ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৫)

Photo of author

By Annama Chowdhury

সকাল বেলা হেঁটে হেঁটে সাঈদের বাসার গেটের সামনে গেলেন রাহেলা বেগম। ঘড়িতে হয়তো আটটা বাজে তখন। কাল সারারাত ঘুম হয়নি, প্রচন্ড খারাপ ছিল মন। তাই একদম সরাসরি কথা বলতে ছেলের বাসায় এসে হাজির হলেন তিনি।

দরজার সামনে গিয়ে তিন বার নক করলেন, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। দরজা ভেতর থেকে লাগানোই মনে হচ্ছে। চার নম্বর বার নক করার পর, দরজা খুললেন সাঈদ।

মা, কি ব্যাপার এতো সকালে?
– অফিস নাই আজ?
– আজ অফিস ছুটি, সরকারি বন্ধ।
– বউমা কোথায়?
– জাহান রাতে, ওর খালার বাসায় গিয়েছে।
– তুই বাসায় একা?
– হ্যা। আচ্ছা, কোন সমস্যা হয়েছে কি মা?
– না।
– হঠাৎ এভাবে সকাল সকাল দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছি। এখন দুই মিনিট বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
– আয়।

রাহেলা বেগম ছেলের বসার ঘর দেখছেন, দামী সোফা সেট চক চক করছে, সাদা আর সোনালী কাজ করা পর্দা গুলি বেশ ভারী এবং সুন্দর। বউমা বেশ পরিপাটি সব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। ডাইনিং আসতেই কালো চিকচিক করা ফ্রিজ টি চোখে পরলো। বেশ কিছু শোপিস লাগানো চম্বুক দিয়ে, হাতলেও সুন্দর চেক কাপড়ের কাভার করা। কাচের ডাইনিং টেবিল সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা।

সত্যি কথা, রাহেলা বেগমের ছেলের ঘরে এসে মন আগের চেয়ে সামান্য ভালো হয়েছে। বউ কত গুছিয়ে সংসার করছে। তারা নিজেরা সুখে আছে৷ এটাই অনেক বিশাল বিষয়, ছেলে মেয়েদের দাম্পত্য জীবনে সুখ থাকলে মায়েদের মন কত শান্তি পায়৷ খুশি হয়, এটা শুধু তারাই জানে।

কিন্তু একবার সাঈদের ফ্রিজ খুলতে ইচ্ছে করছে, তার ফ্রিজ দিয়েও কি এভাবে বিশ্রি গন্ধ আসে কিনা? দেখতে ইচ্ছে করছে। সম্ভবত আসেনা। এটা একদম নতুন ফ্রিজ। তবে, কেন সে মাকে, এই নষ্ট ফ্রিজ কিনে দিল।

সাঈদ, মুখ হাত ধুয়ে, মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো, রাহেলা বেগম তাকিয়ে আছেন, তাই সাঈদ কে দেখতেই এখন কত বড় অফিসার লাগে।

সাঈদ তোর ফ্রিজ অনেক সুন্দর।
– জাহান পছন্দ করে কিনেছে, আগের ফ্রিজ বিক্রি করে দিয়েছি।
– তোর মা অনেক গরীব, আর তোর বউ বড় লোকের মেয়ে, এজন্য মায়ের জন্য নষ্ট ফ্রিজ নিয়ে এসেছিস।
– ওহ, এজন্য তুমি এসেছো?
– সাঈদ, আমি সব কিছু মেনে নেই, তুই আমার বড় ছেলে, তিন ছেলের মৃত্যুর পর তোকে পেয়েছি। তুই আমার জন্য ছাত্র অবস্তায় অনেক কিছু করেছিস। আমি চাই তুই তোর পরিবার নিয়ে সুখে থাক। যতটুকু করেছিস, তাই আমি খুশি। কিন্তু এই নষ্ট ফ্রিজ দিয়ে কেন লজ্জা দিলি, বলতে পারবি? আমি কি চেয়েছিলাম?
– এটা আমার বন্ধুর দোকান থেকে নিয়েছি, সে বললো ভালো ফ্রিজ, শুধু হালকা গন্ধ আসে। লেবু রাখলে, নিয়মিত পরিষ্কার করলে, গন্ধ থাকবেনা।
– তাহলে কানেকশন আসেনি কেন?
– মা, আমি ফ্রিজের মিস্ত্রি নই। আমি তাকে বিশ্বাস করে এনেছিলাম। আর সামান্য গন্ধ হলে সমস্যা কি?
– মা তো ছাদের চিল কোঠায় থাকে, গন্ধ হলে সমস্যা কি?
– আমার ভুল হয়েছে। ভালো ভেবে কাজ করেছিলাম। তোমার দুই মেয়ে বেশি পন্ডিত। আর নাহিদের কথা নাই বললাম। তাদের তো দোষ ধরার শেষ নাই। আমার বউকে তারা পছন্দই করেই না।
– বউমাকে এখানে আনার দরকার নাই। আমি তোকে বলছি, পরের ঘরের মেয়েকে কেন দোষ দিব?
– বললাম তো ভুল হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত রেখে দাও, আমি শুক্রবার মানুষ পাঠিয়ে দিব। আজ আমার খালা শ্বাশুড়ির বাসায় দাওয়াত।

