসায় এসে আমার হাতের রান্না খেয়ে সবাইতো প্রশংসায় গদগদ। এভাবেই চলছিল আমাদের সংসার এর মাঝে ২/১ বার বাড়িতে বেড়াতে গেছি আমরা। মা জানতে চাইলো,
সব ঠিকআছে?
বললাম হ্যা সব ঠিক ঠাক।
একদিন রিক্সার জন্য দাড়িয়ে আছি। সে মোটরবাইক এ যাতায়াত করে। এসে বললো,
ওঠো স্টান্ডে ছেড়ে দেবো। এখন থেকে কলেজের দিনগুলোতে বাইকেই যেও স্টান্ডে। আমি গা ঘেসে কাছাকাছি বসি। তার শরীরের সৌরভ আমার মনে বসন্তের আমেজ আনে। একদিন ইচ্ছে করেই রান্নার তেল ফেললাম হাতে। সে মলম দিয়ে দিল বাকীটা রান্না নিজেই করলো। তাহলে কী সে আমায় ভালোবাসতে শুরু করেছে? নাকী এটা নিছক কর্তব্য। মাঝেমধ্যে কথা হয় আমাদের সাম্প্রতিক কোন বিজ্ঞান বিষয়ে। বিজ্ঞানে তার আগ্রহ বরাবরই, আমিও সে সুযোগটাই কাজে লাগাই। এই পাথরের মতো নীরবতা অসহ্য। তবে কী আমি খুব বড় ভুল করলাম? সে কোনদিনই আমার আপন হবে না? ৬ মাস পার হতে চললো। সে কেমন একটা দ্বীধায় পড়ে থাকে আমার কাছাকাছি আসতে চায়না হয়তো পারেনা। এই বাঁধা আমাকেই ভাংতে হবে।
একদিন সন্ধ্যায় খুব সাজলাম আমি আকাশী জর্জেট শাড়ি, স্লীভলেস ব্লাউজ, চোখে ঘনকরে কাজল। লিপিষ্টিক আর মুক্তার গয়না। অবাক চোখে সে তাকালো আমার দিকে। কারণ আমি তো কখনো সাজি না। বললাম,
একটা অনুরোধ করবো রাখবে?
বলো।
তোমাকে প্রথম ও শেষ বারের মতো একটু ছুঁতে দেবে? তুমি আমাকে মানতে পারবে না জানি। তাই তোমাকে মুক্ত করে দেবো কাল। চলে যাবো না। রেলের নিচে পড়বো কেউ চিনবে না। তোমার সমস্যা হবে না, অশ্রুর বাঁধভাঙা প্লাবনে ভাসছিলাম আমি। মনের মাঝে যত পাপ,অপ্রাপ্তি আর অপমান জমে বরফ হয়ে ছিল সব গলতে লাগলো, ভাসতে লাগলাম অশ্রুস্রোতে।
যে ভাবেই হোক বিয়েটা করেছি আমি, তোমার প্রতি অন্যায় করছি আমি। সরি আমি চেষ্টা করবো সবকিছু স্বাভাবিক করতে। তোমাকে ভালোবাসি কিনা জানিনা তবে তুমি আমার অভ্যাস। তোমাকে হারাতে চাই না।
সে সামনে এগিয়ে এসে আমার দু’বাহু ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললো,
এমন করে কাঁদছো কেন পিচ্চিদের মতো, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি মোমের মতো গলে পড়লাম তার দু’বাহুর মাঝে।
আস্তে ধীরে অন্য সব স্বামী স্ত্রীর মতো দিন কাটতে লাগলো আমাদের। যত্ন, প্রয়োজন, বেড়ানো, বিনোদন কিছুই কমতি নেই। শুধু মাঝেমধ্যে তার চোখে তাকালে মনে হয় ওখানে যেন নীলাপুর ছবি। মনটা বিদ্রোহ করতো তখন ইচ্ছা হতো এসিডে ছবিটা পুড়িয়ে দিতে। তবে যে চোখ দুটোই থাকবে না। আর সেই উচ্ছল হাসিটা আর সে হাসেনা। ৩ বছর পার হলো। মাঝেমধ্যে আত্মগ্লানীতে ভূগি আমি। এ কাজটা না করলেই পারতাম। ভালোবাসা তো জোর করে পাওয়া যায় না ।মনে হয় নিজেকে পুড়িয়ে দিতে। মনের মাঝের সাপটা প্রায় মৃত আর নড়ার জোর পায়না। লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরিতে যোগ দিয়েছি আমি। ওর ও প্রমোশন হয়েছে। থাকার জন্য বড় বাড়ি , যাতায়াতের জন্য গাড়ি দিয়েছে ওকে। শ্বশুর মারা যাওয়ায় শাশুড়িও আমার সাথে থাকেন।তবুও মাঝেমধ্যে রাতে ঘুমাতে পারিনা। সেই চাঁদনী রাতে পুকুর ঘাটের মুখটি আমায় ঘুমাতে দেয়না। তবুও তার চোখ থেকে নীলাপুর ছায়া সরে যেত, যদি সেখানে সন্তানের মায়া পড়তো। শাশুড়ির একা একা লাগে আর কত দেরি, এমনই কথা তুললেন। সত্যই তো এবার আমাদের সন্তান দরকার। ডাঃ দেখানো উচিত।
রাতে শোবার ঘরে উচ্ছল হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো সে,
আমার, তোর মতো দেখতে নরম , শান্ত, গুণবতী একটা পিচ্চি চাই।
বিয়ের পরে এই প্রথম এমন উচ্ছল হাসি, আর তুই বলা পিচ্চি ডাক অতি খুশির প্রকাশ।
কিছু মানুষের জীবনে সুখ পাখিটা ছুঁয়ে যায় কিন্তু ধরা দেয়না। আমি ও তেমন। ডাঃ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ১ সপ্তাহ পরে জানালেন। কিছু শারিরীক ত্রুটির জন্য আমি কোনদিনই মা হতে পারবো না।
চলবে…