– দাওয়াত খেতে যা, সমস্যা নাই। কিন্তু তোর নিজের খালা আছে, আপন বোন আছে, তাদের জামাইরা আসে, তাদের ও দাওয়াত খাওয়াতে শেখার চেষ্টা কর। দাওয়াতে যাও, আমি যাই।
– তুমি কিসের মধ্যে কি বলো?
– দরজা আটকে দাও, আমি যাচ্ছি। ওরা বাসায় না পেয়ে চিন্তা করবে।
– বসো।
– না।

রাহেলা বেগম আর কোন কথা না বলে বেড়িয়ে এলেন। সাঈদ ও যেন মায়ের সব কথা শুনে চুপ হয়ে গিয়েছে।

সাঈদ কে তিনি কখনো শক্ত করে কিছুই বলতে পারেন না, তিন পুত্র মারা যাওয়ার পরে, সাঈদ এসেছিল, এক ভুবন খুশি নিয়ে। প্রচন্ড মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত সাঈদ সারাক্ষণ মায়ের পাশে পাশে থাকতো। আজ সে মা ছাড়া ভালো থাকতে পারে, কিন্তু মা তো তাকে ছাড়া ভালো নেই। ছেলের আচরণে তিনি সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেন নি, অথচ ছেলেকে কঠিন কথা বলেও, এখন যেন আরও বেশি বুকে কষ্টের চাপ হচ্ছে। সাঈদ কি তা বুঝে, হয়তো বোঝার মতো ক্ষমতা এখনো হয়নি!

পলি স্কুলের সামনে নিয়াজ কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুলের ভেতরে যাবে কিনা, বুঝতে পারছেনা। এই শহর খুব বেশি ব্যস্ত। স্কুলের সামনে চানাচুর ওয়ালা, আমড়া ওয়ালা সহ বিভিন্ন ধরনের হকর রা দাঁড়িয়ে আছে।

নিয়াজ বললো ভাবী চলো।
-তুমি যাও, আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
– তুমি একা থাকবে?
– সমস্যা নাই।

নিয়াজ ভেতরে গিয়ে কথা বলছে, পলি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ীর আচল বার বার সামনের দিকে আনছে, কেমন লজ্জা লাগছে তার।

সাদা ধবধবে শার্ট পরা আবিদ বাইরে আসছে নিয়াজের সাথে কথা বলে বলে। পলির বুক ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ বহুদিন বিদেশে থেকে, এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে আসছে।

পলি, কেমন আছ?
– ভালো আছি।
– আব্বা, সকালে কল দিয়েছেন, এজন্য অপেক্ষা করছি। আমি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ক্লাস নেই। তাদের ছুটি হয়ে গিয়েছে। শুধু নাইন টেন বাকি। কিন্তু আমি জানি, তোমাদের স্কুলে আসতে দেরী হবেই। এতো লম্বা জার্নি।
– হুম।
– খাওয়া দাওয়া করেছ?
– ক্ষিদা নাই।
– কি যে বলো, চলো তিনজন খেয়ে নিই।

দারোয়ান বলছে, স্যার ভাবী সাব নাকি?
– হ্যা জয়নুল ভাই।
– আসসালামু আলাইকুম ভাবীসাব।

পলি সালামের উত্তর দিয়ে হাসলো।

আবিদ খুব সহজেই তার আসা মেনে নিল, এটাই তার বেশ অবাক লাগছে!

খাওয়া-,দাওয়ার পর, আবিদ তার বাসায় নিয়ে গেল, আবিদ রাস্তার বললো আমি যে বাসায় থাকি, সেখানে একজন খালা আর খালু আছেন, তারাই বাড়ীওয়ালা। তাদের সব ছেলে-মেয়ে বিদেশ থাকে। তাদের একটা রুমে আমি থাকি, আগে তাদের উপর তলার মেসে থাকতাম। কিন্তু খালু গতমাসে তাদের নিচের তলার গেস্ট রুমে থাকতে বলেছেন। উনারা আমাকে নিজের ছেলের মতো আদর করেন।
– আগে তো বললে না রুম নিয়েছো?
– চিঠিতে কি এতো কিছু লিখা যায়? চলো।

পলিকে দেখে খুব আদর করছেন মহিলা। আবিদ খুব লজ্জা পেয়ে বলছে, খালা আমি আসলে জানতাম না আব্বা ওকে পাঠাবেন, নয়তো বাসা নিতাম।
– এটা কি মেস নাকি? এটা তো বাসা।
– বউয়ের চেহারা খুব মিষ্টি। খুব ভালো হয়েছে এসেছো। আবিদ সকালে স্কুলে যায়, আর ফিরতে ফিরতে দশটা। এখন আমাদের বুড়ো-বুড়ির সময় ভালো কাটবে।

নিয়াজ সারা রাস্তা আসলো, অথচ স্কুলে পৌছেই বললো দাদাভাই আমার বন্ধু চবি তে পড়ে আমি চলে যাচ্ছি।
– খেয়ে যা।
– না, আমি চলে যাচ্ছি।

আবিদ জোড় করেই খাওয়ে দিয়েছেন। কিছুতেই আর সাথে আসেনি নিয়াজ। রাতের ট্রেনেইন্সে আবার ফিরে যাবে।

পলি, রুমে গিয়ে দেখলো একটা সিংগেল খাট, আর একটি আলনা আছে, আর কিছুই নেই। তার একমাস এই বাসায় কাটবে, আস্তে আস্তে কিছু জিনিস কেনা দরকার। আবিদ কি কিনবে? না বলবে থাক, কেনার দরকার নাই, এক মাসই মাত্র থাকবা! কিনে কি হবে। তারপরও পলির বেশ আনন্দ লাগছে, আবিদের কাছে এসে।

রাহেলা বেগম বাসায় এসে দেখেন জলির জামাই উপস্থিত। তিনি রুমে ঢুকতেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো জামাই। তিনি কুশল বিনিময় করে ভিতরে গেলেন।

কলি বললো কাউকে কিছু না বলে, কোথায় গিয়েছিলে মা?
– হাঁটতে।
– নাহিদ তোমাকে খুঁজতে বেড়িয়েছে, যদি হেরে যাও।
– আমু কি শিশু যে হারিয়ে যাবো। জলির জামাই কি মনে করে? জলি ভালো আছে?
– ডাক্তার ব্জলিপাকে বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। আর ঢাকায় একজন ভালো গাইনী বিশেষজ্ঞ দেখাতে বলেছে, দু এক দিন পর ঢাকায় নিয়ে আসবে। এখন দুলাভাই চাইছে ডেলিভারি এখানে করাতে। ডেলিভারির আর দুই মাস মাত্র বাকী, এই সময় আমাদের বাসায় রাখতে চাইছে। তোমাকে লজ্জা পায়, তাই বলেনি।
– এখানে থাকবে! আচ্ছা। কিছু খাবার দিয়েছিস?
– কি দিব? মুড়ি?
– নাই নাই করার অভ্যাস গেল না। ময়দা আছে ডিম আছে, রুটি আর ডিম ভাজি দে, এখন আর কি দিবি। দুপুরে ভালো কিছুর ব্যবস্থা করছি।

রাহেলা বেগমের চিন্তায় ভালো লাগছেনা, মেয়ে এখানে এনে এতো দিন কোথায় থাকবে? পোয়াতি মেয়ের কত যত্ন দরকার। আবার সাথে সাথেই ভাবছেন, কিন্তু মেয়েদের এই সময় মাকেই বড় বেশি দরকার। তিনি কি খুব স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন! না, থাক নুন-ভাত যাই হবে, তাই খাওয়াবেন মেয়েকে। তবুও আসুক, চোখের সামনে থাকবে, তাই শান্তি।

তিনি আবার জামাইয়ের সামনে যেতেই সে বললো,

আম্মা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি বাইরে রুটি সবজি খেয়ে এসেছি।
– কেন বাবা?
– সাত সকালে ঝামেলা করবেন না।
– জলির কি শরীর খারাপ?
– জি, জটিল কিছুনা তবে, পা ফুলে আছে। শরীরেও পানি এসেছে। আমার মা, চাইছেন আপনাদের কাছে থাকুক। আর এখানে একজন ভালো ডাক্তার দেখানো জরুরি।
– বেয়ান কে অশেষ ধন্যবাদ মেয়েকে এই সময় এখানে দিচ্ছেন। তুমি ওকে নিয়ে আসো বাবা।
– আমি কি কষ্টে ফেলে দিচ্ছি আম্মা?
– বাবা কি যে বলো! এই মেয়েটা আমার মেয়ে। কি কষ্ট দিবে তুমি?
– জলি, আসতে রাজী না। ভাবছে বাসা-বাড়ীতে কষ্ট হবে। আমি চিন্তা করলাম ভাইজানের বাসাও আছে। মিলেমিশে থেকে যাবে।
– হ্যা বাবা।

রাহেলা বেগম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেম আর ভসবছেন ভাইজানের রাজপ্রাসাদ বোনেদের জন্য না বাবা। সহজ-সরল মেয়েটা এসব বুঝেনা।

বাড়ীওয়ালা এর মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন, ভাবী আপনার ছোট ভাইয়ের ফোন। একটু নিচে আসেন।
– আসছি।

রাহেলা বেগম দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলেন।

বুবু আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। বুবু ভালো আছ?
– ভালো আছি তুই?
– ভালো। শোনো আমার কলিগের ছোট ভাই ফরেস্টে চাকরি করে। কলির ছবি দেখে পছন্দ করেছে। আমি জাহিদের সাথে আলাপ করে, এই নাম্বার পেলাম।
– এখন বিয়ে না ভাই।
– দেখুক সমস্যা কি? এখানে নাকি দুই রুমের বাসা! সাঈদ সেদিন বললো বড় বাসা নিয়েছে। তুমি ওর বাসায় আয়োজন কর।
– না, এখানেই…
– আরে বুবু প্রথম দর্শন সুন্দর রাখতে হয়, আর কষ্ট করে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসবে।
– শোন।
– আমার বস ডাকছে যেতে হবে। রাতে ডিটেইলস বলবো। তুমি কালকের জন্য প্রস্তুতি নাও। রাখছি।

কট করে কেটে গেল ফোন। রাহেলা বেগম ফোন রেখে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি করবেন তিনি? কেমনে বলবেন যে, বড় ছেলের বাসায় এটা সম্ভব নয়। আর তার মেয়েকে এখানেই দেখে পছন্দ করলে করবে। তবুও তিনি ছেলের কাছে আর কিছু বলবেন না। কালকে দুপুরে কি খাওয়াবেন ছেলে পক্ষকে? কালকের চেয়ে এই মুহুর্তের চিন্তা আরো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, জামাই কে কি দিয়ে ভাত দিবেন? তিন টা ডিম আর সবজি ছাড়া আর কিছুই নেই ঘরে! নাহিদের কাছে টাকা আছে কিনা কে জানে! শাহিদের বেতন দিয়ে বাসা ভাড়া দেওয়া শেষ। এই ভবের এতো যন্ত্রণা আরও ভালো লাগেনা তার, তবুও সব সহ্য করে সুন্দর সমাধান দিতেই হবে কারণ তিনি যে, মা…..

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
০৭.০২.২০২২